ব্রহ্মতালুতে বার কয়েক মৃদু চাপর দিয়ে এক রকম দৌড়েই পাশের ঘরে চলে গেলো সবিতা, অনিমেষের বউ। খেতে বসে কথা বলার স্বভাব অনিমেষের কখনোই ছিলো না। বরাবরই এমন গুরুগম্ভীর লোকটা খাওয়ার সময় সাধারণত নির্বাকই থাকে। এই পরিবারে খাবার টেবিলে কখনো আড্ডা, হাসি ঠাট্টা হয় না। বিয়ের পর থেকেই এ বাড়িতে এই অলিখিত নিয়ম চলে আসতে দেখেছে সবিতা। তখন সবে নতুন বউ সে। কমলেশের তখনও গ্রাজুয়েশন শেষ হয়নি, শেষ বছর। কিন্তু এরমধ্যেই বিয়ে করে ফেলেছিলো রেজিষ্ট্রি করে। বৌদিকে একটু আধটু ভরসা করতো বেচারা, করবেই বা না ক্যানো। এই বাড়ির সবাই গাম্ভীর্য্যের যে অভেদ্য বলয় নিয়ে সবসময় ঘুরে বেড়াতো তা ভেদ করে ভাইয়ে ভাইয়ে কিংবা বাপে-ছেলেতে খোশগল্পের দুঃসাহস দেখানোর সাহস না অনিমেষ কখনো করেছিলো, না কমলেশ। তাই এক আধটা যা মনের কথা একান্ত না বললেই নয়, তা এসে সবিতার কাছেই পড়তে শুরু করে তখন। একদিন হুট করে খুব ভোরে কমলেশ দক্ষীণের ঘরে এসে দাঁড়ায়, ডাকে, বৌদি তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো। প্রশ্রয়ের হাসি হেসে সম্মতি জানাতেই একশ্বাসে সবটা বলে ফেলে সে। কিভাবে পরিচয় অহনার সাথে, কিভাবে ধর্মীয় বাধার দেয়াল টপকে কাছাকাছি আসে তারা, হুট করে ক্যানোই বা বিয়েটা করে ফেললো। অহনা ওর কলেজের জুনিয়র ছিলো। এর আগেও নাম শুনেছে দু একবার, কমলেশের মুখেই। পুরো ব্যাপারটা হজম করতে একটু সময় লেগেছিলো সবিতার, তবে সামলে নিয়েছিলো। বলেছিলো, তুমি ভাই অপেক্ষা করো কিছুটা দিন। দেখি, কখনো আবহাওয়া হালকা দেখলে তোমার দাদার কানে কথাটা দিয়ে দেবো। সবিতা দিতে পারেনি। বস্তুত অনিমেষের চোখে চোখ রেখে কথা বলার জড়তা তখনও কাটেনি তার। রাতে এক বিছানায় দুটো শরীর পাশাপাশি পড়ে তো ঠিকই থাকতো, কিন্তু মাঝখানের ইঞ্চিখানেক ব্যবধানও ছিলো লক্ষ কোটি মেইল সমান দূরত্ব। কখনো শেষ রাতে পরমপূজ্য ঘুমন্ত স্বামীর হাত পেটের উপরে এসে পড়লে কিংবা পিঠের নগ্ন ত্বক ছুঁয়ে গেলে তখনও চমকে উঠতো সে, মূহুর্তেই ঘুম টুম সব পালিয়ে কই চলে যেত! অস্বস্তি হতো বাকি রাত, এই মনে হতো মানুষটা কি জেগে উঠলো? মানুষটার কি খারাপ লাগছে? জল খাবে? ডাকলো কি আমায়! এই যে, ডাকলো মনে হচ্ছে, নাইলে পাশ ফিরে শু'লো ক্যানো! বিয়ের অনেকদিন পর্যন্ত অনিমেষ সবিতাকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। এরপর যদিও সময়ের নদীতে জোয়ার এসেছে, চাতকের শুকনো ঠোটে অবিরাম বারিবর্ষণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বহুবর্ষজীবী খড়ার আশঙ্কা শরীরের তুলনায় মনের দূরত্বটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো সহস্রগুন বেশি। কিংবা ভয়! কিসের ভয়, কিসের আতঙ্ক সবিতার এতো, নিজের স্বামীকে ক্যানো নির্ভয়ে সবটা বলতে পারবে না সে? ক্যানো পাশে এসে টুপ করে বসতে পারবে না, বিছানায় আলগোছে চুলগুলো টানতে টানতে ক্যানো লোকটার মুখটাকে বুকে টেনে নিতে তার বারবার ভাবতে হবে! ক্যানো থাকবে এতোটা দূরত্ব, শরীরে, মনে, আত্মায়! এসব বহুবার ভাবতে বসেছে সে, তখনই হয়তো অনিমেষের গালা ভেসে এসেছে সামনের ঘর থেকে, কিংবা শ্বশুরঠাকুরের গুরুগম্ভীর কন্ঠ, টেনে টেনে পা চালানোর শব্দে সে সংবিৎ পেয়ে পুনরায় ফিরে এসেছে বাস্তবতায়। জড়তা আর কাটেনি। তাই অনিমেষের কানে কানে আর বলা হয়নি, শুনছো, কমলেশ তো একটা কান্ড বাধিয়ে বসেছে। তুমি ঠান্ডা হও, উত্তেজিত হয়ো না। ছেলে মানুষ তো, তুমি বরং ওর সাথে একটু কথা বলো। ভাইটা তো তোমার নাকি! তার উপরে বাবাও আছেন, এই ঘটনা জানলে তিনি তো ওকে মেরেই ফেলবেন। না, সবিতা বলতে পারেনি। সারাদিন ঘরকন্নার পরে রাতে দুটো শরীরের ইঞ্চিখানের ব্যাবধানে নেমে এসেছে লক্ষ-কোটি মাইলের দূরত্ব।
কমলেশ অপেক্ষা করতে পারেনি বেশিদিন। সবিতার নতুন বউএর তকমা তখনও সিঁথির লালের পুরুত্ব কিংবা শাড়ির চাকচিক্য থেকে যায়নি। একদিন কমলেশ ঝড়ের বেগে ঢুকলো খাবার ঘরে, দাড়িয়েই থাকলো, বসলো না। বললো, আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো বাবা। খাবার টেবিলে কোন শব্দ হলো না, তবুও মৌণতাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে গড়গড় করে সবটা বলে গেলো কমলেশ। বাবা শুধু একবার তাকালেন ওর মুখের দিকে। এরপর পুনরায় খাবারে চোখ দিলেন। অনিমেশের হাত স্থির ছিলো শেষ পর্যন্ত, ভাত আর মুখে ওঠেনি। তবু বসে ছিলো। খাবার ফেলে রেখে টেবিল থেকে ওঠার নিয়ম নেই এ বাড়িতে। কয়েক মিনিটের সেই সময়টা কয়েক হাজার গুন স্লথ হয়ে উঠেছিলো, তবু একটা কথা হয়নি টেবিলে। একটা টু শব্দও না। খাওয়া শেষে বাবা চলে গেলেন তার ঘরে, পর্দার ওপার থেকে পা টেনে চলার আওয়াজ কানে আসা পর্যন্ত চুপচাপ বসে রইলো অনিমেষ। এরপর সেও উঠে চলে গেলো, বেচারার মুখে আর কোন খাওয়া ঢোকে নিয়ে। শুধু এক টেবিল বাসন নিয়ে বসে ছিলো সবিতা। আর পাশে কমলেশ, নির্বাক দাঁড়িয়ে। কমলেশ সেদিনই চলে যায় বাড়ি থেকে। আর ফেরেনি। তখম তো সবে নতুন বউ সবিতা। এরপর এতোগুলো বছর কাটলো, খাবার টেবিলে শব্দ হলো না। ঘরে পা টেনে হাটার শব্দটাও মিলিয়ে গেলো একসময়। ঘরে একে একে দুজন নতুন মানুষ এলো। তারা বড় হতে লাগলো একটু একটু করে, শিশুতোষ কোলাহলে ভরে উঠতে লাগলো সংসারের শূন্যতা। তবু কেউ কথা বললো না খাবার ঘরে। অনিমেষের কানের পাশে চুলে পাক ধরেছে, খোঁচা খোঁচা দাড়ির অনেকটাই সাদা, রোদে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সবিতার সর্বাঙ্গের যে বাধহীন স্রোতস্বিনী নদীর মতো যৌবণ একসময় চাতকের পিপাসার্ত কণ্ঠ অনন্তবর্ষীয় বারিধারায় ভিজিয়ে রেখেছে, সে শরীরের এখন ভর করেছে মাতৃমূর্তি। টানটান চামড়ার নিচে জমেছে মেদের আস্তরন, শাড়ির রঙ আর সিঁথির সিঁদুর বড্ড মলীন হয়ে এলেও অলিখিত কিছু নিয়ম থেকে গেছে অপরিবর্তীত।
পাশের ঘর থেকে জগ জলভর্তি করে এনে গ্লাসে জল ঢেলে অনিমেষের হাতে তুলে দিলো সবিতা। ততক্ষন নিজেকে সামলে নিয়েছে অনিমেষ। সবিতাকে সে এখনো কিছু বলেনি। কিছুদিন ধরে ব্যাপারগুলো কেমন নিয়মিত হয়ে গেছে। এখন জেগে থেকেও দৃশ্যগুলো স্পষ্ট দেখতে পায় সে। খাবারের গ্রাস মুখে তুলে দিতেই রাতারাতি বদলে গেলো সামনের দৃশ্যপট। একটা মলীন কাপড়ের ওপের রাখা পিতলের বাটিগুলো তার সামনে সাজানো, একদম স্পস্ট যেন ছুঁয়ে দেখা যায়। মুহুর্তের জন্য বাস্তবতা ও স্মৃতির মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো অনিমেষ। ঘরটা অচেনা তার। এই টেবিল, এই দেয়াল, আসবাব, চেয়ার, আসবাবের সাহেবী ঢং এসব অজানা তার। কিন্তু কি পরিষ্কার, স্বচ্ছ, স্পষ্ট । শ্বাস আটকে আসছিলো অনিমেষের, তবু সামলে নিতে চাইছিলো। একটা গ্লাস! একটু জল। হাতরাতে লাগলো সে। একটা হাত এগিয়ে দিলো পিতলের ঝকঝকে গ্লাসটা। হাতভর্তী সোনার গহনা, বাধাই করা শাখা। এ তো সবিতা নয়! কে? কে আপনি! তাকায় অনিমেষ। হ্যা, মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে তার, কিন্তু তবুও। এতো সবিতা নয়। কে আপনি! কথা বলে উঠতে চায় অনিমেষ, আটকে আসে শ্বাস। গ্লাসটাকে একরকম ওর হাতে চাপিয়ে দেয় হাতটা। মুহূর্তেই ভোজবাজির মত আবার পালটে যায় সব। এই তো সবিতা! উৎকণ্ঠিত মুখে তাকিয়ে আছে, একরকম হাতে তুলেক খাইয়ে দিতে চাচ্ছে জল। আরেক হাতে মৃদ্যু চাপড় দিচ্ছে ব্রহ্মতালুতে। ততক্ষনে অনেকটা সামলে নিয়েছে অনিমেষ। সবিতাকে খুব বলতে ইচ্ছে হয়, তুমি কই চলে গিয়েছিলে। জানো, এই দেখলাম তুমি নেই, আবার এই তুমি আছো। এসব কিচ্ছু ছিলো না। আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম? কিন্তু স্বপ্ন এতো বাস্তবিক ক্যানো হবে সবিতা? একটা মেয়ে। এইযে এইখানে! কোথায় দেখেছি মেয়েটাকে বলতো? অনিমেষ কিছু বলতে পারে না। কিংবা বলে না। এ বাড়িতে খাবার টেবিলে কেউ কথা বলে না। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় তার, বাবার সেই রাগী মুখ! আবার একরাশ গাম্ভীর্য্য ভর করে ওর মধ্যে। গ্লাসটা নামিয়ে রেখে খাবার দিকে মন দেয়। শুধু সবিতা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সবিতা এখনো জানে না কিসের এতো আতঙ্ক তার! ক্যানো এতো জড়তা?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


