রাহাত প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখে, একটা ব্যাটারি সে খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও। একটা পেন্সিল ব্যাটারি। কিসের ব্যাটারি, ক্যানো সে ব্যাটারি খুজবে স্বপ্নে! স্বপ্নে নিজের ছোট ছোট পাগুলো সে অনুভব করতে পারে। কত ছোট সে তখন? কত ছোট বেলা ছিলো সেটা যে একটা ব্যাটারি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা এতো গভীরভাবে দাগ কেটে গেছে স্মৃতিতে? ছোট মানুষের ছোট ছোট ব্যাপারগুলোতেও কি ভয়ানক মানবিক কষ্ট, ছোট চাওয়া পাওয়া নিয়েও কি ভয়ানক তীব্র অনুভূতি, এই বয়েসে এসে এ ধরনের স্বপ্ন দেখা বিরক্তিকর। তবু রাহাত দেখে। আজ যেমন দেখলো। অথচ গত রাতের এতোগুলো ভালো মূহুর্ত একবারো স্বপ্নে আসেনি। স্বপ্নে সে অনন্যার মুখটা একবারো দেখেনি। কিছুই তবে ভাববার মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না? এই যে এতোদিনের অপেক্ষার অবসান, এতোগুলো অনিশ্চিত দিন কাটিয়ে এসে পাশাপাশি নিশ্চিন্তে ঘুমানোর রাত, নিজের চোখে মুখে প্রিয় মানুষটার উষ্ণ প্রশ্বাস, শরীর লাগোয়া শরীরের এই অপার্থিব পুলোকের যে ধর্মতত্ত্বীয়ভাবে বৈধকরণ এসব কিছুই কি স্বপ্ন হওয়ার যোগ্যতা রাখে না? কি অদ্ভুত, অথচ এসব নিয়ে তো সে ভেবেছে কত রাত! কত রাত জীবনকে উলটে পালটে সাজিয়ে আবার শূন্যতে নিয়ে এসেছে সে, কত বিনিদ্র চন্দ্রভূক অন্ধকারের প্রহর সে কাটিয়েছে তীব্র যন্ত্রনায়। কই তখনও তো ঝিমুনীর মতো পড়ে সে একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখেনি! অনন্যার অশরিরী অবয়ব পাশে এসে বসে নি, মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বলেনি ধুর বোকা, স্বপ্নের পুরোটা সময় তো আমি তোমারই, আমাকে গ্রহন করো। না, এসব হয়নি, এমনকি বাজে স্বপ্নদোষের মতো ব্যাপারও না। বরং টুংটাং শব্দ এসেছে ঘুমের ভেতরে, একটা কিছু গড়িয়ে পড়লো টেবিলটা থেকে যেন। পরে গড়াতে গড়াতে চলে গেলো খাটের নিচে অন্ধকারে। রাহাত একটা ব্যাটারি খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যাটারিটা কি খাটের নিচে? সেখানে খোঁজা যায়না, ওটা নিষিদ্ধ জায়গা। ওখানে অন্ধকার, ওখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে গলাকাটারা। একটা হাত বেড়িয়ে আসবে যে কোন সময়, ওকে টেনে নিয়ে যাবে অন্ধকার গহ্বরে। এরপর কি হবে? রাহাত ভাবতে পারে না। ছটফট করে। দৌড়ায়, চিৎকার করে মাকে ডাকে বারবার। তবু কোন শব্দ বেরোয় না গলা থেকে, কিছু একটা আটকে থাকে গলায়, খসখস করে। চাপা গোঙানীর মতো আওয়াজ বেরোয়। কেউ আসেনা, রাহাত পালাতে থাকে। দূরে, অনেক দূরে, যেখানে খাটের নিচের অন্ধকার থেকে গলাকাটারা বেড়িয়ে আসতে পারবে না। তবুও অন্ধকারটা কাছে চলে আসে, রাহাত পেছোনে তাকায় না, কি জানি কি দেখে ফেলে! ছুটতে ছুটতে সে শুধু অনুভব করতে পারে, ব্যাটারিটা দরকার, একটা ব্যাটারি তার হারিয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাটারিটা পেলে সে কি করবে, কোথায় বসাবে সে জানে না। জানে না এটা ঠিক কতটা ছোটবেলার ভয়ানক স্মৃতি। শুধু একটা শব্দ আসে, একটা কিছু গড়িয়ে পড়ছে টেবিল থেকে, গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। গুড়গুড় আওয়াজ আসে। রিনিরিনি শব্দ। রিনিরিনি শব্দ ক্যানো! এই মিষ্টি টুংটাং শব্দ তার চেনা। শব্দটা যতই পরিষ্কার হয়, রাহাতের নিজেকে হালকা লাগতে থাকে, যেন একটা পাথর একটু একটু করে সরে যাচ্ছে তার দেহ থেকে। সে ভেসে উঠছে গ্যাস বেলুনের মতো একটু একটু করে। রিনিরিনি শব্দ, টুংটুং শব্দ। ঘুম ভেঙে যায় রাহাতের, মায়ের পরিচিত স্নিগ্ধ মুখে রাজ্যের উৎকন্ঠা। কিরে রাহাত, গোঙাচ্ছিলি ক্যানো? কোন খারাপ স্বপ্ন দেখলি বাবা? রাহাত কিছু বলে না, ওর ভালো লাগে মাকে দেখে। মনে হয়, এখন আর কোন ভয় নেই, এখন সে ঘুমাবে। মুহুর্তেই সব দুঃস্বপ্ন মুছে যায় মাথা থেকে, রাহাত মৃদ্যু হাসে। ঘুমিয়ে পড়ে ধীরে। এমন অনেক হয়েছে, ঘুম থেকে উঠে রাহাত ফোন করেছে অনন্যাকে, বলেছে জানো, আজকে তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম। অনন্যার মিষ্টি কন্ঠ ভেসে আসতো ওপাশ থেকে। সেই হাসি চাঙ্গা করে তুলতো তাকে, সে খুব শান্তভাবে একেরপর এক মুখরোচক গল্প বেধে ফেলতো স্বপ্নের নামে। এমন কত মিথ্যে স্বপ্ন অনন্যা গেঁথে রেখেছে মনে কে জানে! হয়তো ডায়েরীতে টুকে রেখেছে কিছুকিছু, উত্থান পতনের এই সম্পর্কে ছোট ছোট এসব টুকরো স্বপ্নের গল্পেরা দিন ভর ক্লান্তির শেষে একটা দমকা শীতল বাতাস হয়ে আসতো ওদের শহরের এপারওপারে। টেলিফোনে চাতকের মতো কান পেতে বসে থাকতো এই ক্ষুধার্ত দুটো মন একটু শীতল বাতাসের স্পর্শ পাওয়ার আশায়। তাই রাহাত কখনো বলেনি, অথচ স্বপ্নগুলো আসতো। অনন্যা কখনোই আসতো না, আসতো একটা ব্যাটারির নিখোঁজ সংবাদ। একটা পেন্সিল ব্যাটারী। গড়াগড়ি খাচ্ছে কোথাও একটা, রাহাত অনুভব করতো। খুব কাছে , অনেকটা কাছে।
অনন্যা তখনও গভীর ঘুমে, উপুর হয়ে শুয়ে। নিঃশ্বাসের তালেতালে ওঠানামা করছে ওর নগ্ন পিঠ, ভোরে এক আধটু আলো যা আসছে জানালার ফাঁক গলে, তাতে মেয়েটার তামাটে সোনালী ত্বক আরো হাজারগুন জেল্লা নিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠছে, আকর্ষণ করছে সমস্ত ইন্দ্রীয়কে, মোহিত করছে থেমে থেমে। রাহাতের একবার ইচ্ছে হলো ডেকে তোলে অনন্যাকে, তুলে বলে, জানো একটা স্বপ্ন দেখলাম। হ্যা, তুমিও ছিলে স্বপ্নে,কিন্তু সমস্যা করলো অন্য একটা জায়গায়। কিন্তু পরক্ষনেই ঘুমন্ত মেয়েটাকে তুলতে ইচ্ছে হয় না ওর। অনন্যা ঘুমিয়ে আছে একটা কলির মতো। টগর ফুলের কলি। ছোট বেলায় খুব ভোরে মাঝে মাঝে উঠে পড়তো রাহাত, বেশিরভাগ সময়েই দুঃস্বপ্ন গুলোর কারনে। মা তখন নামাজে বসে, রাহাত খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এগোতো, দরজার লাট তুলে বেড়িয়ে আসতো উঠোনে। টগরের ফুলেরা তখনও পুরোপুরি মেলে ধরতো না তাদের, নব্য যুবতী হয়ে হয়ে উঠতে থাকা দূরন্ত কিশোরীদের মতো সংকোচে লুকিয়ে রাখতে চাইতো ফূটে উঠতে শুরু করা বাহ্যিক সৌন্দর্য্যকে। আধবোজা পাপড়ি গুলো নিয়ে শিশিরসিক্ত কলিগুলো মুষড়ে থাকতো তাদের এই হঠাৎ দৈহিক পরিবর্তনটা মেনে নিতে না পেরে। রাহাত তখন চলে যেতো কলিগুলোর কাছে। তর্জনীর মাথা দিয়ে মৃদ্যু চাপ দিলেই ফুকগুলো সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ফেলতো নিজেদের, পাপড়িগুলো ছড়িয়ে দিতো যতদূর ছড়ানো যায়। নিজেকে তখন সুপিরিয়র মনে হতো রাহাতের, কতগুলো ফুটতে না পারা ফুলদের ফুটিয়ে দিয়ে যে ভালোলাগাটা কাজ করতো তার শৈশবে, সেটা চলে গেলো কিছুদিন পরেই যখন সে খেয়াল করলো জোর করে ফোটানো ফুল গুলো ঝড়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। কিছু ফুলের পাপড়ি ভেঙে যাচ্ছে। কিছু ফুলের শরীর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সেই নমনীয়তা, নাজুক স্নিগ্ধতা। বাদ বাকি ফুলগুলো সারাটা দিন ফুটে থাকতো মাথা নিচু করে, সূর্য্যের অসীম পবিত্রতার মুখোমুখি হতে পারতো না লজ্জায়। এই বোধটা যখন পুরোপুরি ভাবে বুঝে গিয়েছিলো রাহাত, তখন সে কৈশোর পেড়িয়ে যৌবণে পা দিচ্ছে দিচ্ছে প্রায়। তখন সে অনন্যার প্রেমে পাগল। তখন সে জানে, অনন্যা এই টগর ফুলের মতোই পবিত্র, নাজুক, কোমল। আজকে হঠাৎ আরেকবার অনন্যাকে দেখে রাহাতে মনে পরে গেলো টগরফুলের কথা। থাক, মেয়েটা নিজে থেকেই উঠুক, চোখে মুখে যখন এসে লাগবে ভোরের স্নিগ্ধ রোদ, আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে আলগোছে চাদরটা শরীরে জড়িয়ে নিয়ে অনন্যা মুখোমুখি হবে সূর্য্যের, এক আকাশ পবিত্রতা এসে জমা হবে ওর তামাটে সোনালী ত্বকে। এসব ভাবতে গিয়ে রাতের দুঃস্বপ্নের কথা ভুলে যায় রাহাত। একটা নতুন দিন এখন। একটা নতুন জীবন। তবে নতুন পৃথিবীটা নতুন স্মৃতিদের দিয়েই শুরু হোক। দুঃস্বপ্নেরা মিলিয়ে যাক শীতের কুয়াশার মতো। রোদের অদৃশ্য চাঁদর নেমে আসুক শহরে।
কিন্তু তবু কুয়াশারা যায় না। সন্ধ্যে হতেই হা-রে-রে-রে-রে ধ্বনী তুলে ঝাপিয়ে পড়ে কুয়াশার একরাশ বৈরাগ্য। প্রকৃতি তখন একে অপরের সাথে মিশে যেতে চায়, পাতারা লেপ্টে থাকতে চায় অন্য পাতায়, শরীর রা শরীরে; যেমন অনন্যা রাহাত। ভালোবাসার উষ্ণতা পরষ্পরকে ভিজিয়ে দেয় অবেলার বর্ষণে, স্মৃতির উপরে ওভাররাইট হতে থাকে নতুন নতুন সুখকর স্মৃতিরা। কামনায়, নেশায়, ভালোবাসায়, চূরান্তপুলকের উন্মাদনায় নিথর হয়ে থাকা শহরের বুকে ধীরে ধীরে নেমে আসে ভারী কালো রাত। নিভে যেতে থাকে শহুরে আলোর মশাল, ঘরে ঘরে লেগে আসে চোখের পাতা। ঘুমিয়ে পড়ে মনুষ্যের অরণ্য। শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে পায় রাহাত। কিছু একটা গড়াতে গড়াতে পড়লো টেবিল থেকে। গড়িয়ে যেতে থাকলো মেঝেতে। আস্তে আস্তে হারিয়ে গেলো খাটের নিচে, অন্ধকার গহ্বরে। রাহাতের অস্বস্তি বোধ হয়। দরদর করে ঘামতে থাকে শরীর। একটা ব্যাটারী হারিয়ে গেছে তার। একটা পেন্সিল ব্যাটারি। ছোট ছোট পায়ে সে আগায় অন্ধকারের দিকে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


