হাইড্রেঞ্জিয়া আমার খুব প্রিয় একটা ফুল। স্বচোক্ষে দেখার আগ থেকেই আমি খুব পছন্দ করি এই ফুলটা। প্রথমবার দেখি আমি উমিয়াম লেকের পাশে, রাস্তাঘেষা এক রেষ্টরেন্টের পাশে। একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে গিয়ে দেখলাম খুব অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছটা৷ আমি একবার খুব প্রিয় একজন মানুষকে নীল জ্যাকার্যান্ডা গাছ দেখিয়ে বলেছিলাম, ডাল ভর্তি এই নীল নীল ফুল গুলো আমি তোমাকে দিলাম। সে হেসেছিলো, বলেছিলো ছিঁড়ে এনে আমায় দিলেও তো পারতে। খুব সুখী সুখী মানুষদের দেখিয়ে যদি বলো এই সব সুখ তোমার, তবে আমি খুব সুখী হয়ে যাচ্ছি যেন! এর উত্তর আমার কাছে ছিলোনা সেদিন। আমি গাছ থেকে ফুল ছিড়ে এনে প্রেমিকার খোপায় পড়ানো লোকেদের দলে পরি না। তাই আমি প্রেমিকাহীনতায় ভুগেছি আজীবনকাল। আমি প্রিয়তমার হাত ভর্তি রাশিরাশি কৃষ্ণচুড়ার বদলে তার চোখে রক্তিম আভা দেখতে চাইবো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে। পাখিদের খাঁচায় ভর্তি করে খাদ্য পানিয়ের অবাধ স্বাধীনতা দেয়াকে আমি ঘেন্না করি। আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো সেদিন দুহাত ভরে ওই একগুচ্ছ হাইড্রেঞ্জিয়া তুলে নেই, এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি, এই ফুল গুলো তোমার। আমি নিয়েছিলাম হাতে। ছিড়ি নি। মনে মনে বলেছিলাম, আমাদের সব বন্ধ্যা জমিগুলো হাইড্রেঞ্জিয়া গুল্মে ভরে উঠুক। আমি প্রার্থনা করি, রাজপথ সোনালু ফুলে ফুলে হয়ে থাক, আমি সেই পথ ধরে একা হেটে যাবো, যতক্ষন দু-পায়ে কুলোয়।
একাকিত্ব ইদানিং বেশ আগ্রাসী হয়ে উঠেছে আমার ভেতরে। যতটা আগ্রাসী হয়ে উঠলে খুব বেশি দূর উড়তে পারবে না জেনেও খাঁচায় জন্মানো পাখিরা তীব্র আক্রোশে খাঁচা ভেঙ্গে দিতে চায়। আমি জানি আমার ডানায় জোর নেই, এক আকাশ সমান সীমানা আমার জন্য না। তবুও আমি খাঁচা আবদ্ধ পাখিদের কোলাহলের অর্থ বুঝতে পারি। আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় ওদের চিৎকারে। আমি জানি এই অফুরন্ত খাদ্যের জোগান ওদের কাছে অর্থহীন এখন। তবু ছেড়ে দিতে মায়া হয়। মানুষের ছেড়ে দিতে মায়া হয়। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে মানুষ কি দিয়ে তৈরী, আমি মুখ ফসকে বলে ফেলি, মায়া দিয়ে তৈরী। মাটি দিয়ে নয়।
নদী বিধৌত আমার এই জীবনে নদীর সবচেয়ে প্রিয় মূহুর্তটা হচ্ছে জোয়ার ও ভাটার মধ্যক্ষনটা। কি আশ্চর্য্য ভাবে এই উত্তাল নদীও শান্ত হয়ে আসে। কি ঔদাসিন্য! ওদের আর ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় না সাগরের বুকে। ওদের আর শক্তি নেই সাগর থেকে দূরে, আরো দূরে চলে যাওয়ার। ওরা একটু থিতু হয়৷ ভাবে। আমি ওদের ভাবনাটা টের পাই ইদানিং। আমিও থেমে আছি। বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আমার পেশিগুলো। মহাদেশীয় সম্প্রসারণ কেন পাহাড়ে এসেই থেমে যায়, আমি এখন বুঝি বোধহয়। লেপ্টে আসে সবুজের কার্পেট, পরজীবীর মত জন্মহয় কত জীবনের, পাহাড়ের ভ্রুক্ষেপ নেই। কোথাও কোথাও সমুদ্র এসে কড়া নাড়ে। ক্রমাগত আঘাতে খান খান হতে থাকে পাহাড়ের প্রস্তরসম ঔদাসিন্য, তবু কিছু বলে না। শুধু দিয়ে যায়। ঝর্ণার তীক্ষ্ণ ধারা রক্তক্ষরণ হয়ে নেমে আসে। ওটুকুই আশীর্বাদ আছে করার, ওরা করে যায়। আমার তো তাও নেই। আমি যে রিক্ত এখন। প্রিয় মানুষের জন্যে শুভকামনা জমাতে জমাতে কি বিশাল দেয়াল তৈরী করে ফেলেছি নিজের অজান্তেই, আমাকে কি দেখা যায়? আমাকে আর দেখতে পাও এখন?
আমি তবু চেষ্টা করি মাজে মাজে। ভীরের মধ্যে আমি খুঁজে ফিরি পরিচিত মুখাবয়ব। মেলে না, কত বিচিত্র মুখের আদল, সব অচেনা, সব অচেনা। তবু আমি খুঁজি। আমি খুঁজে পাই, শেষ বিকেলে বলাকারা কোথায় ফেঁরে, রঙধনুরা কোথায় গিয়ে মিশে যায়। তবু তোমাকে দেখি না। একরের পর একর জুড়ে বিরান প্রান্তর পরে থাকে, আমার প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে পৌছায়নি এখনো বোধহয়। এখনো কোথাও হাইড্রেঞ্জিয়া গুল্ম জন্মে ওঠে না। তবু আমি এই ফুলটাকে ভালোবাসি। হাইড্রেঞ্জিয়া আমার খুব প্রিয় একটা ফুল, তুমি জানোনা বোধহয়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


