somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঊর্মিলার শরীরে বেলী ফুলের গন্ধ?

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"তুমি ঠিক বুঝবে না মামুন। এই সম্পর্কগুলো এতো সহজ না। তোমার কাছে বেনামী ঠেকছে হয়তো। তবে বেনামী মানেই যে অবৈধ এমন তো কোন কথা নেই। আমি তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে কিছুই করিনি। এবং, সম্পর্কের গভীরতা এমনও নয় যা বলতে গিয়ে আমার কন্ঠস্বর কাঁপবে।"

আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। মিতু কখনো বলেনি এভাবে এর আগে। বরাবরই চুপচাপ ঘরানার এই মেয়েটা আজ বলছে। এবং এত অসাধারণ ভাবে গুছিয়ে বলছে, যে আমি সম্ভবত এই প্রথমবার সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি।

"দেখো মামুন, প্রতিটা সম্পর্ক এক একটা আলাদা রাস্তার মত। প্রতিটা মানুষ যেমন আলাদা, তাদের পছন্দ, চিন্তা, চেতনা, এপ্রোচ সবকিছুই আলাদা একে অপরের থেকে। ফলে তুমি যখন তাদের সাথে মিশবে, প্রত্যেকের সাথে একটা আলাদা ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠবে তোমার সাথে। আর এই সম্পর্ক গুলোর গঢ়ন ঠিক এতটাই আলাদা যে, একটাকে আরেকটা দিয়ে রিপ্লেস করা রীতিমত অসম্ভব। হ্যাঁ, সবটা হয়তো প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু সেই অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারটাই হয়তো অন্য রাস্তাটাতে অনুপস্থিত। আর হয়তো সেই অনুপস্থিতিটাই তোমাকে পোড়াবে। এই যে তুমি আমার হাজবেন্ড, আমাদের সম্পর্কের গভীরতা নিশ্চই আমার বান্ধুবীদের সাথে আমার যে সম্পর্ক সেটা দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ধরো, তুমি আমার জীবনের মহাসড়ক। আমাকে চলতেই হবে এ পথ ধরে, এটা আমার বাধ্যবাধকতা। এখানে সব আছে, চলার জন্য প্রয়োজনীয় সব, নিকাটবর্তী আবাসব্যবস্থা, ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাদ্য-বস্ত্র, শারিরীক ও মানসিক চাহিদার যোগান, সবই আছে এখানে। সাজানো গোছানো এই রাস্তাটায় জীবনের প্রতিটি উপাদান হয়তো ঠিকই আছে। কিন্তু নেই একটা ফুলের দোকান। রাস্তার পাশ জুড়ে অত্যাধুনিক অট্টালিকার পাহাড়ে আমার যখন দমবন্ধ হয়ে আসে, আমি একটু বেলী ফুলের গন্ধ নিতে আকুল হয়ে উঠি। আমি বেরিয়ে পরি রাস্তায়, পাগলের মতো ছোটাছুটি করি আশেপাশে চোরাগোপ্তা গলিগুলোতে। সেই ছোট্ট একটা ফুলের দোকান আমাকে জোগান দিয়েছে তনয়। আমি খুব হাঁপিয়ে উঠি যখন, একটা সুক্ষ বেলী ফুলের গন্ধ হয়ে তনয় আমার সামনে আসে। আমি কিছুক্ষনের জন্য বুদ হয়ে যাই। আমার রন্ধ্র হতে শিরায়-উপশিরায় ছড়িয়ে পরে সেই বেলী ফুলের সুবাস। আমি শান্ত হয়ে আসি ধীরে। আমি ছোট্ট ছোট্ট পায়ে আবার ফিরে আসি মহাসড়কে। বাড়ি ফিরে আসি। ধরো, ঠিক এতোটুকুই এতোটুকুই পার্থক্য এই দুটো সম্পর্কে। এখন যদি তুমি আমাকে প্রশ্ন করো, ওকে আমি ভালোবাসি কি না, উত্তর খুবই সহজ 'না'। যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো ওকি আমার বন্ধু? আমার ভাই? কি নাম এই সম্পর্কের, এর উত্তর আমার কাছে নেই। যদি বলো, ওকে কি এতটাই দরকার তোমার? আমার উত্তর 'না'। তুমি আমার প্রয়োজনীয়তা মামুন, ও আমার কাছে একটা অপূর্ণতার যোগান কেবল। একটা মাত্র ফুলের জন্য যে পুরো একটা বাগানকে অগ্রাহ্য করে, সে বোকা। আমাকে কি তোমাএ বোকা মনে হয়? আমি খুব ভালো ভাবে জানি আমার জীবনে তোমার প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবো, এই পথগুল্প ইরিপ্লেসবল মামুন। ওর পথটাতে যেমন আমি জীবন পাবো না, তেমন তোমার ঢালাও মহাসড়কে আমি কোনদিন ওই ছোট্ট ফুলের দোকানটা পাবো না, থরে থরে সাজানো বেলী ফুলের মালা পাবো না। এটা সম্ভব নয়। কেননা ওটাই তুমি, আর এটা ও। আর এই প্রয়োজনীয়তা, এই অপূর্ণতা, এটাই আমি"

আমি কিছু বলতে পারছিলাম না ঠিক। তবে আমি একটা নতুন মিতুকে আবিষ্কার করলাম আজ। এই মিতু আমাকে পথ চেনাতে গিয়ে খুব পরিচিত একটা পথের ধারনা দিয়ে দিলো অজান্তেই। আমি হারিয়ে গেলাম একটা মারাত্মক সুন্দর সন্ধ্যায়। একটা বৃষ্টিভেজা বিকেল অন্ধকার করে দিতে দিতে কখন রাত নামিয়ে দিলো গোটা শহরের ওপরে। রাস্তা পেড়িয়ে আসা মেয়েটার পরনের আকাশী পোশাক কাঁপছে বাতাসে। আমি সেই সন্ধ্যা মনে করতে পারলাম স্পষ্ট। আমরা হাটছি পুরোনো কালী মন্দিরের সামনে দিয়ে। আমরা বসে বসে শুনছি নামকীর্তন। বিধর্মী একদল মানুষ কি পরম ভক্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলছে গাইতে গাইতে। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার অবাক মুখ দেখে হাসছে মেয়েটা। এতোগুলো বছর পর আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম সেই মুখ। সেই মুখ আমি দেখি নাই আর। সেই সন্ধ্যার প্রতিটি মানুষ সাক্ষী আছে আমাদের নতুন পথে হারিয়ে যাওয়ার বেনামী যাত্রার। সেই সন্ধ্যা আমাকে রাজপথে হাটুগেড়ে বসিয়েছে। সেই সন্ধ্যায় আমি বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেছি নির্বিকার ল্যাম্পপোষ্টকে। তার খোপায় গোজা বাল্ব থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটে এসেছে বিন্দু বিন্দু রঙ্ধনু। আমি স্পর্শ করেছি সেই রং্ধনুদের। আমি স্পর্শ করতেই শিউরে উঠেছে নরম, খুব বরম একটা ত্বক। কেঁপে উঠেছে সেই শরীর, এতটা কাছে, একটা কাছে এসে আমি জানতে পেরেছি মানুষের প্রশ্বাস কতোটা উষ্ণ হতে পারে, মানুষের হৃদয় কতটা জোড়ে প্রকম্পিত হলে একটা মানুষ আরেকটা মানুষের হাত চেপে ধরে শক্ত করে। কতোটা কাছে এলে দুটো মানুষ কাদা হয়ে যায়, মিলেমিশে অনড় ভাষ্কর্য হয়ে থাকে মূহুর্তের পর মূহুর্ত। একটা পথ, একটা পথের ধারনা দিতে দিতে আমি আমার মহাসড়ককে যখন ভুলতে বসেছি, মিতু ওর হাতটা রাখলো আমার কাধে।

"... প্রণয় কবে প্রলয় হয়ে যাবে তুমি ভাবতেও পারবে না। এই, মামুন? তুমি শুনছো আমার কথা?"
"হ্যাঁ তো" কিছুটা চমকেই উঠলাম।

মিতু বললো এরপরও। অনেকক্ষণ। যা বুঝলাম, আমাদের সম্পর্কটা আসলে শেষ। সম্ভবত এটাই আমাদের একসাথে শেষ রাত। অন্য সময় হলে কি হতো আমি জানি না। আমি মিতুকে বোঝাতাম হয়তো। হয়তো কিছুটা শাসন করতাম। কিংবা আবেগী হয়ে ভেঙে পড়তাম, হাটুগেড়ে বসে পরতাম ওর সামনে, কোলে মাথা গুজে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতাম। কিংবা কাতর কন্ঠে ওকে বোঝাতাম কতটা ভালোবাসি আমি ওকে। কিন্তু তার কিছু করতে পারলাম না আমি। আমি টের পাচ্ছিলাম, মিতু জেগে আছে। পাশেই, অথচ ওকে আমি স্পর্শ পর্যন্ত করলাম না। হয়তো আমি ওর কোমড়ে হাত রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে পারতাম আমি জংলী হয়ে উঠেছি, আমাকে মানুষ করো। হয়ত আমি কাদামাটি হয়ে লেপ্টে যেতে পারতাম ওর শরীরে। হয়তো আমার রাস্তা, ওর রাস্তা মিলেমিশে বিশ্বরোড হয়ে চলে যেত অমৃতলোকে। তার কিছুই হলো না।

সারারাত আমরা জেগেই কাটালাম। ও ওর মতো করে। আমি আমার মতো। তবে পুরোটা রাত আমি কাটালাম এক অদ্ভুত স্বপ্নীল ঘোরে। ঘোর কাটলো যখন, তখন আমি নবায়ন আবাসিকে, দুই নাম্বার রোডের, সাত নাম্বার বাড়ির চার তালায় উত্তর পাশের দরজায়। আমার সামনে ঊর্মিলা দাঁড়িয়ে। ঊর্মিলার কপাল ভর্তি রক্তাভ সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। চোখ বাষ্পীভূত, মুখে অদ্ভুত বেদনাবিধুর হাসি। এর আগে কারো হাসি দেখে আমার কষ্ট হয়নি। আজ হচ্ছে। আমার বুকে ব্যথা হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার। আমি খুব সুক্ষ্ম একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম।
বেলী ফুলের গন্ধ?
ঊর্মিলার শরীরে বেলী ফুলের গন্ধ?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:১০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×