প্রিয় লি,
আমি পালিয়ে যাবো কোথায়? হাইজেনবার্গ তার দাম্পত্য জীবন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দৈবক্রমে অনিশ্চয়তা নীতি দিয়ে ফেলেছিলেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা কোয়ান্টাম ফিজিক্সে আটকে নেই। তুমি এখানেও নেই, ওখানেও নেই। তুমি কি আদৌ তবে ছিলে?
আমাদের জীবনে বৃহষ্পতিবারের প্রভাব সবার চেয়ে বেশি। বৃহষ্পতিবার আমার আনন্দের অতিশয্যে ঘুম আসে না, কিন্তু পুরো সপ্তাহ ধরে আমি একটা অসীম ঘুমের তীব্রতর আকাঙখা ও অপেক্ষা নিয়ে এই বৃহষ্পতিবারের অপেক্ষা করি। আমাদের জীবনে বৃহষ্পতিবার সেই যে এলো, আমি আর ঘুমোতে পারি না৷ আমি কি কি করিনি বলো? বৃহষ্পতির দোষ কাটাতে আমি অনামিকায় তোমার দেয়া আংটি খুলে ফেলে বসিয়েছিলাম পুষ্পরাগ মনি। রাগের জন্যেই কিনা, এরপর থেকে যতবার আমি তোমার কাছে ছুটে গিয়েছি ফুল হাতে, ফুলগুলো শুকিয়ে ঝড়ে গেছে মাঝ পথেই। ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন এই রত্ন ধারনে দুঃখ নাশ হয়। একটা চাঁদের দুঃখেই যেখানে পৃথিবী বারবার কান্নায় ফেঁপে উঠছে, ঊনসত্তরটা চাঁদের দুঃখ নিয়ে নিজের দুঃখ নাশ করার কথা ভাবতেও তো আমি পারি না।
প্রিয় লি, আমার মগজে বিষবাষ্প জমা হচ্ছে রোজ একটু একটু করে৷ দূর্গন্ধ পাচ্ছি কেবল আমিই। আমাকে শেষ কবে কেউ দেখেছে আমি জানি না। আমি শূন্যতার মতো অসীমায়তন দখল করেও অদৃশ্য সবার কাছে। আমি কথা বলি চিৎকার করে, যেমন চিৎকার করে প্রতিমূহুর্তে দু-দশটা নক্ষত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে রোজ৷ কেউ জানছে না। কেউ শুনছে না সেই চিৎকার। তারা খসার দুঃখ পৃথিবীর মানবিক ভাবধারার অভিধানে উল্লেখিত হয়নি কোনদিন। একটা তারা জ্বলে পুরে খাক হয়ে যাচ্ছে, আর তোমরা চোখ বন্ধ করে ব্যক্তিস্বার্থ কামনায় ব্যস্ত হয়ে উঠছো লি! আমি যেদিন জ্বলে পুড়ে যাবো, পুরো মহল্লা কি তখন বাসনাপূরণের প্রার্থনায় বুদ হয়ে থাকবে আমাকে উপেক্ষা করে? "তুমি তো জানো না কিছু।" হ্যাঁ, জীবনানন্দ দাশেরই কবিতা, ওই যে শুনিয়েছিলাম-
"সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল;
রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে
নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।"
তুমি বৃষ্টির দিনগুলো ভুলে গেছো লি? এই বৃষ্টি, এই নেই, ফ্যাকাশে সাদা রঙের আকাশ থেকে যে করুন আলো এসে থেমে আছে চারপাশে তা এক ধরনের আলস্যের সৃষ্টি করে। অনেকটা নীল রঙের পর্দাঢাকা টেবিল ল্যাম্পের আলোর সামনে গল্পের বই খুলে বসার মতো অনুভূতি, কেমন ঘুম পায় কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছা হয় না। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে একটানা। গতরাতের বৃষ্টিতে রাস্তায় এখানে সেখানে যে পানি জমে আছে তাতে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে আকাশ, মাথার উপরে যে পাখিটা ঊড়ে গেলো তার প্রতিবিম্ব ঊড়ে গেলো পায়ের নিচ থেকে। এ ধরনের আলোতে রাজপথে ছায়া পড়ে না। এই তো সেদিন, একাকী কিছুক্ষন ঘুরে ঘুরে ভাঙ্গা আকাশদের পাশ কাটিয়ে আসার পথে লাল ফ্রক পড়া মেয়েটা সঙ্গী হলো কিছুক্ষন, তারপর বায়ে মোর নিয়ে চলে গেলো। সুনীল গাঙ্গুলী পড়ছিলাম, লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ, লাল রঙের চটি, তার মধ্যে যমুনার কচি নিটোল শরীর। এতোগুলো লাল রাঙের মধ্যেও কোন আগুনের আভা নেই, এই হচ্ছে সুন্দর, যা দেখলে মন অবনত হয়! হয়তো বছর পাঁচেক পড়েই, এখন বলা যায়, "তুমি একটা ফুল নেবে খুকি?" রাজপথে একটুকরো ভাঙা আকাশে আমি যমুনার প্রতিবিম্ব দেখি, আমি আসলে ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করছি, আর হঠাৎ ভেসে ভেসে ভেসে উঠে জিজ্ঞেস করছি "একি! সুনীলদা! আপনি এখানে?"
বাসায় ফিরতেই জানালার কাঁচে আকাশ আরো কালো হয়ে এলে আমি বারান্দা লাগোয়া সোফায় শরীর এলিয়ে দিলাম। এ রকম পরিবেশ কেমন আলস্য জাগায়, ঘুম চলে আসে কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে হয় না, একটানা তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। আবার পালিয়ে যেতেও ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু কোথায় যাবো বলো লি? আমার জীবনে এখন বর্ষা ঋতু চলে এসেছে। টাপুর টুপুর শব্দ ছাপিয়ে রিনিরিনি শব্দ আমার মস্তিস্কে প্রতিধ্বনিত হয়। মগজের শিরস্ত্রান ভেদ করে একটা বোবা অসহায়ত্ব উঁকি দেয়, নাহ, তুমি নেই। তুমি হৃৎপিন্ডেও নেই। ধমনী ধরে ছড়িয়ে যাচ্ছিলে পুরো শরীরে, আমি একটা ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে তোমাকে মুক্ত করে দিলাম, মনে পড়ে লি?
তুমি জানো আমি পালাতে চাই।
আমি এখন জানি, তুমিও পালাতে চেয়েছো প্রতিটি মূহুর্ত, প্রতিটি দিন। তুমি মেঘের মতো ভাসতে ভাসতে চলে গেছো গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ বুকে নিয়ে। এরপর থেমে গেছো পাহাড়ে চূড়ায়, আমি সেই পাহাড়কে হিংসে করি। সত্যিই। কিন্তু আমি পালিয়ে যাবো কোথায়? আমাকে ধারন করবে এমন সমুদ্র কোথায়? বৃহষ্পতি গ্রহের হাইড্রোজেন-হিলিয়াম মেঘেও যেদিন বর্জ্রবৃষ্টি হবে, আমি সেদিন এই পুষ্পরাগ মনি খুলে ফেলে দেবো। অনামিকায় আবার ধারন করবো তোমাকে। এরপর বেড়িয়ে পড়বো পাহাড়ের খোঁজে। যেখানে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছো তুমি।
এ ধরনের মুষলধারা বৃষ্টিতে না ভিজলে পাপ হয়,
বৃষ্টিচ্ছাট বর্শার মত বুকে বিধে বিধে অন্তরশুদ্ধি ঘটায়। পবিত্রতা পাপবুদ্ধির সাথে মিশে ঘোলাটে বর্ণ ধারন করে জমে থাকে রাস্তায়। লাল ফ্রক পড়া সেই ছোট্ট মেয়েটি ছোটাছুটি করে সেই জলে৷ সময় পেলে বারান্দায় এসে দেখো, তোমার ভালো লাগবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


