খুব তথাকথিত একটি বাক্য দিয়ে শুরু করছি। আর তা হলো আমাদের মৌলিক চাহিদা। আমাদের পাচঁটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম। কিন্তু ‘খাদ্য’এর সাথে শুধু ‘নিরাপত্তা’ নয় ‘নিশ্চিত’ শব্দটি এখন গুরত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। পুরো বিশ্ব জুরে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চত করার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ আর বিশ্বনেতারাও এই বিষয়ে যথেষ্ঠ উদ্বিগ্ন। জলবায়ু পরিবর্তন এই নিরাপত্তাহীনতার একটি বড় কারন।
বাংলাদেশেও এই নিরাপত্তা ঝুকির মধ্যে রয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু জলবায়ু প্রভাব ছাড়াও দরিদ্রতা, দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত উর্ধ্বগতি, চাষযোগ্য জমির স্বল্পতা, জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা সাধারন মানুষকে কোনঠাসা করে রেখেছে। এর সাথে এই কথাটি অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আবাদযোগ্য কৃষিজমি ও খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া, কৃষিখাতে বিপুলসংখ্যক মৌসুমী বেকার রয়েছে। তাই বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জটিল সমীকরণে আবদ্ধ। যদিও সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ এ রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চত করা।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২ এর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ৬৬ হাজার ২৮৩ টাকা বা ৮৪৪ মার্কিন ডলার। এই হিসাবে দৈনিক গড় আয় ১৮১ টাকা ৬০ পয়সা। এই গড় আয়ের হিসাবের মধ্যে দেশের বিত্তশালীদের আয়ও রয়েছে। সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দৈনিক গড় আয় ১৮১ টাকা ৬০ পয়সার থেকে অনেক কম। মাসখানেক আগের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার জন্য আমরা দুই বন্ধু ঢাকার কয়েকটি বস্তিতে তথ্য সংগ্রত করতে গিয়ে জানতে পারি যে অধিকাংশ পুরুষ দিনমজুর হলেন রিকশাচালক আর নারীরা কোনো বাসায় কাজ করে অথবা গার্মেন্টস এ কর্মরত আছেন। তাদের প্রত্যেকদিন ৮০ থেকে ১০০ টাকা আয় হলেও তা নিশ্চত নয় সবার জন্য।
২০১২ সালের আগস্ট মাসের ১১ তারিখে একটি দৈনিকের প্রতিবেদন দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। পত্রিকাটিতে ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট নামের একটি সাময়িকী কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স শীর্ষক প্রতিবেদন এর কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, “খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বে সবার পেছনের কাতারে বাংলাদেশ। খাদ্য সহজলভ্যতার সূচকে বিশ্বের ১০৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ৮১তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ। এছাড়া প্রতিদিনের খাদ্য ঘাটতি, খাদ্য বৈচির্ত্র্যের অভাব, কৃষিখাতে কম বরাদ্দসহ ৮টি ঝুঁকির মধ্যে এদেশের মানুষ বসবাস করছে বলে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একজন মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনের তুলনায় ২৯০ কিলোক্যালরি কম পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে।”
২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ১৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারের এই ছোট একটি দেশে এই সংখ্যা অনেকটা ৯ নম্বর মহা বিপদ সঙ্কেত আমাদের সকলের জন্য। তাই সহজেই হিসাব করা যায় যে এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদনে পর্যাপ্ত জমির অভাব দেখা দিবে। আর এটা আমাদের দেশের জন্য একটি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ।
যে খাদ্য আমরা পাচ্ছি তাও অতিরিক্ত দাম আর বিষাক্ত কেমিকাল মিশ্রণের জন্য বেশিরভাগ সময় হাতের নাগালের বাইরে থেকে যায়। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, মে মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে। যার কারনে মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য সরবরাহের জন্যে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা’র পাশাপাশি বাংলাদেশও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে জাতীয় খাদ্য নীতি ২০০৬ ও কর্ম পরিকল্পনা ২০০৮-২০১৫ উল্লেখযোগ্য। এই নীতিগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্যের স্থায়ী সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, সর্বসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ও খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ এবং সবার জন্যে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। যদিও ইউনিসেফের এক রিপোর্টে প্রকাশ করা হয় যে দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ শিশু অপুষ্টির স্বীকার।
এখন কথা হলো যে, এই অবস্থায় আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে কাজে লেগে পড়তে হবে। আমার মনে হয় আর হতাশ হওয়ার বা এই ধরণের প্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ইস্যুটিকে সীমাবদ্ধ করে রাখলে চলবে না। এর জন্য দেশের সরকার সহ বিরোধী দলকেও এগিয়ে আসতে হবে। সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বন্ধ করতে হবে। তাহলে হয়তো সুদিন আসবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৫