somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাসির সন্ধানে

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চমকে উঠল রাতুল। অদ্ভুত এক হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। শব্দটা প্রথমে খুব কাছে থেকেই মনে হচ্ছিল। গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল। ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে আওয়াজটা। কান পেতে আবার শুনল সে। মনে হয় বাসা থেকে ৫০০ গজ দূরের ভুতুড়ে বাঁশঝাড় থেকেই আসছে শব্দটা। তড়িঘড়ি করে তার মাকে জাগিয়ে তুলল। ততক্ষণে আর শোনা যাচ্ছে না কিছু। কেরোসিন কুপি জ্বালিয়ে দিলেন মা। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত ১টা বাজে। অনেকখানি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। বাঁশঝাড়টা ভয়ানক জায়গা। লোকমুখে নানা ঘটনা শোনা যায়। ভুপেন ঠাকুরের ৮ বছরের ফুটফুটে এক ছেলে। কয়েকদিন আগে সেখান থেকে ভয়ানক এক আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। এরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর বাঁচানো যায়নি তাকে। সেলিমের দাদী একদিন ভরদুপুর বেলা খড়ি কুড়াতে যান সেখানে। সেই থেকেই বেচারির পাতলা পায়খানা ধরে। তিন দিনের মাথাতেই অক্কা পান। খোরশেদ অসুস্থ হয় সেখানে থেকেই। সন্ধ্যা বেলা ল্যাট্রিনে না গিয়ে বাঁশঝাড়ে ঢুকেছিল সে। তাতেই এমন অবস্থার শিকার হয়েছিল সে। নানা ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে রাতুলের আম্মার।
রাতুল এক বাপের এক ছেলে। ক্লাস ফোরে পড়ে সে। তার ছোট বোন রিয়া ক্লাস ওয়ানে পড়ে। দুরন্ত আর ছটফটে রাতুল পরিবারের সবারই আদরের ছেলে। দিনে হাজারটা আবদার করে বসে। পাখির ছানা ধরে দাও, ঘুড়ি বানিয়ে দাও, নাটাই আর সুতা কিনে দাও, ধনুক বানিয়ে দাও অথবা গুলতি বানিয়ে দাও। আবদারের শেষ নেই তার। নাজানি কোন সময় বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়েছিল সে। কথাটা মনে হতেই আঁতকে ওঠে তার মা। ঘুম আসে না কিছুতেই। এতক্ষণে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে রাতুল। মায়ের একপাশে শুয়ে আছে সে। অন্য পাশে রিয়া। রাতুলের আব্বা আবার কবিরাজ-টবিরাজ বিশ্বাস করেন না। আরো চিন্তায় পড়ে যায় মা। এই লোকটিকে কিভাবে বুঝানো যায় ভাবতে পারেন না। এমন সময় হুতুম পেঁচার ডাকে চমকে ওঠেন হঠাৎ করে। আবার শান্ত হয় প্রকৃতি। একসময় ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বই রেখে জায়গা করে নিয়েছে রাতুল। যে জায়গাটিতে সোহাগ বসে প্রতিদিন। জায়গা দখল করার অপমান সহ্য হয় না সোহাগের। বই সরিয়ে দেয় পেছনের বেঞ্চে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সুমন।
“বই কে সরিয়েছে?” জিজ্ঞস করে রাতুল।
সোহাগের কথা বলতেই সোহাগকে ধাক্কা দেয় রাতুল। সোহাগের শরীর রাতুলের চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম। উল্টা দ্বিগুণ জোরে রাতুলকে ধাক্কা দেয় সোহাগ। চিৎকার দিয়ে ওঠে রাতুল। অতঃপর চিৎ হয়ে পড়ে যায় বারান্দার নিচে।
কিন্তু না! সে আসলে পড়ে গেছে বিছানা থেকে। তার মা, দাদী এবং আব্বা সবাই চেঁচামেচি করে জড়ো হয়ে গেছে তার পাশে।
“চিৎকার করলে কেন? ভয় পেয়েছ নাকি?’’
‘‘বিছানা থেকে পড়ে গেলে কেন? ’’
‘‘কি হয়েছে তোমার?” সবাই জিজ্ঞেস করে তাকে।
“সোহাগ আমাকে ধাক্কা দিয়েছে” উত্তর দেয় রাতুল।
“সোহাগ আবার কোত্থেকে থেকে এল?” হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে তার দাদী এবং মা। রাতুলের আব্বার কাছে অনুরোধ করে, “ছেলের জন্য কবিরাজ নিয়ে আস, তার লক্ষণ ভাল না। রাত ১টার সময়ও সে বাঁশ বাগান থেকে ভূতের হাসি শুনতে পেয়েছে।” এ কথা শুনে দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে শুরু করল রাতুলের দাদী। ‘ভূতের হাসি’ শব্দটা এবং দাদীর কান্নার আওয়াজ বড় বিদঘুটে মনে হয় রাতুলের কাছে। ভয়ে চোখ ছানাবড়া করে তাকায়। আব্দুল জলিল বুঝতে না পেরে চিন্তা করতে থাকেন কী করা যায় ছেলের জন্য? ভূত বলতে তো কিছু নেই। মহিলা মানুষ অত সহজে বিশ্বাস করে না। রাতুলের মা এবং দাদীকে একটু সান্ত্বনাতো দিতেই হবে। অবশেষে তিনি ওঝা-কবিরাজ না এনে মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডাকেন। ইমাম সাহেব দোয়া-দরুদ পড়ে ঝাড়ফুঁক করলেন রাতুলের গায়। বাইরে বেশি খেলাধুলা না করার, সময়সময় পাক-সাফ থাকার এবং দোয়া-দরুদ পড়ে সব কাজ করার পরামর্শ দেন। আর এসব বিষয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এরপর সুস্থ হয় রাতুল। কিন্তু নজরদারির আওতায় পড়ে যায় সে। খেলাধুলা, দৌড়াদৌড়ি সবকিছুই বাড়ির ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে তার।
সামান্য কারণেই রাতুলকে স্কুল যেতে বারণ করেন পরিবারের লোকজন। এ জন্য লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ে সে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় বাজে রেজাল্ট করে। ছেলেকে নিয়ে নতুন ভাবনায় পড়তে হয় আব্দুল জলিলকে। ছোট একটি ফার্মেসির দোকান তাঁর। একজন বোন স্বামীর বাড়ি ছেড়ে ২ ছেলে ১ মেয়েসহ পরিবারের সদস্য হয়েছে। অপরদিকে দুই ভাই ও তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ যৌথ পরিবারে বাস করা। আশ্চর্যের বিষয় হলো আব্দুল জলিলের নানীর বয়স আনুমানিক ৯৫ বছর। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। চলাফেরায় তাকে কোন সাহায্য করার তো প্রয়োজনই নেই, বরং পরিবারের এক-তৃতীয়াংশ কাজের আঞ্জাম তিনি নিজেই দেন। সেদিক থেকে বলতে গেলে সুখের সংসারেই দিনাতিপাত করে পরিবারটি। কিন্তু ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে ভালো মানুষ করতে হবে। নইলে জীবনে সার্থকতা কোথায়? এসব নানা চিন্তা মাথায় আসে তার।
নীরব হয়ে দোকানে বসে আছেন আব্দুল জলিল। এমন সময় সালাম দিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়ায় নাহিদ। নাহিদের শিক্ষাজীবনের শুরু হয়েছিল আব্দুল জলিল মিয়ার হাতেই। বাড়ির সামনে ছোট একটি প্রশিকা স্কুল ছিল তার। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মাত্র একটি ব্যাচেই পড়িয়েছেন তিনি। নাহিদ তার স্কুলের ছাত্র ছিল। তাই তাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাতুলের সমস্যার কথা জানায় তাকে। মাত্র ১৫ দিন বন্ধের ছুটি কাটাতে বাসায় এসেছে নাহিদ। কিন্তু শিক্ষাগুরুর ছেলের কথা ভীষণভাবে উত্তেজিত করে তাকে। তাই যে কয়দিনই হোক তার পরিচর্যার ভার বহন করতেই হবে। রাতুলের সঙ্গে প্রাইভেটের সাথী হয় সুমন এবং সোহাগ। জড়তা, ভয় আর দ্বিধা কাটিয়ে পড়াশুনায় মনোযোগী হতে থাকে সবাই। রাতুল এবং সুমনের আব্বুকে মামা বলে ডাকে নাহিদ। তাই তারা তাকে স্যার না বলে ‘নাহিদ ভাইয়া’ বলেই সম্বোধন করে। একসময় তাদের সাথে গভীর মিতালি গড়ে ওঠে। এদিকে নাহিদের বড়ভাই আনন্দ রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালায়। নাহিদের পড়াশুনার খরচও বহন করে সে। মা অসুস্থতার জন্য নাহিদকে কিছুদিন দেরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলেন তিনি। প্রাইভেট পড়ার মেয়াদ বেড়ে গেল রাতুলদের। অন্য দিনের মতো বাজারে একটি ঘরে দালান তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন আনন্দ। রাজনৈতিক একটি মিছিল যাচ্ছিল বাজারের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে মিছিলটির। এদিক-সেদিক দৌড়াতে থাকে লোকজন। কিছুক্ষণ পর আসে অতিরিক্ত পুলিশ। শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান। নির্দিষ্ট লোক চিনতে না পেরে সাধারণ লোকদের গ্রেফতার করতে থাকে। অবশেষে রাজমিস্ত্রিদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের মাঝে আনন্দও গ্রেফতার হলেন। তিনি একটি হাতুড়ি নিয়ে ইট গাঁথার কাজ করছিলেন। কিন্তু তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার দেখানো হলো। অবশেষে রাতেও চলে আসামি এবং সন্দেহভাজনদের বাসায় তল্লাশি। আজ এ বাসায়, কাল হঠাৎ করে আরেক বাসায়। যুবক শ্রেণীর কাউকে পেলেই গ্রেফতার করে পুলিশ। ভাই গ্রেফতারের পর মায়ের চিকিৎসাসহ সংসার পরিচালনার সমস্ত ভার এসে পড়ে নাহিদের ওপর। কয়েক ব্যাচের প্রাইভেট ছাত্র নিতে হয় তাকে। অতঃপর অন্যান্য কাজও সামলাতে হয়। অথচ রাতে ঘুমাবার শান্তিটুকু পর্যন্ত নেই পুলিশ তল্লাশির ভয়ে। তিনদিন ধরে পড়তে আসছে না সজল। অন্য ছাত্রদের দিয়ে খোঁজ নেয় নাহিদ। সজলকে নাকি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না? হঠাৎ কিভাবে উধাও হয়ে গেল সে? কেউ বলতে পারছে না। গত দুই বছর আগে ভুতুড়ে সেই বাঁশঝাড়ের পাশে একটি ডোবা ছিল। সেখানে ৬ বছর বয়সী জিসান নামে এক শিশুর গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। কে বা কারা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল আজ পর্যন্ত তার কোন তথ্য বের করতে পারেনি কেউ। সময়ের ব্যবধানে হরিয়ে যায় ডোবাটি। এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
দিন পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে আসে। রাত ১১টা পর্যন্ত বাসায় অবস্থান করে নাহিদ। পরে বের হয়ে যায় বাইরে। তবে রাস্তায় বা রাস্তার আশপাশে থাকলেও ভয় আছে গ্রেফতারের। তাই খোদ বিলের মাঝে অথবা ফসলি জমির মাঠে নিঃশব্দে অবস্থান করতে হয়। কোন রকম আলো ছাড়াই বসে থাকতে হয় একা। মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শোনা যায়। তবে যত কষ্টই হোক খারাপ লাগে না নাহিদের। গ্রামের এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিনেও পাওয়া যায় না। গভীর অন্ধকার ঢেকে নিয়েছে চারপাশ। মনে পড়ে বিলের মাঝ দিয়ে রাতুলদের বাসার দিকে এগিয়ে গেলে কেমন হয়? এক-পা দু-পা করে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে নাহিদ। হঠাৎ শুনতে পায় ভুতুড়ে একটা হাসি। থমকে দাঁড়ায় সে। কিছুক্ষণ পর রাতুলদের বাসার কিছুটা হইচই কানে ভেসে আসে। মনোযোগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করে। রাতুল ও তার মা কান্না করছে।
রাত এখন রঙ পরিবর্তন করছে। কারণ চাঁদের অর্ধেক খন্ড কেবল আকাশে উঁকি দিচ্ছে। ভোরের আগেই বাসায় ফিরে নাহিদ। পরদিন রাতুল প্রাইভেট পড়তে আসে না। সুমনের কাছে জানতে পারে ভূতের হাসি শুনে তার জ্বর এসে গেছে। ব্যাপারটা কেমন সন্দেহজনক মনে হয় নাহিদের কাছে। সুমনের কাছে জানতে পারে তার দাদীকেও নাকি ভূতে আছর করে। আর মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন শব্দ ভেসে আসে ঐ ভুতুড়ে বাঁশঝাড় থেকে। মনে মনে কিছু পরিকল্পনা অঙ্কন করে নাহিদ। এগুলো বাস্তবায়ন না করে কাউকে কিছু বলবে না। সে এমন সিদ্ধান্তই নেয় কঠোরভাবে।
পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোতে খবর প্রকাশিত হয় দেশে ব্যাপক হারে শিশু গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অতএব সবার শিশুকেই সাবধানে এবং নজরে রাখার পরামর্শ আসে সরকারের পক্ষ থেকে। সজলদের বাসায় যায় নাহিদ। তার মা-বাবার সাথে কথা বলেন। গ্রামে ছেলেধরার (শিশু পাচারকারী) উপদ্রব বেড়ে গেছে বলে অনুমান করেন অনেকেই। কিছু লোক মনে করেন জিন-ভূতের আছর থেকেও এমনটা হতে পারে। ৫ বছর আগে গ্রামে আলেয়া নামে একটি মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিল না পরিবার। দুই দিন পার না হতেই কুড়ুমনদীর কিনারে একটি বড় ঝাড়ের ভেতর ড্রেন থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তাকে। নানা রকম কাল্পনিক তথ্য পেয়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না নাহিদ। অতঃপর রাতুলকে দেখতে যায়। রাতুলের অদ্ভুত শব্দ শোনার কথা বলছে সবাই। কিন্তু শব্দটা নাহিদও শুনেছে। শব্দটা কিসের হাসি বুঝাতে পারেনি তখনও। এসব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটানো নাহিদের অন্যতম দায়িত্ব।
‘আজ রাতে কিছু একটা হতে পারে। সবাই জেগে থেকে, মেসেজ পেলে সে অনুযায়ী কাজ করার অনুরোধ থাকলো সবার কাছে।’ প্রাইভেটে বাছাইকৃত ১৫ জন কিশোরকে জানিয়ে দেয় নাহিদ। রাত ১১টায় বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। রাতুলদের বাসাটা সোজা দক্ষিণ দিকে। কিন্তু সঠিক তথ্য উদঘাটন করতে সোজা পথে হাঁটা ঠিক হবে না। গ্রামের পশ্চিম দিকে করতোয়া নদী। সেটি উত্তর দিক থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে বরাবর চলে গেছে সামনে। কিছুদূর যেতেই কালিদহ ও করতোয়ার সংযোগস্থল। কালিদহ নামক ছোট্ট নদীটি করতোয়ার দিকে যেতেই সামনে পড়ে। দুই নদীর মাঝ বরাবর বিশাল চর। চরের মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকে নাহিদ। কিছুক্ষণ পর ফুরিয়ে যায় চরের সীমানা। এবার কালিদহ নদীর তীর বরাবর চলতে থাকে। কাশবন আর ছোটখাটো ঝোপঝাড়গুলো ভুতুড়ে পরিবেশটার শোভা বর্ধন করে দিয়েছে। ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছে নাহিদ। তার লক্ষ্য হলো ভুতুড়ে বাঁশঝাড়টায় উল্টা দিক থেকে ফলো করা। কিন্তু ঘড়িতে সময় কেবল ১২টা। এখন পুরোপুরি ঘনীভূত হয়নি রাতের প্রকৃতি। এমন সময় কেঁপে উঠল পকেটের মোবাইল ফোন। রিসিভ করতেই অন্য প্রান্ত থেকে কথা বলছিল সজলের আব্বু। অজানা এক নাম্বার থেকে কল এসেছে তার ফোনে। আজ রাতেই ৫০ হাজার টাকা চায় তারা। জগেশ্বর বাড়ির হিন্দু কবরস্থানের পাকা কবরটার দক্ষিণের জঙ্গলে জমা রাখতে হবে সেগুলো। ঘটনা অন্য কেউ জানলে খবর আছে। কোন ধরনের চালাকির আশ্রয় নিলে জীবিত পাওয়া যাবে না সজলকে। সময় মাত্র ৩ ঘন্টা। উপায়ান্তর না দেখে নাহিদকে ফোন দিয়েছে সজলের বাবা। অন্য কাউকে ব্যাপারটি না জানানোর পরামর্শ দেয় নাহিদ। বিশেষ করে সজলের মা যদি জানে অবস্থা বেগতিক হবে। মাত্র একটি ঘণ্টা চুপচাপ অপেক্ষা করতে বলে তাকে। এর মধ্যে কোন ফোনালাপ হবে না বরং অজানা নাম্বারটি মেসেজ করতে বলে ফোন কেটে দেয়। কয়েকটি গাছের ডাল আর লতাপাতা সংগ্রহ করল নাহিদ। অতঃপর পিঠের সাথে বেঁধে নিলো সেগুলো। শুয়ে পড়লো সরষে ক্ষেতের আলের ওপর। নিরাপদ সতর্কতা বজায় রাখতে মুক্তিযোদ্ধা স্টাইলে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। বাঁশঝাড় পানে এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে। বাঁশঝাড় থেকে নাহিদের দূরত্ব এখন মাত্র ৪০০ গজ। এবার শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে সে। এমন সময় দু’টি কালো ছায়া পূর্বদিক থেকে প্রবেশ করল বাঁশঝাড়ে। ফিসফিসিয়ে কথা বলার শব্দ হচ্ছে সেখানে। নিঃশব্দে মোবাইল বের করলো নাহিদ। অজানা নাম্বারটা মেসেজ করে পাঠিয়েছে সজলের বাবা। মোবাইলের আলো এক হাত দিয়ে চেপে ধরে কাজ করছিল সে। এবার কল দেয় সে নাম্বারটিতে। হঠাৎ বিদঘুটে ভূতের হাসি শোনা যায় বাঁশঝাড় থেকে। সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দেয়। ওদিকে রাতুলদের বাসা থেকে ভেসে আসে চিৎকারের আওয়াজ। কেঁপে ওঠে নাহিদের মোবাইল ফোন। অজানা নাম্বারটা থেকেই কল ব্যাক করেছে। রিসিভ করে কোন কথা বলছিল না সে। অন্য প্রান্ত থেকে গালি দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। কান থেকে সরিয়ে রাখল মোবাইল। এবার কথাগুলো ভেসে আসে বাঁশঝাড় থেকে। ব্যাপারটা বুঝে গেল নাহিদ। নাম্বারটা ব্ল্যাক লিস্টে রেখে দিল সে। আবার হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল সামনে। পরপর কয়েকবার ফোনটি কেঁপে ওঠে। ঘন একটি ঝোপের পাশে চলে যায় নাহিদ। সাবধানে ফোন চেক আপ করে। ৩ বার কল দিয়েছে সজলের আব্বু। সন্দেহ হয় নাহিদের। নিশ্চয়ই অজানা নাম্বারটি আবার ফোন দিয়েছিল।
‘আরো একটি ঘন্টা অপেক্ষা করুন, ঘটনার একটা সমাধান হবেই ইনশাআল্লাহ।’ মেসেজ পাঠিয়ে দেয় নাহিদ। বাঁশঝাড়টার একদম কাছাকাটি চলে এসেছে। ফিসফিসানি আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
“ছেলেটাকে আজ খাওয়ানো হয়েছে?” প্রশ্ন করে একটি কণ্ঠ।
‘‘না, তাকে অচেতন করে রাখা হয়েছে।” উত্তর দেয় অপর একটি কণ্ঠ। এরই মাঝে বিকট শব্দে ভেসে আসে ভূতের হাসি কিন্তু ওটা মোবাইলের রিংটন। ফোন রিসিভ করে সাঙ্কেতিকভাবে কথা শেষ করে দ্রুত কেটে দেয় কল। এবার কথা বলে একা একা। সম্ভবত অন্য কোন নাম্বারে কল দিয়েছে লোকটি।
‘আপনাকে আর মাত্র ২ ঘন্টা সময় বেঁধে দেয়া হলো, এর মধ্যে টাকা না পেলে লাশ হয়ে যাবে সজল।” গম্ভীর কণ্ঠে শেষ ঘোষণা দিল সে। জোনাকির আলোর মত ক্ষীণ এক টুকরা আলো দেখতে পায় নাহিদ। লোক দুটো চলে গেল বাঁশঝাড়ের আরো গভীরে। বিপরীত দিক থেকে ফলো করে নাহিদ। আলোটা সামনে এক কুয়োতে নিক্ষেপ হয়। সেখানে নেমে পড়ে লোক দু’টি। কুয়োর কাছাকাছি চলে যায় নাহিদ। কান লাগিয়ে দেয় মাটিতে।
‘ছেলেটাকে না জাগালে আবার মারা পড়বে নাতো?’ বলে ওঠে একটি কণ্ঠ।
‘এখন না জাগানোই ভালো হবে, একটু পরেই আমাদের ফাইনাল ডিসিশন হবে।’ আরেক কণ্ঠের জবাব।
‘আচ্ছা ওর পালস পরীক্ষা করে দেখি কেমন আছে?’
‘হ্যাঁ দেখতে পারো।’ বলাবলি করে দু’টি কণ্ঠ।
দূরে সরে আসে নাহিদ। এখানেই রাখা হয়েছে সজলকে। কোন ভুল নেই তার।
মোবাইলের মেসেজ অপশনে চলে যায় সে। টাইপ করতে থাকে দ্রুত। ‘এক ঘন্টার মধ্যে রাতুলদের বাসার পাশে ভুতুড়ে বাঁশঝাড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে একটি করে শক্তিশালী লাঠি নিয়ে হামাগুড়ি কায়দায় হাজির হয়ে যাও সবাই। সজলকে এখানেই বন্দি করে রাখা হয়েছে। ব্যাপারটি যেন অন্য কেউ না জানে। আমি এখানেই আছি। ইতি নাহিদ।’
এবার চটপট করে মার্ক করতে থাকে নাঈম, ইয়ানুর, রিদয়, আনিস, আয়নাল, জামাল, রায়হান, হাফিজ, ইমরান, মাসুদ, ফরিদ, আলী আকবর, নজরুল, হামজা এবং আরিফের নাম্বার। অতঃপর পাঠিয়ে দেয় দ্রুত। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যায় সবাই। একে একে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দেয় তাদের হাজির হওয়ার কথা।
‘নিঃশব্দে ঘেরাও করে ফেল বাঁশঝাড়টি, আমি যখন জোরে একটি চিৎকার দেবো একযোগে অ্যাকশন করতে হবে।’ আবারও সবাইকে মেসেজ করে নাহিদ। এবার ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে বাঁশঝাড় থেকে। উত্তর দিকে চলে যায় নাহিদ। দেখা হয় নাঈমের সাথে।
‘ভালোই হলো নাঈম’ ফিসফিসিয়ে বলে নাহিদ। এবার আয়নালের সাথে দেখা হয় তাদের। তিনজনে পরামর্শ করে তারা। ‘প্রথমে তিনজনেই সাবধানে কুয়োতে নামবে। তারপর আয়নাল ও নাঈম ঢুকে পড়বে গুহায়। তারা দাঁড়িয়ে যাবে দু’টি ফোকরে। আর নাহিদ চুপিচুপি সজলের অজ্ঞান দেহটাকে সরিয়ে নেবে। লোক দু’টি টের পেলে অ্যাকশনে যাবে নাঈম আর আয়নাল।’ পরামর্শ শেষ। এবার অভিযানের পালা। সুড়সুড় করে কুয়োতে নেমে গেল তিনজন কিশোর। দুইজন ঢুকে গেল ভেতরে। কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
এবার হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল কয়েকটি গাছের ডাল ও লতাপাতা। যেগুলো নিরাপত্তা দিচ্ছিল নাহিদকে। জোনাকি আলোটা সজলের দেহতে আলোকিত হলো। নাহ্! নরম কথায় কাজ হলো না, এক ঘন্টা পরে লাশ হতে হবে বেটাকে।’ ভেসে এলো একটা আওয়াজ। এরপর সরে গেল সেটা। এগিয়ে গেল নাহিদ। সজলের নিথর দেহটা কাঁধে তুলে নিলো। অতঃপর দাঁড়িয়ে গেল সে। নিঃশব্দে বের করে নিয়ে এলো কূপের মুখে। উঠে গেল উপরে।
মেসেজ অপশনে চলে গেল নাহিদ। ‘সজল উদ্ধার হয়ে গেছে আমি তাকে তার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা সবাই মিলে আটক কর লোক দু’টিকে। নাঈম ও আয়নাল গুহার ভেতরে থেকে চলে এসো। বাঁশঝাড়ের উত্তর কোণে সবাই জড়ো হয়ে একসঙ্গে আবার হামলা কর তাদের। চিৎকার দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই।’ পাঠিয়ে দিলো একযোগে সবার নাম্বারে।
কাজের সিস্টেমে ভুল হলো না কারো। জনগণের সামনে উপস্থিত করল ক্রিমিনালদের। একদল কিশোরের সাহসী পদক্ষেপে প্রশংসায় মেতে উঠলো গ্রামবাসী।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ২:২৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×