আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগের কথা। আমি তখন ক্লাস টু’তে পড়ি। ১৫ দিনের ছুটিতে বাবা বাড়িতে এসেছিলেন। যাই হোক প্রতিদিনের মত বাবা আমাকে আর আমার বোনকে স্কুলে যাবার জন্য রিক্সায় তুলে দিলেন। সেই দিন তার ছুটি শেষ ছিল। তাই তিনি কর্মস্থলে ফিরছিলেন। কিন্তু তিনি ফিরতে পারেননি কর্মস্থলে, ফিরেছিলেন লাশ হয়ে। সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি প্রান হারান। পরিবারে হাল ধরার মত তখন কেউই ছিল না। আমাদের ৪ ভাই বোনকে সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় পড়ালেখা করালেন আমার মা। আজকে আমরা ভাই বোন যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি তার জন্য আমার মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। ইনশা’আল্লাহ আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিবেন।
আমার ৪ ভাইবোনের মাঝে আমি সবার ছোট। তাই বাবার সংস্পর্শ আমি খুব কমই পেয়েছি, ছোট ছিলাম, অনেক কিছুই মনে নেই, অনেক কিছুই বুঝতাম না। তাই বাবার সাথে আমার স্মৃতি রোমন্থন করাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। মায়ের কাছ থেকে শুনেই বাবার স্মৃতিকে ধারন করার চেষ্টা করি। মা বলেন বাবা আমাকে খুব আদর করতেন, চাইতেন আমি যাতে পড়ালেখা করে ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারি। খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি, বাবাকে খুব বেশি সময় আমি কাছে পাইনি, সন্তান হিসেবে বাবার জন্য কিছু করার সুযোগটা আমি পাইনি।
যখন আমি ক্লাস এইট নাইনে পড়তাম তখন দেখতাম প্যারেন্টস ডে তে, অ্যানুয়াল প্রাইজ গিভিং ডে তে সবাই তাদের বাবাকে নিয়ে আসতো। আমি তখন একা আড়ালে চোখের জল বিসর্জন দিতাম। যখন দেখতাম আমার সহপাঠী বন্ধুদের তাদের বাবা অনেক কিছু গিফট করতো, তখন এক চাপা কষ্টে আমার হৃদয়ে অশান্ত ঝড় বয়ে যেত। বাবার অনুপস্থিতিতে আমাদের পুরো পরিবারটাকেই যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্! আল্লাহর অশেষ দয়ায় সেই কষ্টের দিনগুলো পার করে এসেছি।
আগে অনেক কষ্ট পেতাম, মনে হতো কেন আমার সাথেই এমন হল? এখন বুঝি সকলেরই মৃত্যু হবে, সবাইকেই চলে যেতে হবে আগে বা পরে, এটা মেনে নিতেই হবে। আজ আমি আর দুঃখিত নই যে বাবা আমাকে কোন গিফট দিতে পারেননি, আলহামদুলিল্লাহ্ আল্লাহ আমাকে অমূল্য এক পুরস্কারে পুরস্কৃত করেছেন, তাঁর হিদায়াত নসীব হবার তাওফিক দিয়েছেন। আজ আমি মর্মাহত নই যে বাবা আমার শিক্ষাজীবনের ভালো অর্জনগুলো দেখে যেতে পারেননি, আমি আশা করি আমি আমার পিতাকে আমার পরকালের জীবনের অর্জনগুলোর মাধ্যমে সম্মানিত করবো ইনশা’আল্লাহ, আমি আল্লাহর কাছে সেই দোয়া করি। আমি আজ আর বিষাদগ্রস্ত নই এ কারনে যে বাবার সংস্পর্শ আমি খুব বেশি পাইনি, আমি আশা করি পরকালে আমাদের নেক আমলের মাধ্যমে আমরা জান্নাতে মিলিত হব। আমি আজ আর আশাহত নই এই কারনে যে আমি বাবার জন্য কিছুই করার সুযোগ পাইনি, কারণ আমি জানি যদি আমি তার নেক সন্তান হতে পারি ও তার জন্য, তার নাজাতের জন্য দোয়া করি তবে তা সাদকা এ জারিয়া হিসেবে তার আমলনামায় লেখা হবে। তাই আমার কাছে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত বাবার জন্য কিছু করার সুযোগ নিয়ে উপস্থিত হয়, একটা বিশেষ দিন কখনই নয়, কোনভাবেই নয়..................
“ রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা ”
আল্লাহ আমার বাবাকে জান্নাতবাসি করুন তার সকল গুনাহ ক্ষমা করুন তাকে কবরের সকল আযাব থেকে রক্ষা করুন আমীন।
১৬ ই জুন ২০১৩
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৫ রাত ২:০৪