somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীলু’র ফিলোফোবিয়া

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নীলু’র ফিলোফোবিয়া

বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা, নীলু তখনও অঘোর ঘুমে ঘুমাচ্ছিল । হঠাৎ দরজার ঠক ঠক আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো নীলুর । অনিচ্ছাসত্বেও দরজা খুললো সে ।
“ কি বাবু এখনও ঘুমাচ্ছিস? ভার্সিটি যাবিনা? ”
নীলু বললো, "বাবা আজ শুক্রবার, তোমার মাথা ঠিক আছে তো?"
ঠিক কবে থেকে বড়ভাই ফাহিম হায়্দারকে বাবা ডাকে নীলুর সেটা মনে পড়েনা । তবে বোধহয় যখন সে কলেজে পড়ে তখন থেকেই ।
বাবা মা বড় ভাই হায়দার মিলে নীলুদের ছোট্ট সংসারটা বেশ ভালোই যাচ্ছিলো । তবে হঠাৎই নীলুর মা তার বাবার এক বিজনেস পার্টনারের সাথে প্রেমে পড়েন এবং আচমকা সংসার ছেড়ে দেন । ঘটনার মাত্র সাত দিনের মাথায় বাবা নেহাল হায়দার আত্মহত্যা করেন । মাথায় বাজ ভেঙ্গে পরে দুই ভাই বোনের । নীলু তখন ভিকারুন্নেসার প্রথম বর্ষের ছাত্রী ।
তার পাঁচ বছরের বড় ভাই হায়দার তখন ঢাকা মেডিক্যালের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র । বাবার বিজনেসটা তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী দখল করে নেন । শুধু থাকে তাদের ধানমন্ডির এই তিন তলা বাড়িটা । যার কারনে পথে বসতে হয়না দু ভাই বোনের ।
তার এই ভাইটাই বাবা মার স্নেহ দেন এই ছোট্ট বোনটাকে । আগে প্রায় মারামারি লেগে থাকলেও এই ঘটনা পুরোপুরি চেনজ করে দুজনের জীবন । এর পরে আর একটা দিনের জন্যও নাম ধরে ডাকেনি হায়দার তার এই বোনটাকে । ডেকেছেন বাবু বলে ।
‘কিছু বলবা’, জিজ্ঞাসা করে নীলু ।
“না মানে তোর সাথে একটা ইম্পরট্যান্ট কথা...”
“দেখ বাবা তোমার এইসব ঢং আমার একদমই ভালো লাগেনা ।“নীলুর কথার এই টোনেই ভয়ে চুপ হয়ে যান ডা: হায়দার ।
‘তুমি নাস্তা করেছ’
উত্তরে না বলেন ডা:
“তোমাকে না বলেছি আমার জন্য না খেয়ে ওয়েট করবেনা ।“ বেশ ধমক দিয়েই বলে নীলু.. “আচ্ছা ঠিক আছে দশটা মিনিট দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, তবে শর্ত হলো কোন ইম্পরট্যান্ট কথা বলা যাবেনা । আদার ওয়াইজ আমি উঠে যাব”|


দুই:

দেশের একটি সনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজম্যান্ট পড়ায় সহকারী অধ্যাপিকা আকাশনীলা হায়দার ওরফে নীলু ।আজ শুক্রবার তাই সারাদিন শুয়ে বসে বই পড়ে কাটানোর ইচ্ছে নীলুর । আর দু ঘন্টা ধরে গোসল । এটা নীলুর আয়েশ ।
বড় ভাই ডা: ফাহিম হায়দার দেশের নামকরা হার্ট সার্জন । বেশ নামডাক তার । আজ শুক্রবার, তাই উনার প্ল্যান সাইকেল করে ৫০ কিমি পাড়ি দেওয়া । কিন্তু আজ প্ল্যানটাকে স্থগিত রেখে বোনটাকে এই ইম্পরট্যান্ট কথাটা বলতে চায় ডাঃ । তাই প্রায় ভোর বেলা থেকেই পায়চারী করছেন হায়দার । এটা বুঝতে পেরে মেজাজটা তেতেই আছে নীলুর ।
আরও জোরে ধমক দেওয়া উচিৎ বাবাকে । একই প্রসঙ্গ নিয়ে সেই বাইশ বছর বয়স থেকে আজ নীলুর ছত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত শুনতে শুনতে কানটা ঝালাপালা । বেশ কয়েকবার তো বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো নীলু ।
দুপুরে আবারো বিশাল ঘুমদিলো নীলু । উঠলো প্রায় সন্ধ্যা সাতটায় । কিছুক্ষণ পড়ে বাবার রুমে দেখলো বাবা নেই । কাজের মেয়ে রেহানাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে ভাইয়া তো ছাদে ।
দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে নীলু । সেই মেডিকেল কলেজে থাকা কালে লীনা নামে এক ব্যাচমেটের সাথে গভীর প্রেম ছিল হায়দারের । কিন্তু তাদের জীবনে সেই ঘটনার পরে কেন জানি সম্পর্কটা ভেঙ্গে যায় । হায়দার এর কারন কখনও বলেনি নীলুকে । এরপর আর কোন সম্পর্কে জড়ায়নি হায়দার ।
ছাদে গেল নীলু, দেখে হায়দার এককোনে দোলনাটাতে বসে আছে । ভাইয়ের পাশে বসে নীলু । “বাবা বিকেলে চা খেয়েছ তো”!
মাথা ঝাকালে নীলু বলে, “দাড়াও তোমার জন্য আজ জটিল এককাপ চা আর সাথে কোপ্তা নিয়ে আসি”|
“দাড়া বাবু, বস না কিছুক্ষণ পাশে”|
‘বাবা কোন ইম্পরট্যান্ট কথা বলবেনা কিন্তু বলে দিলাম’, কড়া চোখে তাকায় নীলু |
‘না মানে বিয়ে সংক্রান্ত নয়’ |
‘তাহলে’, হালকা কৌতুহল দেখায় নীলু |

“শাহেলা চৌধুরী বেশ অসুস্থ, আমাদের হসপিটালেই ভর্তি হয়েছেন । হয়ত আর বেশীদিন বাঁচবেননা |আজ সকালে উনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন” |
শাহেলা চৌধুরী নামটা শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেল নীলুর । “বাবা তোমাকে না বলেছি কোন ইম্পরট্যান্ট কথা বলবেনা”|
শাহেলা চৌধুরী আসলে তাদের মায়ের নাম । এই নামটা মনেও আনতে চায়না নীলু । প্রায় ২০ বছর পরে হায়দার নীলুকে এই নামটা বললো ।
“তা এতদিন পর কি চায় মহিলা ? এখন মরতে বসেছে তাই”!
‘বাবু’ ধমকের স্বরে বলেন ডা: |
“তুমি আবার মা মা করে মুখের ফ্যানা তুলে ফেলনাই তো, তোমার তো আবার মেয়ে মানুষের মন । দেখতে যাওনাই !”
‘না মানে’, এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলনা হায়দার । আর দ্বিতীয় প্রসঙ্গে তো নয়ই ।

তিন :

আজ সাদাকালো সুতি শাড়ি পরে ভার্সিটি এসেছে নীলু । বেশির ভাগ সময়ই সে সাধারনত সালোয়ার কামিজ পরে পড়াতে আসে । তবে আজ হঠাৎ শাড়ি পরলো নীলু । দুপুর পর্যন্ত ক্লাশ, বিকাল পাঁচটা নাগাদ শেষ করে বাসায় ফিরে আসে নীলু । সে ইভিনিং ক্লাশগুলো কখনই নেয়না । কারন সন্ধ্যাটা আর রাতটা নিজের মত কাটাতেই পছন্দ করে নীলু ।
ভার্সিটি এসেই দেখা হলো তার ডিপার্টমেন্টের আরেক শিক্ষক নাইম আনন্দ এর সাথে । চোখে চোখ পরতেই হাই বললো নীলু । নীল এমনিতে খুব রিজার্ভ । কিন্তু নাইমের সাথে কিছুটা বন্ধুত্ব আছে নীলের । বছর দুয়েক আগে নীলকে প্রপোজ করেছিল নাইম ।
এজ ইউজুয়াল না করে দিয়েছিলো নীলু । পরে অবশ্য বিয়ে করে সংসারী হয় নাইম । আর নীল থেকে যায় যথারীতি একাকী ।
তবে নীল বন্ধুত্বটা অটুট রাখতে চেয়েছে সবসময়ই । লোকটা বেশ ভালোমানুষ । আসলেই বোকার মত প্রেমে পড়েছিলো । আর প্রেম ভালোবাসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই নীলুর ।
আকাশনীলা হায়দারের আরেকটি পরিচয় হলো সে ভালো ও নামকরা ব্লগার ও লেখিকা । তার লেখা বেশ কিছু আর্টিক্যাল নিয়মিত দেশের সনামধন্য ম্যাগাজিন আর পত্রিকাগুলোতে বের হয় । আকাশনীলা নামে লেখেন এই লেখিকা ।
তবে বেশীরভাগই সিরিয়াস সব ইস্যু নিয়ে লেখা । ভালোবাসার কোন ছিটে ফোঁটা নেই তাতে ।
বিকাল চারটায় ল্যাব থেকে ফেরার সময় নাইম জিজ্ঞাসা করলো, ‘কফি খাবেন’|
উত্তরে যথারীতি না সুচক মুচকি হাসি দিলো নীলু ।
আজ রাতে দি লাইব্রেরী অফ ঢাকা নামের একটা ম্যাগাজিনের জন্য লেখাটা কমপ্লিট করবে নীলু ।
তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরে একটা সময় কিছুটা নেশাগ্রস্থ হয়ে পরেছিল সে । বড়ভাই হায়দার বহুকষ্টে সামাল দেন সিচুয়েশান । তবে আরেকটি ফ্যাক্টরও কাজ করেছিল ।
রাতে ভাইয়ার রুমে গেলে নীলু দেখে হায়দার রুমে নেই, পরে ছাদে গিয়ে দেখে সেই দোলনাটায় বসে আছে সে ।
“বাবা, আজকে এত তাড়াতাড়ি ফিরেছ যে, কি হয়েছে তোমার ?”
না কিছু হয়নিতো, তোর লেখালেখির কি খবর ? আজ কি হয়েছে জানিস, এক রুগী অপারেশানের সময় হঠাৎ চোখ খুলে ফেলেছে, আর এটা দেখে নার্স দিয়েছে জোড়ে একটা চিৎকার ।
নীলু বুঝলো, বাবা কিছু একটা বলতে চায়, “কি বলবে বলতো বাবা, তুমি দুদিন হলো কেমন জানি ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলছো |”
হায়দার বললো, ‘সুইজারল্যান্ড যাবি ?’
“কে যাবে আর, নিশ্চয়ই কোন গাধা বন্ধুকে সাথে নিচ্ছ ?”
“না মানে একটা কনফারেন্সে যাচ্ছি, তবে সাথে যাচ্ছে যে সে গাধা না, সে বিখ্যাত ইন্টেলেক্ট । যাহোক তোর কি? তুই থাকবি তোর মত, আগামী মাসের তিন তারিখে যাব, তুই ছুটি পাবি কিনা দেখ , আমার এক বন্ধু আছে সেই সব ব্যাবস্থা করবে । আর এজেন্সী তো আছেই |”
“কালকে জানাই, তবে অন্যকোন মতলব নেই তো তোমার?”
বাবু বেয়াদবি করিসনা । আচ্ছা তুই কালকেই জানা । বেশী সময় নেই । ভিসা প্রসেসিং করতে দিতে হবে ।

চার :

রাতে বেশ ভালো ঘুম হলোনা নীলুর । দুটার দিকে টের পেয়ে গেলো সে, আর ঘুম আসতে চাইছিলনা তার । কফি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় গিয়ে বসলো সে । লেখাটাও শেষ করা হয়নি তার, ভাবছিলো তার সুদর্শন ভাইটা তার জন্য বিয়ে না করেই জীবনের অনেকটা সময় পার করে দিলো । নীলু আসলে কখনই তাকে নিয়ে ভাবেনি, স্বার্থপরের মত ভেবেছে নিজেকে নিয়ে । তার জন্য কত কিছুই না করেছে এই ভাইটা । সে না থাকলে কি যে হতো নীলুর । নেশার ঘোরে বাবাকে চড়ও মেরেছে নীলু । প্রত্যুত্তরে কখনও কিছু বলেনি ভাইটা ।
তার বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশী কিছু করতে পারতনা । আজ প্রায় দুই দশক ধরে মা যেভাবে বুকের ভিতর বাচ্চাকে আগলে রাখে ঠিক সেভাবেই নীলুকে আগলে রেখেছেন হায়দার ।
অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে দুজনের জীবনে । কিন্তু এই ভাইটা সব কিছু সামাল দিয়েছেন বটগাছের মত ।
ভাইয়ের রুমে উঁকি দিল নীল, বাচ্চাদের মত ঘুমায় ভাইয়া । কম্বলটা ঠিক করে দিল নীলু । হঠাৎ বাবার পায়ে হাত দেয় নীল । বাবার পা ছুয়ে বিড়বিড় করে নীলু বলে, “বাবা সাড়া জীবন তো আমার জন্য ভাবলে, এবার নিজের জন্য ভাব |”
যাওয়ার আগে চিরকুটে লিখে গেল, ‘বাবা আমি যাব |’




পাঁচ:

শাহেলার চৌধুরীর শরীরটা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছিল । আজ সকাল থেকেই নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল শাহেলার । হিসাব মত আর মাস খানেক আছেন উনি ।
গত দুদিন আগে ছেলে হায়দারকে ফোন দিয়েছিলেন । তারপর থেকেই ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন শাহেলা । কখন ফোন করবে হায়দার । আজ না আসলে দরকার হলে বাসায় যেতে চান তিনি ।
ফারহানকে বলেছেন আজ রাতে যেতে ওই বাসাটায় । কেমন আছে ওরা । কেমন আছে হায়দার ? কেমন আছে নীলু ? কিভাবে তিনি এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শাহেলা ভাবতে চাননা । চান শুধু মরে যাওয়ার আগে ওদের শেষ দেখা দেখে যেতে ।
ফারহান তার দ্বিতীয় পক্ষের একমাত্র সন্তান । সে কানাডায় পড়াশুনা করে । এসেছে উইন্টার ভ্যাকেশানে । এই ছেলেটা কেন জানি তার নিজের বাবার মত না হয়ে হয়েছে মি: হায়্দারের মত । চুপচাপ একাকী জীবন তার, ঠিক বাবার মত ডাইনামিক হয়নি ।
কি জানি এক অদ্ভুত আকর্ষন ছিলো লোকটির মাঝে । নাম ছিল জুনুন চৌধুরী । নামের মতই এক অসাধারণ জুনুন ছিলো লোকটার মাঝে । বাঙ্গালী মানুষের নাম জুনুন শুনেনি কখ্নও শাহেলা । ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্ট বাবার একমাত্র ছেলে জুনুন মডেলিং আর অভিনয়ও করতেন । এককথায় তেজ্বোদ্বীপ্ত সুপুরুষ ।
এই অপ্রতিরোধ্য জুনুনে নিজের সবকিছু হারিয়ে ফেলেন শাহেলা । যেন এক আচমকা প্রকান্ড ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া বাবুই পাখির বাসার মত |
শেষের দিকে তার জীবনে জুনুন ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার ছিলনা । বিয়ের তিন বছরের মাথায় জন্ম নেয় ফারহান । আর ঠিক সে বছরই লিভার ক্যান্সার হয় জুনুনের । অতিরিক্ত মদ্যপানই এর কারন হিসাবে উল্ল্যেখ করেন ডাক্তাররা । যখন মারা যান তখন ফারহানের বয়স ছিলো ১.৫ বছর । শাহেলা পাগলপ্রায় হয়ে যান । ফারহানকে মুলত তার দাদী নিয়ে যান কানাডায় । প্রায় দশবছর সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসার পর ভালো হন শাহেলা । জুনুনকে পেতে গিয়ে অনেক কিছুই হারাতে হয় তাকে ।
রাতে বুয়া এসে বলে “ভাইয়া আপনার কাছে কানাডা থাইক্যা ফারহান নামের এক লোক আসছেন , বলেন খুব জরুরী । আমি বসতে কইছি |”
হায়দার একটু বিরক্ত হয়, ভাবে চেনা নেই জানা নেই হুট করে এক লোককে ড্রয়িংরুমে বসতে দিয়ে দিলো, এদের বুদ্ধিসুদ্ধি হবেনা কখনও ।
“হ্যালো মাই নেম ইজ ফারহান, বেসিক্যালি আই এম সান অফ শাহেলা চৌধুরী । শি ইজ ইন হার লাষ্ট ফিউ ডেইজ । ইজ ইট পসিবল টু সি হার । আদারওয়াইজ শি উইল কাম হেয়ার বাই এনি মিনজ । এন্ড শি হ্যাজ গিভেন দিস প্যাকেট টু ইউ |”
ফারহান চলে গেলে প্যাকেটটা খুলে দেখে হায়দার । একটা কাগজে লেখা, "বাবা ফাহিম, তুমি আর নীল মা এর কাছে আমি ক্ষমা চাইনা, মেয়েদের জীবন বড় বিচিত্র, এটা অনেকে বুঝতে চায়না । আমি তোমাদের গর্ভধারীণী হিসেবে নয়, শুধু মৃত্যুপথযাত্রী হিসাবে বলতে চাই, একবার কি তোমরা আসবে ।"
নীলু ঘরে ঢুকলো, জিজ্ঞাসা করলো "বাবা কে এসেছিলো? কি হলো তুমি চুপ কেন বাবা "
দীর্ঘশ্বাস ফেললো হায়দার, বাড়িয়ে দিলো আরেকটি কাগজ ।
“আর অন্য প্যাকেটে তোমাদের আমানত, ব্যাবসাটি আমার বাবার ছিলো, সেটা বেচে তোমাদের দু ভাই বোনের জন্য ২কোটি টাকার চেক । আর আমার সম্পত্তির দলিল । যা তোমাদের হক |”


ছয়:

বিকালে কাজ শেষে ভাইয়ার চেম্বারে গেল নীলু । এসিট্যান্ট ডা: অত্রি বললেন “ডা: হায়দার তো ওয়ার্ডে গেছেন চলে আসবেন । আপনিতো নীলু । হায়দার ভাই বলেছেন আপনার কথা । তা আপনার জন্য কফি আনতে বলি |”
কিছুক্ষণের মাঝেই চলে এলো হায়্দার । এসেই বললো "কি কখন এসেছিস বাবু । ও হে পরিচয় করিয়ে দি সি ইজ ড: অত্রি, দ্যা মোস্ট ট্যালেন্টেড, আর ও আমার বাবু এজ আই টোল্ড ইউ ।"
দুজনে গেলো কেবিন নাম্বার ২০৫ এ, রুমের ভিতরে ঢুকতেই ফারহান তাদের নিয়ে গেল মায়ের বেডের কাছে ।
মাথার চুলগুলো পর্যন্ত উঠে গেছে শাহেলার । হায়দারের সাথে চোখাচোখি হতেই শাহেলা জিজ্ঞাসা করলেন "কেমন আছিস বাবা ফাহিম ? তোরা দেখতে এসেছিস আজ আমার মৃত্যু হলেও আপত্তি নেই ।"
হায়দার ভদ্রতাবশত: জিজ্ঞাসা করে "কেমন আছেন আপনি, আমার ডাঃ রবের সাথে কথা হয়েছে, ফারহান বললে নেক্সট মাসে ডাঃ রোহিত দিলওয়ালার আসার কথা আছে, তবে আমরা বললে উনি হয়ত এ মাসেই আসতে পারেন । দরকার হলে সিঙ্গাপুরেও নিয়ে যাওয়া যাবে ।"
শাহেলা বলেন , "মা নীল, আমার সাথে কথা বলতে চাসনা না? তোকে শাড়ীতে অনেক সুন্দর লাগছে ।"
নীলু কথা বলতে পারেনা, ওর ঠোট জড়িয়ে আসে ।
শাহেলা বিড়বিড় করে বলেন "আমি দশ বছর প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলাম । তোদের তিনজনের কারুকেই মায়ের আদর দিতে পারিনাই । এ যেন ইহলোকেই পরকালের শাস্তি । আর ডাঃ এনে কি হবে? তোরাই আমার ডাঃ আর তো আমার চাওয়ার কিছুই নেই ।"
হায়দারের হাত ধরে বলেন "বাবা ফাহিম, তোরা তোদের এই ছোট ভাইটার সাথে যোগাযোগ রাখিস । তার তো কোন দোষ নাই । কানাডা গেলে ওখানে যাস । আর মা নীল আমার মাথায় হাতটা রাখবি ?"
নীল হাত নড়াতে পারেনা । কেঁদে ফেলেন শাহেলা ।
বাসায় ফিরেই নীল দরজা লাগিয়ে দেয় জোড়ে, ডুকরে কাঁদতে শুরু সে । হায়দার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন বাবুর "মানুষের জীবনটা বড়ই অদ্ভুত ।"

সাত :

যথারীতি হায়দার দেরী করে রেডী হলেন । নীলু বেশ বিরক্ত । “বাবা আমি মেয়ে মানুষ হয়ে আধা ঘন্টায় রেডী হলাম । কি কর এতক্ষন ?”
যাহোক ঠিক শেষ মুহুর্তে প্লেনে উঠলেন তারা ।
বেশ কিছুক্ষণ আগেই এসেছে বন্ধু ডা: কারার ইশতিয়াক । পাশাপাশি তিন বিজনেস ক্লাস সিটে বসেছিলেন তারা ।
নীলুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল হায়দার । নীলু নীল রংয়ের ড্রেস পড়েছিল ।
আর বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে কারারের পরনে ছিলো ধবধবে হাফহাতা সাদা শার্ট আর জিন্স, হাতে ব্রেইসলেট, আর হাতে আঁকা সেই উল্কীটা সহজেই পরিলক্ষিত হয় ।
নীলু সাধারনত চুল বাঁধেনা, শ্যাম্পু করা ছাড়া চুল গুলো দুই গাল ঢেকে রেখেছিল ।
হঠাৎ ফারহানের ফোন আসলো, "হাই, মম ইজ নো মোর, শী পাসড এওয়ে জাস্ট নাও ।"
বেশ কিছুক্ষণ চুপ ছিলো হায়দার, পরে বললো " আওয়ার ফ্লাইট হ্যাজ টেকেন অফ, লাইন উইল বি ডিসকানেক্টেড উইদিন সেকেন্ডস, জাস্ট রিমেম্বার ইওর বিগ ব্রাদার হায়দার ইজ স্টীল এলাইভ, কাম টু মি হোয়েন এভার ইউ ওয়ান্ট টু ।"
চোখ দিয়ে পানি বের হলো হায়দারের । নীল জিজ্ঞাসা করলো "কি হয়েছে বাবা ?"
হায়দার বললো ‘মা’ |
গত বিশ বছরে এই প্রথম মা বললো হায়দার । নীলুও দীর্ঘশ্বাস ফেললো ।
তার্কিশ এয়ারলাইন্সের এই বোয়িংটা ইস্তাম্বুলে ১৯ ঘন্টার ব্রেক দেবে । তার্কীর ভিসা করা আছে তাদের ।
প্রায় সাড়ে দশ ঘন্টা পর আতাতুর্ক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করলো তারা । এর মাঝে খুব একটা কথা হয়নি তাদের । ডা: কারার বেশ কয়েকবার ইস্তান্বুলে এসেছেন, তাই মোটামুটি সবই চেনা তার । সময় খুব বেশী নাই ।
সুলতান আহমেদে অবস্থিত সুরা হাগিয়া হোটেলে ব্যাগ রেখে বের হলো তারা । প্রথমেই বসফরাস প্রণালীর পাড়ে স্ট্রীটফুড দিয়ে শুরু । শুরুতেই বালিক একমেক বা ফিশ স্যান্ডউইচ দিয়ে শুরু । যেহেতু নীলুর এটা খুব পছন্দ হলোনা, তাই কারার বললো, "আপনি মানে তুমি ডোনার কাবাব ট্রাই করো, ইটস ইয়াম্মী ।সরি তোমাকে ছোটবেলা থেকেই দেখছি তাই আপনি বলতে পারবনা ।"
এরপর বিকালের মধ্যেই টপক্যাপী প্যালেস আর হাগিয়া সোফিয়া মস্ক দেখলো তারা । কারার ফ্লুয়েন্ট ট্যুরিস্ট গাইডের মত বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলো ।
রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টিনের নামানুসারে ইস্তান্বুলের নাম ছিলো কন্সট্যান্টিনোপল, বলতে গেলে বিশ্বের রাজধানী ছিলো এটা, এরপর বাইজেনটাইন আর অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো এটা । এই শহরটা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বেশ জমজমাট শহর ছিলো ইস্তান্বুল । সিল্ক রুটের পথ ধরে এটা এশিয়াকে যুক্ত করেছে ইউরোপের সাথে ।
আর বসফরাস মর্মর সাগরকে যুক্ত করেছে কৃষ্ন সাগরের সাথে ।কিছুক্ষণ গ্রান্ড বাজারে ঘুরলো তারা । কারার নীলুকে বললো "নীলু ইউ শুড ট্রাই টার্কীশ ডিলাইট ।"
নীলুর শক্তভাবটা যায়নাই, সে ঠিক সহজ হতে পারছেনা ।সে আসলে বাবা অর্থাৎ হায়দার ছাড়া আর কোন ছেলে মানুষকে খুব একটা পছন্দ করেনা ।তবে তার্কীশ ডিলাইট খুব পছন্দ করলো সে । তারা কিছু প্যাকেট কিনেও রাখলো ।
আর রাতে তারা বসফরাস নাইট ক্রুইজ করবে বলে ঠিক করলো । নীলু বুঝলো কারার বেশ দক্ষ আর পটু ট্রাভেলার ।
রিভার ক্রুইজ টা ছিলো মাইন্ড ব্লোয়িং, হায়দার আর নীলুর পছন্দ হলো । ডিনার শেষে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে দশটা, বেশ হেকটিক দিন গেছে তাদের আর ভোরে ভোরে উঠতে হবে । তাই হায়দার বললো “Let’s call it a day.”
কারার বললো “তুই ঘুমাতে যা, Night is still young for me. নীলু তুমি অবশ্য যেতে পারো ।” নীলুর খুব যাওয়ার ইচ্ছে, তবে বাবা গেলোনা বলে সেও আর মুখ ফুটে বলতে পারলোনা । তাই অগত্যা কারার একাই বের হলো ।


আট:

পরের দিন বেশ ভোরে উঠতে হলো, ঠান্ডার বেশ কিছু কাপড় হাতে নিতে হলো । জুরিখ এয়ারপোর্টে পৌছুতে প্রায় ২ ঘন্টা বিশ মিনিট লাগলো । তারা বি২ বুটিক হোটেল এন্ড স্পাতে উঠেছে । বেশ চমৎকার হোটেল এইটা । এই হোটেলটা সিলেক্ট করেছে কারার । করার পেছনে অনেক গুলো কারনের একটি হচ্ছে এটির বিখ্যাত ওয়াইন লাইব্রেরী, না শুধু ওয়াইন না, ৩০ হাজারেরও বেশি বই আছে এই লাইব্রেরীতে । নীলু বই লেখতে আর পড়তে পছন্দ করে । তাই এই হোটেলটিতে ওঠা । হায়দার অবশ্য সেমিনার আর ট্রেনিংয়ে এসেছে । যা এই হোটেলের খুব কাছে ।
“B2 is a philosophy combining the concepts of ‘Bookmark’ and ‘Boutique’: unmistakably unique hotels at unusual locations with exceptional stories, memorable like a very good book.”
এই অসম্ভব সুন্দর ডেসক্রিপশানটাই এই হোটেলটিকে সিলেক্ট করার প্রধান কারন ।


আসলে হায়দারের এই বন্ধু ডা: কারার ইশতিয়াক একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট । পড়াশুনা করেছে মেরীল্যান্ডের জন হপকিন্স স্কুল অফ মেডিসিনে । এটা সাইকিয়াট্রি পড়াশুনায় ওয়ার্ল্ডের বেষ্ট স্কুলগুলোর একটি । এখানে পি, এইচ, ডি ও করে কারার । এরপর অধ্যাপনা করেছে মিন্নেসোটা মেডিক্যাল স্কুলের সাইকিয়াট্রি বিভাগে । পারিবারিক কারনে দেশে প্রত্যাবর্তন গেল বছর । কাকতালীয়ভাবে তার পি, এইচ, ডি থিসিস ফিলোবোয়িয়া নিয়ে ।
তার দেশে প্রত্যাবর্তনের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো বিয়ে করা । ক্যারিয়ার এম্বিশান আর বিভিন্ন পারিবারিক কারনে বিয়ে করা হয়নি কারারের । যাহোক বন্ধু হায়দারের অনেক রিকুয়েস্টে সব কাজ ফেলে এসেছে সে ।
না উদ্দেশ্য নীলুকে বিয়ে করা নয় । উদ্দেশ্য একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট হিসাবে নীলুকে বোঝা । তাই বিগত ২০ দিন তার কেস স্টাডি পড়েছে কারার ।
সেদিন হোটেলে পৌছুনোর পর লান্চ করলো তারা, হায়দারের একটু জ্বর জ্বর লাগছিল । ইদানীং প্রায়ই তার এটা হয় । বিশেষ করে রাতে জ্বর জ্বর লাগে, নিজে ডাক্তার হলেও ডায়াগনোসিস করানো হয়নি তার বহুদিন, যদিও সে বিনা খরচে বাংলাদেশের যেকোন জায়গায়ই ডায়াগনোসিস করাতে পারে । নীলুর যথারীতি শাওয়ার নিতে নিতে দুই ঘন্টা সময় লাগলো । বিকেলের দিকে বের হলো তারা ।
হায়দার বললো “আজ একসাথে বের হতে পারছি, কিন্তু কাল তোদের দুজনকে বের হতে হবে । আমার ট্রেনিং কাল সকাল থেকে শুরু হচ্ছে । তবে At Night I can attend. কারার এই হোটেলটা সিলেক্ট করেছে । কিছু না করলেও হোটেলেই কাটিয়ে দিতে পারবি ।”
হোটেল আসলেই বেশ পছন্দ হয়েছে নীলুর । বিশেষ করে লাইব্রেরীটা । আজ রাতেই বই নেবে ঠিক করেছে । ওয়াইন খাওয়া ছেড়েছে সে বহুকাল । তবে এই শীতে ওয়াইন আর বিয়ার আকর্ষন করছে বেশ ।
জুরিখে এখন তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সে: রাতে তা মাইনাস ১ পর্যন্ত নামবে, কারার তার আইফোন দেখছিলো । বেশ খানিকটা তুষারপাত হয়েছে বিগত দুই রাতে । তবে আজরাতে তাপমাত্রা একটু বেশী হবে । জুরিখ বেশ এক্স্পেন্সিভ একটা জায়গা । খুবই খরচের সবকিছু ।তবে কারার আর হায়দারের জন্য কিছ নয়, আর নীলুও কম যায় কিসে ।
আজ তার পদব্রজেই সফর করবে আশেপাশের এলাকা । পুরো জুরিখটাই একটা পিকচারাস্ক জায়গা । কারার ট্যুরিস্ট গাইডের মত বর্ণনা দিযে যাচ্ছিলো । প্রথম প্রথম একটু বিরক্ত হলেও পরে খুব একটা খারাপ লাগছিলোনা নীলুর । কারন লোকটার বলার মধ্যে বেশ একটা সাবলীল ভাব ছিলো । আর ইনফরমেটিভও ছিলো বেশ ।
প্রচন্ড শীত, ঠান্ডার কাপড়ের স্তূপ পড়তে হয়েছিলো সবাইকে । কারার বললো ‘হাটতে সমস্যা নেই তো নীলু’। নীলু না সুচক মাথা নাড়লো ।
তারা লিমাত নদীর পাড় দিয়ে হাটলো বহুক্ষণ । অসম্ভব সুন্দর লিমাত নদীর পাশের ওয়াক ওয়েটা । বেশ কিছু স্ট্রীট ফুড ট্রাই করা হলো । চকলেট আর কফির জন্য বিখ্যাত এই জুরিখ | তবে হায়দার লিমাতস্ট্রাসে ট্রিট কেইস নামে এক বিখ্যাত চীজের দোকানে নিয়ে গেল তাদের । প্রায় কয়েকশ চীজের ভ্যারাইটি আছে এতে ।
ঠান্ডা আবহাওয়ায় সুন্দর রাস্তায় হাটতে বেশ ভালো লাগছিলো । আর নীলচে রংয়ের লিমাত নদীর পানি আর লিমাতস্ট্রাসের প্রাণোবন্ত প্রমেনাড সবকিছু মিলিয়ে এককথায় অসাধারন লাগছিলো নীলুর ।
পরে তারা লিমাতস্ট্রাসেই মার্কথালে নামের এক বিখ্যাত সী ফুড রেস্টুরেন্টে ডিনার করে । কারার প্রথমে সী ফুড প্লেটার অর্ডার করে । এটাতে বেশ কিছু আইটেমের সাথে শামুক আর অক্টোপাস ছিলো, তা দেখে নীলুর বমি করে দেওয়ার মত অবস্থা ।
তাই তার জন্য ফিশ ফিলেট অর্ডার দেওয়া হয় । এ রাতে ডিনার করে তারা ধীরে ধীরে হোটেলে ব্যাক করে । হায়দার জিজ্ঞাসা করে কাল তোমরা কোথাও যাচ্ছ ।
নীলু হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে, “তোমাকে ছাড়া আমি যাবনা”|
হায়দার ধমক দিলো, “গাধা জুরিখে এসে কি হোটেলে সময় কাটাবি নাকি? আর আমি পারলে সন্ধ্যায় জয়েন করবো “|
কারার বললো, "কাল আমাদের ভোর সাতটায় উঠতে হবে, কাল যাব সপ্নের জায়গা মাউন্ট তিতলিস । হায়দার তুইও চল । ট্রেনিং করে কি করবি? "
হোটেলে গিয়ে লাইব্রেরীতে গিয়ে বসলো তারা । কারার দুইটি বই বেছে দিলো নীলুকে । গত বছরের নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার দুটি বই । একটি হলো দ্যা মিসড ট্রেইন । গল্পটা প্রেমের । এটিতে এক যুবক তার জীবনের মিসড কিছু প্রেমকাহিনী ব্যাখ্যা করে । আর অন্যটা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ।
কারার বলে, নীলু আমার মনে হয় তোমার এগুলো ভালো লাগবে , এনি ওয়ে তুমি এগুলো আগে পড় নাইতো ?
তুমি পড়তে থাক, আমি এদের ওয়াইন ট্রাই করি, হায়দার তোর জন্য কি আনবো ? নীলু কি খাও এসব ?
নীলু বলে ছেড়ে দিয়েছি ।

নয় :

পরের দিন সকাল সকাল বের হতে হলো তাদের । ট্রেন ধরে যেতে হবে এনগেলবার্গ । ট্রেন জার্নিটা এককথায় অসাধারণ । কারার জিজ্ঞাসা করলো "কি ঘুম ভালো হয়েছে । রাতে কি বই পড়েছিলে ।"
নীলু খালি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিচ্ছিলো । সে আসলে কি বলে সম্মোধন করবে তা বুঝে পাচ্ছিলো না । তার বড় ভাইয়ের বন্ধু তাই ভাইয়া বলা উচিৎ। কিন্তু সে এই কয়েকদিন কোন সম্মোধন না করেই কাটিয়েছে । ট্রেনে তাদের পাশে বসেছে এক সুইডিশ দম্পতি । কারার অল্প কিছুক্ষণেই গল্প জমিয়ে ফেললো ।
বয়স্ক দুইজন দম্পতি জোকস বলা শুরু করলো, আর লিড দিলো কারার । নীলু স্বভাবতই চুপ করে ছিলো । কারার বললো "বাইরের সিনগুলো মিস করোনা ।" ‘
সবুজ, নীল লাল রংয়ের সমারোহ । "তোমার কি রং পছন্দ ।" নীলু বললো নীল । নীলু সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলো, আপনার কি রং পছন্দ । না জিজ্ঞাসা করা হলোনা তার । কারন হেজিটেশান ।
এনগেলবার্গে আসতে তাদের প্রায় আড়াই ঘন্টা সময় লাগলো । এখান এসে কারার বললো "নীলু আমরা এখন ক্যাবল কারে উঠবো, আসলে পরপর তিনটি ক্যাবল কার ।"
নীলু বললো "কক্ষনই না, আমি ক্যাবল কারে উঠবোনা । আপনি আগে বললে কখনই আসতামনা ।"
কারার হেসে বললো, "নীল স্বর্গে যেতে হলে যেমন পুলসিরাত পার হতে হয়, আর এখানে তো শুধু তিনটি ক্যাবল কার পার হতে হবে । ওপাড়ে কিন্তু রিয়েলি ভুস্বর্গ ।"
ক্যাবল কারে উঠার পর চলা শুরু হলে নীলু চোখ বন্ধ করে ফেলে, আর জোরে কারারের হাত চেপে ধরে । কারার বুঝে যায় মেয়েটার এক্রোফোবিয়া আছে । ফিলোফোবিয়াতো আছেই ।
কিছুক্ষণ পরে কারার নীলুর কানে আস্তে অস্তে বলে, "নীল দেখ বাইরে অসম্ভব সুন্দর, চোখ খোল ।"
নীলু সম্বিত ফিরে পায়, আর সম্বিত ফিরে পেয়েই হাত ছেড়ে দেয় । বাইরে তাকিয়ে আল্পস পর্বতের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখতে পায় নীলু ।

সুইস আলপসের মনোরম সৌন্দর্যে আসলেই ভালো লাগছিলো নীলুর । কারার বললো দেখ কিভাবে দৃশ্যপট চেনজ হয়ে যাচ্ছে । যতই উপড়ে উঠছি ততই কালার চেনজ হচ্ছে । যদিও ক্যাবল কারের ভিতর এয়ার টাইট, কিন্তু তবুও ঠান্ডা লাগছিলো নীলুর ।
"কি নীলু এখনো ভয় লাগছে?"
না বললো নীলু । উপড়ে গেলে পাগলই হয়ে যাবে তুমি । দ্বিতীয়টাতে আর ভয় পাচ্ছিলনা নীলু । আর শেষ যে গন্ডোলাটাতে উঠেছিলো তারা, সেটা ছিলো রোটেটিং গন্ডোলা । দৃশ্যপটও পরিবর্তীত হচ্ছিলো । সুন্দর থেকে সুন্দরতর হচ্ছিলো বাইরের দৃশ্যগুলো ।
রোটেটিং হওয়ার কারনে প্রায় ৩৬০ ডিগ্রী পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো । কারার বললো, " ঊপড়ে প্রায় -৯ ডিগ্রী তাপমাত্রা, বুঝেছ নীলু ।"
চারিদিকে নীলাভ আকাশের মাঝে বরফাচ্ছন্ন সাদা পাহাড় । কারার ফিল করলো নীলু তার প্রায় গাঁ ঘেষে দাড়িয়েছে । মাথা থেকে ক্যাপ খুলে ফেললো নীলু, চুল গুলো যথারীতি ছাড়া । খোলা চুলে ভালোই লাগছে মেয়েটিকে, তবে পিছনে চুল বাঁধলে আরো ভালো লাগতো, ভাবলো কারার ।
সামিট স্টেশানে নামলো তারা । নীলু এই প্রথম জিজ্ঞাসা করলো, " আপনি বোধহয় আগেও এসেছেন " ।
"হ্যা, দিস ইজ দ্যা সেকেন্ড টাইম ফর মি, বাট আই এম নট লেস এক্সাইটেড দ্যান দ্যা নিউ কামারস, এই স্বর্গে বারবার আসা যায় ।"
চলো তোমাকে প্রথমে তিতলিস ক্লিফ ওয়াকে নিয়ে যাই, ধবধবে সাদা বরফ আর সচ্ছ নীল আকাশ, নীলুর জীবনে দেখা শ্রেস্ঠ জায়গা এটা । খুব ঠান্ডা হলেও মজাই লাগছিলো দুজনের । পাশাপাশি হাটতেও ভালো লাগছিলো তাদের ।

"কি ভয় কেটেছে? তোমারটা হলো এক্রোফোবিয়া । আমার কি ভয় আছে জানো, আমি ফ্যানের নীচে ঘুমাতে ভয় পাই, সিভিয়ার ভয় ।যাহোক কেমন লাগছে জায়গাটা ।"
"দ্যা বেস্ট প্লেস আই হ্যাভ এভার ভিজিটেড । "
"এই দেখো কালকে তুমি আসতেই চাচ্ছিলে না । ক্লিফ ওয়েতে গেলে আরও ভালো লাগবে”|
ধন্যবাদ সুচক মাথা নাড়ালো নীলু । কারার এখানকার ভূপ্রাকৃতিক গঠনশৈলী, আবহাওয়া সম্মন্ধে বলছিলো ।
ক্লিফ ওয়েটা দেখে নীলু বললো, "ভাইয়া, আমি উঠবোনা । আমার ভীষণ ভ্য় লাগছে ।"
কারার বললো, ভরসা রাখো নীলু, একটু গেলে দেখবে ভয় ভেঙ্গে গেছে, আর স্বর্গে যেতে হলে..."
বলে কিছুক্ষণ দাড়ালো তারা, বললো “তোমার ভয় ভাঙলে তারপরেই যেয়ো “|
খুব সাহস নিয়ে উঠলো নীলু । নীলু নিচে তাকিয়ে শক্ত হয়ে গেলো, আগাতেও পারছিলোনা, পিছাতেও না ।
"হাতটা ধরো নীলু ।"
বলে মোটামুটি জোড় করেই হাত টান দিলো কারার । "সামনে তাকিয়ে হাটো, আমি আছি সাথে । " আগাতে থাকলো নীলু, তবে ভয় কাটছিলোনা । কারার সাইডের মনোহর দৃশ্য দেখতে বললো, "এটা আসলেই স্বর্গ "
হাত ধরেই ছিলো কারার । এই ক্লিফ ওয়েটাকে ইউরোপের সর্বোচ্চ ক্লিফ ওয়ে বলা হয় । আর এক্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত একটি মেয়ে ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক ।
আস্তে আস্তে ভয় কাটছিলো নীলুর । জায়গাগুলো আসলেই মনোমুগ্ধকর । না আসলে আসলেই মিস করা হতো ।
"তোমার কি করতে সবচেয়ে ভালো লাগে? "
নীলু বললো, "চিন্তা করে দেখিনি", পরে বললো " মনে হয় লেখতে আর শাওয়ার নিতে ।" বলতে বেশ ইতস্তত করলো সে ।
হায়দার বললো "ঠিক আছে, তবে সেই ভাবেই একদিন প্ল্যান করবো, ও আর একটা কথা, তুমি যখন ভয় পাবে তখন, ভালো সময়ের কথা চিন্তা করবে । আর এরপর থেকে এইদিনটার কথাও মনে করবে । "
"কফি খাবা নাকি, অবশ্য লান্চও করা দরকার, না লান্চটা না হয় স্কীয়িংয়ের পরেই খাই । চলো কফি খাই ।"
"না, আমি আসলে কফি কমই খাই, আর লান্চের আগে তো নয়ই ।"
কারার বললো, "শোন নীলু, একেবারেই ঢং করবেনা, আমি ঢং একেবারেই পছন্দ করিনা । আর আজকেতো একদমই না, কি খাবা কন্টিনেন্টাল রিফ্রেশমেন্ট নাকি ইন্ডিয়ান ?"
পুরো সুইজারল্যান্ডই বিখ্যাত কফি, চকলেট আর ব্রেড আইটেমের জন্য । আর চিজ আর ওয়াইন তো দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি ।
একটা খোলা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো তারা । নীল আকাশ আর সাদা বরফের মাঝখানে এই খোলা রেস্টুরেন্টটার পাতানো বেন্চে বসলো দুজনে । কারারের টয়লেট চেপেছিলো ।
সে নীলুকে বললো "এই ফ্রেশ রুমে যাবানা ।" নীলু হ্যা সুচক মাথা নাড়লো । "তোমাদের মত ঢং করা মেয়েদের নিয়ে এই সমস্যা ।"
"খালি দ্বিধা, মুখ ফুটে বললেই তো হয় ।"
কফি খেতে খেতে কারার বললো "তোমার ছাত্ররা ডিসটার্ব করেনা? মানে, তোমার মত সুন্দরী টীচার, কিছু ছেলেদের তো প্রেমে পড়ে যাওয়ার কথা ।"
নীলু বললো " আমি ও ভাবে কখনও চিন্তা করিনি । আর প্রেম বা ভালোবাসা নিয়ে ভেবে সময় নস্ট করার সময় আমার নেই ।"
"আজকে জায়গাটা আমার দেখা সেরা জায়গাগুলোর একটা হলো এটা, আচ্ছা তোমার ড্রীম ডেসটিনেশানের নামে বলতো কয়েকটা ।"
নীলু চেপে গেলো, গলার কাছাকাছি এসেও কথাগুলো আটকে গেলো । এটা প্রায়ই হয় তার, অনেক কথাই মুখ ফুটে বলতে পারেনা সে । হেজিটেশান হয় সবসময়ই ।
কারার বললো " আমার অনেকগুলো ড্রীম ডেসটিনেশানের মধ্যে স্পেস স্টেশান একটা ।"
“তবে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই সেখানে । “
নীলু বললো " কেন আমাকে কেন ?"
একটু থতমত খেয়ে গেলো কারার " না মানে তোমার একাকী থাকার শখ কিছুটা পুরণ হবে, তবে লেখাটা একটু কষ্টই হবে । আর তোমার আঢ়ষ্টভাবটা কেটে যাবে । কারন প্রাইভেসি বলে কিছুই থাকবেনা ।" বলেই হেসে ফেললো কারার ।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো তারা । প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করছিলো তারা । নীলু বললো, ‘আপনি কি করেন ‘।
কারার বললো " আমি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স স্কুল অফ মেডিসিন থেকে পাশ করে সেখানেই অন্য একটি বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়িয়েছি বহুদিন । দেশে এসেছি কিছুদিন হলো । যাহোক চলো স্কীয়েংয়ে যাই ।"
“ইদানীং তুমি কি নিয়ে লেখালিখি করছো?”
“এখন দুটো বিষয় নিয়ে লিখছি, একটি হলো ইংরেজী ম্যাগাজিন দ্যা উইমেন এর জন্য ইন্টারপ্রেনিয়ার দের নিয়ে আর একটি হলো একটি ইন্টারন্যাশনাল জার্নালের জন্য । আর নিয়মিত একটা অনলাইন পত্রিকার কিছু সম্পাদনা তো আছেই ।“
“ভেরী গুড, ঠিক আছে তোমার কিছু লেখা আমি পড়বো । হায়দার বলছিলো তুমি একটা এন, জি, ও এর সাথেও যুক্ত |”
হ্যা সুচক মাথা নাড়লো নীল ।
নীল স্কীয়িংয়ে যেতে আসলেই ভয় পাচ্ছিল । তাই কারার বললো, না ভয় পাবার কিছু নেই, আমরা আসলে টিউবে বসে স্কী করবো, অর্থাৎ স্নো টিউবিং করবো । দুইটা টিউব পাশাপাশি বেঁধে যাব, তাই তোমার ভয়ের কিছুই নেই ।
বেশ ভালোই লাগলো এই টিউবে স্লাইডিং করে নীচে নামতে, প্রথমে বেশ ভয়ই পেয়েছিলো তারা । সারাটা দিন চমৎকার কাটলো, হয়তো ভার্সিটিতে মুনিমের সাথে কাটানো সময়গুলোর পর তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দের দিন । অবশ্য মুনিম নামটা মনেও করতে চায়না আর নীলু ।
এনগেলবারে ফিরে তারা লান্চ করলো । রুমে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা । ফিরেই হায়দারের রুমে টোকা দিয়ে দেখে হায়দার ঘুম থেকে উঠেছে ।
কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে ।

দশ:

বাবা তোমার তো জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে । কি খেয়েছ? অসুধ খেয়েছ? ফোন দাওনি কেন? দাড়াও আমি কারার ভাইকে বলছি ।
হায়দার বহুদিন পরে বোনের চোখে সত্যিকারের খুশী ভাব দেখতে পেলো, "দাড়া দাড়া পাগলী, এতগুলা প্রশ্ন একসাথে করলে কি উত্তর দিব, শোন আমি তোর আজকের আনন্দ নস্ট করতে চাইনি ।“
কারার এসে জ্বর দেখলো, ১০৩ ডিগ্রী । "তোর জ্বর কখন থেকে?"
হায়দার ইশারায় নীলুকে বললো কিছুক্ষণ বাইরে যাওয়ার জন্য । "গত দুমাস ধরেই রাতে ৯৯ থেকে ১০০ ডিগ্রী জ্বর আসছে, তবে চেক করানো হয়নি । নীলু এসব জানলে কান্নাকাটি করবে । তাই গাধীটাকে বাইরে যেতে বললাম ।"
"আর আর একটা কথা, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু খারাপ একটা হয়েছে, তবে যাই হোক তুই আমার মেয়েটাকে সামলাস । আমি ছাড়া বোকাটার কেউ নাই ।"
নীলু এসে হায়দারকে বললো, “কাল তোমার ট্রেনিংয়ে যাওয়ার দরকার নেই, আর আমরাও কোথাও যাচ্ছিনা |”
নীলু বললো, "বাবা তুমি শোও, আমি আজ রাতে এখানেই থাকছি, তোমার পাশে ।"
কারার বললো " ঠিক আছে আমিও এই সোফাটায় থাকছি, তবে একটা জিনিস, আমি নীচ থেকে একটা ভদকার অর্ডার দিয়ে আসছি, আর তার আগে তোর জন্য ঔষধ নিয়ে আসি ।"
হায়্দার হেসে বললো, “যা করবি নিজেদের রুমে গিয়ে কর বাবুরা, আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও । আর কালকে সকালে যদি জ্বর কম থাকে তাহলে আমি ট্রেনিংয়ে যাচ্ছি । তোমরা তোমাদের কালকের সফরের প্ল্যান করো ।"
অগত্যা নিজের রুমেই গ্লাস নিয়ে বসতে হলো কারারকে ।
নীলু শুয়ে আজকের সারাদিনের কথাই মনে করছিল ।
আজ সারাদিন বেশ আনন্দেই কাটিয়েছে তারা, কিন্তু বাবার হঠাৎ এত জ্বর ।
রাতে নীলু একটু আজব একটা সপ্ন দেখলো, দেখলো সে প্লেন থেকে পড়ে যাচ্ছে, হঠাৎ একটা হাত তার হাত ধরলো, বললো ভয় পাচ্ছ কেন? প্যারাসুটটা খোল । বুঝলো তারা স্কাই ডাইভিং করছিলো ।
অন্যদিকে কারার একটা জেলেন্ট (Xellent) বোতল নিয়ে গ্লাসে সিপ দিতে দিতে অনেক রাত পর্যন্ত নীলুর কেস হিস্ট্রি পড়ছিলো ।


এগারো:

কেইস হিস্ট্রিটা মুলত হায়দারের দেওয়া । হায়দারদের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ট্রাজিক ঘটনাটার পর নীলু মানষিকভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে পরে, পড়াশুনাও প্রায় ছেড়ে দেয়, কলেজে একটা বছর ড্রপ দিতে হয় তাকে ।
হিউজ ডিপ্রেশান থেকে মুক্তি পেতে একটা সময় নেশাগ্রস্থও হয়ে পড়ে সে । পাড়ার কিছু খারাপ সঙ্গে মিশে এটা শুরু হয় তার । সে বছরটা খুব কস্টে কেটেছে হায়দারদের । উপায়ন্তর না দেখে একটা মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করাতে হয় তাকে ।
দেশের সেরা গার্লস কলেজের ছাত্রীকে কিনা ভর্তি করাতে হচ্ছে মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে, এতটাই ভয়াবহ ছিলো সিচুয়েশান । সে মেয়েকে সুস্থ করতে সময় লাগে প্রায় ছয় । বাবা বেঁচে থাকলেও এতটা করতে পারতেন কিনা সন্দেহ । মাসের পর মাস নির্ঘুম রাত পার করতে হয়েছে হায়দারকে । এক বছর নষ্ট হয়েছে নিজের পড়াশুনার ও । সাত বছরের গভীর প্রেমকে বিদায় জানাতে হয়েছে ।
প্রায় একবছর খানের পর নীলুকে আবারও কলেজে ভর্তি করানো, কলেজ শিক্ষকরাও বেশ হেল্প করেন । কারন নীলু এস, এস, সি তে স্ট্যান্ড করা ছাত্রী ছিলো ।
ইন্টারে বেশ ভালোই রেজাল্ট করে সে, তাই ভার্সিটিতে চান্স পেতে বেশী বেগ পেতে হয়না নীলুর । হায়দারেরও ইন্টার্নশীপ শুরু হয়েছে । সবকিছু যেন তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাচ্ছিলো । তবে এসব কিছুর জন্য টনিক হিসাবে কাজ করছিলো মুনিম নামে নীলুর এক ব্যাচ মেটের সাথে নীলুর বন্ধুত্ব । হ্যা মুনিম জামান ছিলো ছেলেটির নাম । দেখতে প্রায় ছয় ফিট লম্বা ।
তাদের বন্ধুত্ব কখন ভালোবাসায় গড়ায় তা বুঝতেই পারেনি নীলু । অন্ধের মতো ভালোবাসতে শুরু করে সে । পুরো ভার্সিটিতে তাদের জুটির প্রশংসা শোনা যেত ।
তবে কোন একটা কারনে তাদের ভালোবাসার সম্পর্কটা ভেঙ্গে যায় সেকেন্ড ইয়ারে । এবার আরও দ্বিগুন ভাবে ভেঙ্গে পরে নীলু ।
তবে এবার আর নেশাগ্রস্থ হয়না সে । এবার হয়ে যায় একাকী । হায়দার ছাড়া কোন ছেলেমানূষকে সহ্য করতে পারেনা সে । বিভিন্ন কারনে সম্পর্ক নষ্ট করে অনেকের সাথেই । রাগ, কান্না, জেদ সবকিছুই বেড়ে যায় তার ।
কারার তার দ্বিতীয় সিপটা মুখে নেয় । রাত প্রায় দুটো । ঘুম ধরছেনা কিছুতেই । হঠাৎ দরজায় নক ।
নীলু বলে, "Sorry to disturb you at late night, ভাইয়ার জ্বরটা বোধহয় আরও বেড়েছে । একটু আসবেন । আর সেকি আপনি এখনো জেগে আছেন?"
জ্বর ১০৫ । জ্ব্ররের প্রকোপে ভুল বকছে হায়দার । কারার হায়দারকে কোলে তুলে বাথরুমে নিয়ে এসেই মাথায় পানি ঢালতে লাগলো । নীলু কিছুটা অবাক হলেও পড়ে চিন্তা করলো, জন হপকিন্স স্কুল অফ মেডিসিনের ছাত্রের উপর নিশ্চয়ই ভরসা করা যায় ।
ভাইয়া ঘুমাতে ঘুমাতে রাত প্রায় চারটা । কারার বললো “নীল তুমি হায়দারের পাশেই ঘুমাও । আমি সোফাটাতে আছি |”


বারো:

পরের দিন সকালে জ্বর মাপা হলো আবারো ১০০ । নাস্তা করে পাশেই এক হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো । ডাক্তার কিছু ব্লাড টেস্ট করতে দিলেন । আজকের ট্রেনিংটা বাদ দিতে হলো হায়দারের । আজকার সকালটা সবাই হোটেলেই কাটালো ।
কারার বললো “আমি আজ মাসাজ করাবো । যাবা নাকি নীলু, এ ফ্রেশ রিট্রিট, তুইও চল হায়দার, জ্বর তো কি হয়েছে ।"

“মানুষের দৈহিক সাস্থ্যের চেয়ে মানষিক সাস্থ্যের গুরুত্ব বেশি বুঝলেন ডাক্তার সাহেব । তাই আগে মন তারপর দেহ |”
আসলেই বেশ চমৎকার একটা রিফ্রেশিং মাসাজ নিলো সবাই । নীলুও জীবনের প্রথম ফুল বডি মাসাজ নিলো, বেশ তরতাজা লাগছে । হায়দারও বেশ রিফ্রেশিং ফিল করছিলো ।
"এবার কিন্তু হোটেলে বসে বাকী দিনটা পার করতে চাইনা, কি হায়দার যাবি নাকি?"
"চল, কোথায় যাবি?"
"কিন্তু তোমার রিপোর্ট" জিজ্ঞাসা করলো নীলু ।
"রিপোর্ট দেবে সন্ধ্যা সাতটায়, তাই চল লেক জুরিখে, চারঘন্টায় ফেরত আসা যাবে ।"
কারারের রিকুয়েস্টে লান্চের পর ঠিক দেড়টার সময় তারা লেক জুরিখ ভ্রমনে বের হলো । চার ঘন্টার রাইড এটা ।
এই জার্নিটাও এককথায় অসাধারণ, স্বচ্ছ নীলাভ পানি, চারিদিকে পাহাড় সারি সারি, আর ইউরোপীয় স্টাইলের অট্টালিকার সারি, এককথায় অপূর্ব ।
আর ভেতরেও ইন্টারটেইনমেন্টের কোন কমতি নেই । ব্যুফে বারবি কিউ, মোস্টলি বিফ আইটেম, ডিজে আরও নানাবিধ ইভেন্টসে ভর্তি, কখনও বোরিং হওয়ার কোন চান্স নেই ।
কারার ক্রুইজ শীপে উঠার পরেই দুই ডেনিশ পিচ্ছির সাথে বেশ খাতির লাগিয়ে ফেলে, পিচ্চি দুটিও তার সাথে বিভিন্ন মজা নিতে থাকে । নীলুকে চিন্তিত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে কারার বলে, " ভবিষ্যতে কি হবে বা অতীতে কি হয়েছে তা ভেবে বর্তমানের আনন্দটাকে মাটি করোনা । এই অসাধারণ লেকের সৌন্দর্য উপভোগ কর । চল রুফটপ ডেকে যাই ।"
নীলু টপ ডেকে গেলো, নীলু এই প্রথম চুল পিছে বেঁধেছিল । এমনিতেই সে বেশ সুন্দরী । পিছনে চুল বাঁধা অবস্থায় অপ্সরা লাগছিলো তাকে । আর কারারের মত হ্যান্ডসাম সুপূরুষ বেশ কমই দেখা যায় ।
এই অসম্ভব সুন্দর ভ্রমনটা শেষ হয়ে হোটেলে আসতে আসতে রাত প্রায় আটটা । হায়দারের জ্বর বাড়ছিলো ।
নীলু বললো "বাবা তুমি রুমে রেস্ট নাও । চলেন কারার ভাই মেডিক্যাল রিপোর্টটা নিয়ে আসি ।"
প্রায় দুই যুগ পরে বোনটা কোন পুরুষ মানুষকে সহ্য করতে পারছে, তার সাথে বন্ধুর মত মিশছে দেখে বেশ খুশী হলো হায়দার ।
রিপোর্টটা যেন রেডীই ছিলো, নীলু বাইরের ওয়েটিং রুমে বসে ছিলো । কারার রিপোর্টটাতে চোখ বুলালো ।
দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসে পরে সে । কি ভাবে বলবে সে এটা নীলুকে বা হায়দারকে । সে ভাবলো মিথ্যা কথা বলবে । কিন্তু নীলু তো পাশের রুমে বসা । কি ভাবে নেবে সে এটা । ভাবতেই সে মূষড়ে যাচ্ছিলো । চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো সে । হঠাৎ কে যেন তার হাত থেকে যেন ছিনিয়ে নিল । বোল্ড করে লেখা একিউট লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া কথাটা প্রথমেই চোখে পড়লো নীলুর । পা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো নীলুর । তার যে ছোট্ট পৃথিবী শুধু এই বড়ভাইকে ঘিরে সেও চলে যাবে ভেবে জীবনটাকে বৃথা মনে হচ্ছিল তার । নীলু পড়ে যাচ্ছিলো ।

সে বুঝলো একটা হাত তার মাথায় হাত রাখছে, ঝাপসা আলো আঁধারিতে সে হাতের ডায়ামন্ড আংটি দেখে সে বুঝলো এটা কারারের হাত ।




সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:৫৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×