somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জুনুন : এক পুরুষ গাইনোকলোজিষ্টের ডায়েরী থেকে

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জুনুন : এক পুরুষ গাইনোকলোজিষ্টের ডায়েরী থেকে

তৌহিদ রিয়াজ

তিন পর্বের গল্প
(পর্ব এক )

ডা: জুনুন ইবনে কারার (এফ,আর,সি,ও,জি) দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত গাইনোকলোজিস্টদের একজন । তিনি দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞও বটে । তিনি তাঁর সুব্যাবহার আর তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য নামকরা ডাক্তারদের মত অতিরিক্ত মাত্রার বাণিজ্যিক না হওয়ার কারনে অত্যান্ত সুপরিচিত । গাইনী বিভাগে যদিও মহিলাদের প্রাইভেসির কারনে মহিলা ডাক্তারদের আধিক্যই বেশী, তবুও পুরুষ ডাক্তার হওয়া সত্তেও ডা: জুনুন অসংখ্য নারী রোগীদের একমাত্র ভরসার পাত্র ।
প্রায় দুই যুগ ধরে এই পেশায় তিনি । লাখো লাখো নারী দেখেছেন তিনি । নারীগর্ভকে তার কাছে মন্দীর মনে হয় । যেখানে জেনিটালিয়া হলো মন্দীরে প্রবেশের দরজা । মন্দীরে প্রবেশ করলেই যে ভগবানের দেখা পাওয়া যাবে সেরকমটি নয় । অনেক ত্যাগ তিতীক্ষার ফলেই একটি জীবনের সৃষ্টির কারখানা হলো নারীগর্ভ । এই পেশায় থাকার কারনে নারীদের প্রতি তাঁর সম্মান বেড়ে গেছে হাজার গুন ।
তার চেম্বারে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন রোগী দেখেন তিনি, আর সারাদিনে করেন গোটা সাতেক সার্জারী । দুই যুগে দেখেছেন লাখো জন্ম, আবার হাজারো মৃত্যু ।
মানব জন্ম আজও তাঁর কাছে এক বিশাল রহস্য । হওতো খোদ ভগবানের কাছেও এটা একটা পাজল ।
কারও কারও প্রায় প্রতি বছরই বাচ্চা হচ্ছে । রাস্তা ঘাটে এমনকি ডাষ্টবিনেও ফেলে দিচ্ছে মানব শিশু । আবার কেউ কেউ তাদের জীবন দিয়ে দিচ্ছে একটি বাচ্চার জন্য কিন্তু ভগবান তাদের আশা পূরণ করছেননা । ভগবানের খেলা বুঝা দায় ।
আজ রাতেও যথারীতি বেশ কজন রেগুলার রোগী দেখলেন ডা: জুনুন ইবনে কারার । আজকের সাত নাম্বার রোগীর নাম জাহানারা বেগম । উনি যখন ঢুকছিলেন তখন জুনুন ফেইসবুক ব্রাউজ করছিলেন ।
একাই এসেছেন এই মহিলা । ডা: জুনুনের এসিট্যান্ট তুলি কেইস হিস্ট্রী দিয়ে গেলেন ।
কেইস হিস্ট্রী ঘাটার আগেই জুনুন জিজ্ঞাসা করলেন " কেমন আছেন জাহানারা আপা ? "
রোগীদের নাম ধরে ডাকলে রোগীরা খুশি হন এটা খেয়াল করেছেন ডা: জুনুন । কিন্তু ৪৫ বছর বয়স্কা এই মহিলা খুব, খুবই বেশী খুশি হলেন । " জে স্যার, ভালোই আছি স্যার ।"
"হুমম তারপর বলেন আপা । "
"স্যার, আমগোর বিয়া হইছে স্যার আইজ ২৫ বছর হইলো, এর আগে তিনটা বাচ্চা পেটেই মইরা গেছে স্যার ।"
“কোথায় কোথায় না গেছি স্যার । আজমীর শরীফও গেছিলাম স্যার । ইন্ডিয়ার এক ডাক্তরে আমার টিউব কাইটা লইছে স্যারগো ।“
"তা শেষ কয়মাস আগে আপনার পিরিয়ড বন্ধ হলো?"
"স্যার তিনমাস হইলো..." বলেই বেশ একটা সুখী সুখী হাসি দিলেন ৪৫ বছর বয়স্কা জাহানারা বেগম ।
" তা আপা আপনার স্বামী এলো না ?" জিজ্ঞাসা করলেন জুনুন ।
মুখটা কান্না কান্না ভাব করলেন জাহানারা, দুফোটা অশ্রুও বের হলো তার চোখ দিয়ে । "স্যার উনি বেহেশতে গেছেন কয়েক মাস আগেই....।"
আকাশ ভেঙ্গে পড়লো এই বিখ্যাত ডাক্তারের মাথায় ।
"মানে কি? তাহলে !!" আর কি জিজ্ঞাসা করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না জুনুন । তাঁর দুই যুগের ডাক্তারী এক্সপেরিয়্যান্সে এই রকম কেইস হ্যান্ডল করেননি তিনি ।
“স্যার, বিহারের কারাবন্দী পীর সাহেবের কাছে গেছিলাম স্যার । কারাবন্দী পীর নিজেই বলছে " আল্লাহ চাইলে তোর স্বামীর বীজেই হইবো তোর সন্তান..."”

কারাবন্দী পীর সাহেবের কথা আগেও শুনেছেন জুনুন । নিজের বাবাকে আঠার বছর বয়সে অন্যনারীর সাথে স্বচক্ষে জেনা করতে দেখে জবাই করে আজীবন কারাবরণে যান আব্দুল রেহমান । পুরোদমে ধার্মিক হয়ে যান কারাবন্দী রেহমান । বিহারের এই কুখ্যাত জেলে ধর্ম প্রচার শুরু করেন তিনি । হাজার হাজার কারাবন্দী এমনকি জেলখানার জেলাররাও ভক্ত হয়ে যান রেহমানের ।
মাত্র কয়েক বছরেই কারাবন্দী পীর সাহেব নামে খ্যাতি লাভ করেন আব্দুল রেহমান । বছরে একবার জেলখানার বাইরে ওরস করার পার্মিশান দেন সরকার । সেখানেই অগনিত ভক্তকুলের সাথে দেখা করেন তিনি ।
"স্যার ওইহান থেইক্যা আসার পরেই বুঝতেছিলাম কিছু একটা হইতাছে পেটের মইধ্যে । স্যার ওর পরের মাসেই পিরিয়ড বন্ধ হইয়া গেলো স্যার । ষ্ট্রীপ দিয়া চেক কইরা দেহি আমি পোয়াতি ।" চোখেমুখে একটা স্বর্গীয় গ্লো দেখা গেলো জাহানারার । "আর স্যার উনি মইরা যাওনের সময়ও বইলা গেছিলেন "জাহান, আমার মনডা কয় আমি মরলে তোর বাচ্চা হইবো ।"
জুনুন হিপ্নোটাইজডের মত শুনছিলেন জাহানার কথা গুলো । উনি এসিট্যান্ট তুলিকে বললেন আল্ট্রাসাউন্ডটা উনি নিজেই দেখতে চান । আর আজকে আর কোন রোগী দেখবেননা তিনি তাও বললেন তুলিকে ।

"এর আগে কখনো আল্ট্রাসাউন্ড করেছেন আপা ?"
"জ্বে না স্যার, গরীব মানুষ স্যার, অনেক কষ্টেই আপনার ভিজিটের পয়সা জোগাড় করছি স্যার । আমার অনেক দিনের শখ আপনারে দেহামু । আইজ সেই শখ আল্লাহ পুরণ করছে স্যার ।"
আল্ট্রাসাউন্ড এ প্রায় ঘন্টা খানেক দেখে হঠাৎ ই রুম থেকে ছিটকে বের হয়ে আসলেন ডা: জুনুন । খালি বললেন "তুলি উনাকে কালকে আসতে বল । বলবা ভিজিট লাগবেনা ।"
বাড়িতে ফিরেই প্রায় দশ বছর পরে ড্রিংকস করলেন জুনুন ।
ডায়েরীতে কি লিখবেন ভেবে পাচ্ছেননা ।
লিখলেন " কি করে বলবো এই মহিলাকে !! "
লিখেই কাঁদতে কাঁদতে ডায়েরীটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন দেশের প্রথিত যশা এই গাইনী এক্সপার্ট ।





জুনুন : এক পুরুষ গাইনোকলোজিষ্টের ডায়েরী থেকে

(দ্বিতীয় পর্ব)


সে রাতে এক ফোটা ঘুমও আসেনি জুনুনের ।

উনি ভাবলেন - নারীগর্ভ একটি তীর্থস্থানের মত, তীর্থস্থানে দেবী দর্শন লাভ করার জন্য যেমন লাখো লাখো তীর্থযাত্রী এক সপ্ন যাত্রা শুরু করে । যেখানে থাকে ইনস্পিরেশান, স্পিরিচুয়্যাল মোটিভেশান আর দেবী দর্শনের প্রচন্ড আকাঙ্খা । ঠিক তেমনি নারীগর্ভে দেবী দর্শনের জন্য লাখে লাখে শুক্রাণু তীর্থ যাত্রা শুরু করে । কত যে চরাই উতরাই পাড় করতে হয় তার ইয়ত্তা নেই । কখনও হিমালয়ের চেয়েও উচুঁতে চড়তে হয়, কখনও বা মারিয়ানা ট্রেন্চের চেয়ে গভীরে যেতে হয় । তবুও দেবীর দর্শন লাভের জন্য শুক্রাণুগুলোর এই মরনযাত্রা অব্যহত থাকে । হয়ত মাত্র কিছু সংখ্যক সাধু শুক্রাণুই দেবীর মন্দীর পর্যন্ত পৌছুতে পারবে ।
কিন্তু দেবীর মন্দীরের দুয়ার তো বন্ধ । এর চাবী খুঁজতে হবে এই পরিশ্রান্ত তীর্থযাত্রীদেরই । এই পিপাশার্ত, ক্লান্ত তীর্থযাত্রীদের বেশীর ভাগই মৃত্যুকে বরণ করে নেবে দেবীর মন্দীরে দেয়ালেই । কে যে হবে সেই ভাগ্যবান যে কিনা মহাময়ী দেবীর দর্শন করতে পারবে তা শুধু ভগবানই জানেন ।
আর দেবীর দর্শন লাভ জীবন সৃষ্টির শেষ নয় । এটা জীবনের প্রারম্ভ মাত্র ।
নিজের প্রফেশনটা বড়ই অদ্ভূত মনে হয় ডা: জুনুনের । নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হয় তাঁর । মানুষ অনেক আশা করে তার কাছে আসে, কিন্তু সে জানে, পুরো খেলাটাই ভগবানের হাতে ।
স্ত্রী দীপ্রার কথা মনে পরে তার । কি সুন্দরীই না ছিল দীপ্রা, সিংহ রাশির জাতিকা ছিলো সে । টানা টানা চোখ, সিল্কী চুল । প্রেম করে বিয়ে হয়নি ওদের, কিন্তু প্রেমটা হয়েছিলো বিয়ের পরে । গভীর প্রেমে আবদ্ধ হয়েছিলো ওরা দুজনে । প্রফেশনাল ব্যাস্ততার কারনে ওকে সময় দেওয়া হতোনা । কিন্তু যতক্ষণ তারা একসাথে থাকতো ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকতো জীবন ।
তাদের সংসার ছিলো পনের বছরের । ডাঃ জুনুন নিজে এতবড় ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ হলেও নিজের কোন বাচ্চা কাচ্চা হয়নি তাদের ।
সে নিজে অনেক ব্যাস্ত মানুষ, কিন্তু দীপ্রা ছিলো বড়ই একা, সারাদিন বাসায়ই কাটাতে পছন্দ করতো সে । একাকী জীবন ছিলো তার । সম্পূর্ণ বাসা জুড়ে ছিলো বাচ্চাদের ছবি, হাজারো পুতুল আর খেলনা । এগুলোই ছিলো দীপ্রার জীবন ।
জুনুন যখনই ফোন দিতো, দীপ্রা বলতো, " জানো আজকে টিনা আমাকে মা বলে ডেকেছে ।"
জুনুন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতো, কারন টিনা হচ্ছে ওর একটা টেডি বেয়ারের নাম । ভাবতে ভাবতে কাঁদতে শুরু করলো জুনুন ।
শেষের দিকে ঘুমাতে পারতোনা দীপ্রা । হঠাৎ করেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজে উঠে যেতো সে । বলতো, " আই শুনেছো, ও ঘরে ওরা কাঁদছে, আমি দেখে আসি ।"


কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে সে, দেখিয়েছে পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত সব ডাক্তার, কিন্তু দেবী দর্শন পায়নি সে । তিন তিনটি বাচ্চা ফেটাসকে নিজ হাতে মাটি দিয়েছে জুনুন । তিনটি ই দীপ্রার মত হয়েছিলো, টানা টানা চোখ, উচুঁ দাতের চোয়াল...কিন্তু শেষ যেবার তার পিরিয়ড মিস হলো, কয়েক সপ্তাহ পরেই পেট ফুলা শুরু হলো, সেবার দীপ্রা জেদ ধরলো সে এবার ডায়াগনোসিস করাবেনা, এমনকি আল্ট্রাসাউন্ডও নয় ।
ধীরে ধীরে পেট ফুলা শুরু করলো, পরিবর্তন আসলো ব্রেষ্টের সাইজেও, ফেটাসের নড়াচড়া শুনা শুরু করলো দীপ্রা । অনেক বার দেশের বিখ্যাত ডাক্তার জুনুন ইবনে কারার নিজের কানে শুনেছে সেই বাচ্চা নড়াচড়ার আওয়াজ । বাচ্চার বয়স যখন ছয় মাস প্রচন্ড প্রসব বেদনা উঠে দীপ্রার । জুনুনদের হাসপাতালেই আনা হয়েছিলো দীপ্রাকে ।
ডাক্তার সৌমিত্র ওকে চেক করার পর জুনুনের কানে কানে বললেন "সিউডোপ্রেগন্যান্সী" মানে কোন কিছুই নেই তার গর্ভে । বাচ্চা নেওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছাই তার শরীরে এই মাতৃত্বজনিত হরমোন গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে । সিউডোপ্রেগন্যান্সী খুবই রেয়ার হলেও ডাক্তারী শাস্ত্রে এর কিছু কেইস স্টাডী রয়েছে ।
ওইরাত্রে, সাইকিয়াট্রিস্ট হুমায়রা খানম বানুর হেল্প নিয়ে দীপ্রাকে পুরো ঘটনাটা ব্যাখ্যা করা হয় । লাভ হয়নি । ওই রাতেই মারা যায় দীপ্রা ।
আগে মাটি দেওয়া তিন ফেটাসের পাশেই মাটি দেওয়া জুনুনের দেবী দিপ্রাকে । তারিখটা ছিলো অগাষ্টের ১২ তারিখ । হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো জুনুন । সে খুব একটা ধর্মপরায়ন নয় । দেবীর স্থান দিয়েছিলো সে দীপ্রাকে ।
বাকী রাতে আর ঘুমুতে পারেনি জুনুন । দেয়ালে টাঙ্গানো দীপ্রার বড় ছবিটার দিকে তাকিয়ে কেঁদেই রাত পার করেছে সে ।
পরের দিন আবারো রেগুলার চেক আপ চলছিলো, সে মনে মনে অপেক্ষা করছিলো জাহানার বেগমের জন্য । কিন্তু কেন জানি একের পরে এক রোগী আসলেও জাহানারা বেগমের দেখা পেলেননা জুনুন । তার আজকের পয়ত্রিশ তম এবং শেষ পেশেন্টের নাম মুমু খান ।
ডা: জুনুন জিজ্ঞাসা করলেন, " কি মুমু আপা, কি করেন ?"
"জি স্যার আমি বাংলা সিনেমার নায়িকা ।"
" বাহ । আপনার রিপোর্ট তো বলছে আপনার পেটে তিনটি পিচ্চি , আলহামদুলিল্লাহ । তো ভালো ডাক্তারই তো দেখাচ্ছিলেন, ডাঃ সুব্রত আমার শিক্ষক । তো আমার কাছে কি মনে করে ?!"
"স্যার পেটে ওই তিন টুইনের দুটো ওর নয় । ওগুলো মেরে ফেলতে হবে, আর শুধু ওরটাই রাখতে হবে ।"
মানে কি? কি বলছে এই মহিলা । নারীরা অনেক বিচিত্র । আবারও মাথা ঝিম ঝিম করছে ডা: জুনুনের । কি হচ্ছে গত দুদিন ধরে ওর সাথে ।
কিভাবে বুঝলো দুটো বাচ্চা ওর স্বামীর নয়, শুধু একটা ওর !!!




জুনুন : এক পুরুষ গাইনোকলোজিষ্টের ডায়েরী থেকে
শেষ পর্ব:

এরপরে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো কিন্তু মুমু খান আর জাহানারা বেগমের দেখা নেই । এর মাঝেও অনেক ক্রিটিক্যাল রোগী দেখেছেন ডা: জুনুন । অনেক দু:খের কেইস, আবার অনেক সুখের, আনন্দ ভরা কেইস । তাঁর নিজের জীবনের একাকীত্বের পার্ট, ডায়েরী লেখা এগুলো রেগুলারলি চলছিলো । দেশের বাইরে বেশ কিছু সেমিনার এবং সার্জারী এটেন্ড করেছেন এই গুনী গাইনীকোলজিস্ট ।
প্রতিদিন হাজারো নারী তার চারপাশে থাকলেও তাঁর দেবী দীপ্রা চলে যাওয়ার পরে আর কারুকেই মনে ধরেনি তার । প্রতি শুক্রবারেই যান চার নারী, অর্থ্যাৎ দীপ্রা ও তার তিন মেয়ে ফেটাসের কবর জিয়ারতে । তার ঘরে দীপ্রার পুতুলগুলো আজও সেভাবেই আছে ।
আর প্রতিরাতেই দিপ্রা ও তার ফেটাসগুলোর হাসি শুনতে পান তিনি । অনেক রাতই নির্ঘুম কাটে তার । পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো একাকীত্বের শাস্তি ।
বেশ কিছুদিন নর্মালি রুটিন মাফিক কাজ চলছিলো । সার্জারী করা, আই, ভি,এফ করা সবকিছুই চলছিলো এজ ইউজুয়াল ।
কিন্তু ৮ই মার্চের সেইদিন টি যেন ছিলো চমকের একটি দিন । একটার পর একটা জটিল কেইস আসছিলো সেদিন ।
আজ প্রথম অপারেশানেই ঘটলো ঘটনাটা । রোগীর নাম সালমা মুশফেকা । একেবারেই শেষ মূহুর্তে হসপিটালে আনা হয়েছে তাকে । সাথে তার স্বামী এসেছে । এই মহিলারও বিয়ে হয়েছে ১০ বছর হলো, এটাই তাদের প্রথম ইস্যু । প্রায় শেষ মুহুর্তে আনা হয়েছে সালমাকে । স্বামী বেচারা কাঁদছে, বলছে ডাক্তার সাহেব ওকে বাঁচান । বলেই স্বামী অজ্ঞান হয়ে গেছে ।
দৌড়াদৌড়ি করে ঢুকতে হলো অপারেশান থিয়েটার ওটি ০১ এ, পাশাপাশি আরও দুটি অপারেশান থিয়েটারেও অপারেশান চলছে ।
কালক্ষেপণ করলেই বিপদ । কিন্তু এনেস্থেশিয়া এক্সপার্ট আসতে দেরী হলো পাঁচ মিনিট । এই পাঁচ মিনিট যেন অনন্ত কাল মনে হচ্ছিলো জুনুনের ।
আর এই পাঁচ মিনিটই সালমা জুনুনের হাত জোর করে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল । সে ক্রমশ: বলে যাচ্ছিলো "স্যার আমার দুই টুইন আর আমি, যদি আমাদের তিনজনের মধ্যে শুধু একজনকে বাঁচাতে হয়, আমার ছেলেটারে বাঁচায়েন স্যার । যদি দুইজনরে বাঁচাতে হয় আমার মা টারে বাঁচায়েন, আমি মরলে কিছুই যায় আসেনা স্যার ।"
এনেস্থেশিয়া এক্সপার্ট ডাঃ জামিলের এনেস্থেশিয়া সবসময়ই খুবই নিখুঁত হয় । কিন্তু কেন জানি সালমা পাঁচ মিনিট পরেই হঠাৎ অপারেশানের মাঝেই সম্বিত ফিরে পেয়ে বললো "স্যার আমার ছেলেডারে বাঁচায়েন । স্যার শুধু ওনারে বইলেন আমার ছেলের নাম রাখতে, জীবন |"
মায়ের কথাই সত্য হলো, অনেক চেষ্টা করেও বাকী দুজনকে বাঁচানো গেলোনা ।
ডা: জুনুন ইবনে কারার তাঁর ডায়েরীতে লিখলেন "হায়রে পুরুষ, দুই নারীর জীবনের বিনিময়ে তোর জীবন রক্ষা করে গেল ....যথার্থই তোর নাম, জীবন…."
মনটা খারাপ হয়ে গেলো তাঁর, মায়ের কথা বড্ড বেশী মনে পরছিলো জুনুনের । তার মা মারা গিয়েছিলো তাকে জন্ম দিয়েই । মা কে সে পায়নি জীবনের একটি দিনের জন্যেও । খুব বেশী ফিল করেনি কখনও সে । কিন্তু আজকে সালমা মুশফেকা তাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, মা কি জিনিস । পুরুষরা কখনও নারীদের ঋণ শোধ করতে পারবেনা । সালমার লাশের পাশে জীবনকে নিয়ে বসেছিলো সে । জীবন কেঁদে যাচ্ছে । সাথে কেঁদে যাচ্ছে ডাক্তার জুনুন ইবনে কারার ।
ডাক্তারের নাকি কাঁদতে হয়না । কিন্তু ইদানীং না কেঁদে পারছেনা জুনুন । জন্ম মৃত্যুর এই প্রফেশানে সবসময়ই চলছে আনন্দ, কান্নাহাসি, সুখ দু:খের চক্র ।
হঠাৎই জুনুন সম্বিত ফিরে পেল পাশের রুমের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে । একসাথে তিনজন মারা গেছে সেখানে । সৌভাগ্যবশত: বেঁচে আছে শুধু একটি শিশু । জুনুন পাশের ওটি রুমে ঢুকলে দেখলো, মহিলাটি তার পরিচিত ।
এ কি এ তো নায়িকা মুমু খান । মারা গেছে মুমু আর তার দুটি বাচ্চা । বেঁচে আছে শুধু একটি ।
মনে পরলো নায়িকা মুমু খান বলেছিলো : "স্যার পেটে ওই তিন টুইনের দুটো ওর নয় । ওগুলো মেরে ফেলতে হবে, আর শুধু ওরটাই রাখতে হবে ।"
" ভগবান আমার সাথে আজ এ কি খেলা খেলছে ?" ভাবলো প্রচুর মানব জন্ম মৃত্যর সাক্ষী ডা: জুনুন ।
সে দেখলো মুমুর সাথে কোন গার্জিয়ান বা কেউই আসেনাই । সে দৌড়ে গেলো হাসপাতালের ডিরেক্টারের রুমে । গিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে বললো । "স্যার, যেভাবেই হোক আমি এই তিন বাচ্চার ডি,এন,এ টা টেস্ট করাতে চাই ।"
তার অনেক কাকুতি মিনতির পরে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ দেশের সমস্ত আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে লুকিয়ে এই কাজ টি করলো, তারা সমস্ত তথ্য গোপনা রাখা এবং ডা: জুনুনের আরও কিছু চুক্তির বিনিময়ে এই ইল্লিগ্যাল কাজটি করলো । তারা ডি,এন,এ টেস্ট করার পার্মিশান দিলো ।
৮ই মার্চের এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রথমার্ধ তার জীবনে অনেক নতুন অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার সঞ্চালন ঘটিয়েছে । ভগবানই শুধু জানত, এর চেয়েও বড় ধাক্কা ওয়েট করছিলো তার ডাক্তারী ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতার ।


ওটি নাম্বার তিন এ বেশ অনেকক্ষণ ধরেই অপারেশান চলছিলো । অপারেশান করছিলো তার ক্লাশমেট ডা: সিমিন শাহেলা ।
চেম্বারে দেখা হতেই সে বললো " বুঝলা জুনুন, যে মহিলার অপারেশান করলাম তার ২৫ বছর পরে বাচ্চা হইলো, স্বামীও নাই..."
জুনুন পুরো কথাটা খুব একটা মনযোগ দিয়ে খেয়াল করেনাই । সে বললো, " খাওয়া দাওয়া করেছো ? যাই আমার আরও একটা অপারেশান আছে ।"
রুম থেকে অপারেশান থিয়েটারের দিকে যেতেই যথারীতি সিমিনের করা অপারেশানের রোগীকে স্ট্রেচারে করে পোস্ট অপারেটিভে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো । হঠাৎই জুনুনের মনে হলো রোগীকে সে কোথায় যেন দেখেছে । মহিলার এখনও পুরোপুরি এনেস্থেশিয়ার রেশ কাটেনি । কিন্তু জুনুন দেখলো মহিলাটির মুখে অদ্ভুত হাসির ছোয়া ।
কিন্তু কোনভাবেই মনে করতে পারছেনা কোথায় দেখেছে সে এই মহিলাকে । বছরে হাজার হাজার রোগী দেখে সে, চেষ্টা করে মনে রাখতে । কিন্তু তার বয়স হয়ে যাচ্ছে, তাই চাইলেও মনে রাখতে পারেনা ।
আজ সারা দিন অনেক ধকল গেছে তার । বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১২ টা । শাওয়ার নিয়ে ডায়েরীটা হাতে নিয়ে বসলো সে । মনে পড়লো আজ ইমার্জেন্সী ডি,এন,এ টেষ্ট করতে দিয়েছিল ডি,এন,এ এক্সপার্ট জাহিদ ইকবালকে । ডি,এন,এ টেষ্ট সাধারণত ১২ঘন্টা থেকে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নেয় । সে অবশ্য খুবই বেসিক একটা টেস্ট দিয়েছে ।
ডায়েরীর পাতা উল্টে দেখছিল জুনুন । হাজার হাজার কেইস ।
হঠাৎই তার বেশ কিছুদিন আগের লেখাটা চোখে পরলো " কি করে বলবো এই মহিলাকে !! "
তখনই সম্বিত ফিরে পেলো জুনুন । আজ সিমিন যে রোগীটার ডেলিভারি করেছে সে আর কেউ নন সেই জাহানারা বেগম ।
তার হাসিমাখা মুখটা মনে পরলো তার । মনে পরলো সে বলেছিলো, "স্যার উনি মইরা যাওনের সময়ও বইলা গেছিলেন "জাহান, আমার মনডা কয় আমি মরলে তোর বাচ্চা হইবো ।"
নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে । জানালা দিয়ে শুকতারাটির দিকে তাকালো সে, মনে মনে বললো ,
" খোদা, তোমার খেলা তুমি ই বোঝ ।"
আর ঠিক সেই সময়ই এলো ফোনটা, ডা: জাহিদ ইকবাল ওপাড় থেকে বললেন " মি: জুনুন, ভাই ইওর প্রেডিকশান ওয়াজ রাইট, অনলি দ্যা সারভাইভড বেবী’স ডি,এন,এ ওয়াজ ডিফারেন্ট । আর বাকীদুই মৃত বাচ্চাগুলোর ডি,এন,এ আলাদা ।"
জুনুন তার ডায়েরীতে লেখলেন, " হেটেরো প্যাটারনাল সুপারফেকান্ডেশান !!"
লিখেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ।
দীপ্রার ছবিটার দিকে তাকালেন তিনি, মনে হলো দীপ্রা তাকে বলছে " জুনুন, আমি পারিনাই তো কি হয়েছে, জাহানারা, সালমা, মুমু খানরা পেরেছে ।"
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:১৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×