আকাশের শুকতারা........।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আতিক এর সাথে আমার পরিচয় হয় মেডিকেল এ ভরতি হবার পর। আমি গ্রাম থেকে এই শহরে এসে কিছুতেই মানাতে পারছিলাম না। তারপর নেই তেমন কোন জানাশোনা কেউ। মেডিকেল এ তখনও কোন বন্ধু হয়নি। আসলে গ্রামের ছেলে বলে কেউ হয়ত পাত্তা দিত না।
যাই হোক, প্রথম ক্লাস এ দেরিতে ঢোকার জন্য প্রথমে স্যার এর বকা, “মেডিকেল এ পড় সময় সম্পর্কে কোন কেয়ার, নেই এমন হলে ডাক্তারি পড়তে হবে না, অন্ন্য কিছু করো, এখানে এমন চলবে না’’। তারপর ক্লাস জুড়ে হাসি। স্যার সবাইকে ধমক দিলেন। আমাকে বললেন সবার পেছেনের বেঞ্ছে বস, এটা দেরিতে আসার শাস্তি। কি আর করা বসতে হল। খুব মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছিলাম এর এক ফাঁকে আমার পাসের ছেলেটি বলল, “তোমার নাম কি, বাসা কোথায়? এভাবে শুরু, প্রতিদিন এক সাথে ক্লাসে বসা, লাইব্রেরিতে পড়তে বসা, ক্যান্টিনে খাওয়া, আরও কত মজার কাহিনি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম। এক দিন যদি কেউ কাউকে না দেখতাম তবে স্থির থাকতে পারতাম না।
হ্যাঁ আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আতিক এর কথা বলছি। সে এই ইট-পাথরের শহরেই বড় হয়েছে। অনেক নামকরা ডাক্তার বাবা-মায়ের এক মাত্র ছেলে। এই অজানা শহরে এমন এক বন্ধু পেয়ে ভালই কাটছিল আমার মেডিকেল জীবন। সময়ের ঘড়িতে ভর করে উঠলাম চতুর্থ বর্ষে। এর মাঝে অনেক বন্ধু হয়েছে কিন্তু আতিক এর মত কেউ হয়নি।
হঠাত একদিন জানতে পারলাম আতিক প্রেমে পড়েছে। সে তো কিছুতেই বলবে না, কিন্তু আমিও ছাড়ার পাত্র নই। অবশেসে বলতে বাধ্য হল। হঠাত একদিন আমাকে কিছু না বলে নিয়ে গেল ওদের বাসায়। বাসায় গিয়ে ও আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল ওর বাবা-মায়ের সামনে ওর পছন্দের মেয়ের কথা বলার জন্ন্য। কি আর করা বাধ্য হয়ে বলতে হল।কিন্তু অবাক হলাম যখন জানলাম ওর বাবা-মা সব শুনে ওই মেয়েকে পছন্দ করলো । আস্তে আস্তে এক সময় মেডিকেল পাশ করে ঢুকলাম ইন্টারনি করতে। কিন্তু আতিক কে মাঝে মাঝে ডিউটিতে আসতে দেখতাম না, ওর ফোন ও বন্ধ পাওয়া যেত। বাধ্য হয়ে একদিন ওর বাসায় গেলাম। জানতে পারলাম ও খুব অসুস্তো। যখন ওকে দেখতে গেলাম ও বলল তেমন কিছু হয়নি সামান্ন্য একটু জর তাই তোকে ফোন দেয়নি। এভাবে প্রায় একটি বছর কেটে গেল। এই এক বছরে ও প্রায়ই অসুস্ত হত। মাঝে মাঝে হাসপাতালে ভরতি থাকত। ওর বাবা-মা দু’জনের শত ব্যাস্ততার মাঝে ছেলের ঠিকমত খবর নেবার সময় হত না।
আসলে টাকার স্বাদ পেলে সবাই বোধ হয় পাগল হয়ে যায়, কারোর খোঁজ নেবার সময় থাকে না, এমনকি নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনেরও না। আসলে মানুষ বড় আজব প্রাণী। জগতের সকল প্রাণীরই খাওয়ার পরে পেট ভরে, ভরেনা কেবল মানুষ নামক আজব প্রাণীর। মানুষের চাওয়ার যেন কোনো শেষ নেই!
একদিন ও আমাকে বলল, আমার এঞ্জেজমেন্ট তোকে কিন্তু অবশ্যই থাকতে হবে। একদিন দু-দিন করে ওর বিয়ের দিন সামনে আসছে আর আমার ব্যাস্ততা বাড়ছে। ওর বিয়ের কার্ড দেয়া, ঘর সাজানো, কেনাকাটা করা সবকিছুতেই আমাকে থাকতে হবে, না হলে হবে না। বিয়ের ঠিক দু’দিন আগে রাত এগারটার দিকে আমার ফোনে ওর নাম্বার থেকে ফোন আসল। হ্যাল্লো বলতেই ও পাশ থেকে ওর বাবা বলল, “আতিক খুব অসুস্থ তুমি এখনি হাসপাতালে চলে আস, ও তোমাকে বারবার দেখতে চাচ্ছে’’। আমি তখনি পাগলের মত ছুটলাম। গিয়ে দেখলাম ওর মা খুব কাঁদছে। আমি ওর বাবার কাছে জানতে চাইলাম ওর কি হয়েছে। তিনি বললেন কয়েক দিন ধরে ওর শরীরটা একটু খারাপ ছিল, আজ সন্ধ্যায় ওর আবার অনেক জর আসে। হঠাত করে তাপমাত্রা অনেক বাড়তে থাকে। এক সময় ও শকে(Shock) চলে যায় আর তার পর ওকে এখানে নিয়ে আসি। আমি ভেতরে ঢুকে ওর হাতটা ধরতেই কি যেন বলতে চাইল, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না শুধু চোখ বেয়ে দু’ফোটা জল আমার হাতে এসে পড়ল। এমন সময় ডাক্তার এসে বলল, ওকে এখনি আই.সি.উ. তে নিতে হবে। আমি অসহায়ের মত দেখলাম ওকে নিয়ে যাচ্ছে। একটু পর পর ডাক্তাররা এসে দেখছে, কিন্তু ওর তেমন কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু ওর শরীরে লাগানো যন্ত্রগুলো কোনো সাড়া দিচ্ছে না। মনিটরে ওর পালস ও ব্লাড প্রেসার আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এরমাঝে ওর সব পরীক্ষার রিপোর্ট চলে এসেছে। রোগটা আস্তে আস্তে বাসা বেধেছে ওর শরীরে, কুরে কুরে শেষ করে দিয়েছে ওর জীবনের সমস্ত স্বপ্নকে, কেউ কোনদিন বুঝতেও পারেনি। যখন এটা ধরা পড়ল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ডাক্তাররা ওকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রেখেছে। আমি অসহায়ের মত কাঁচের জানালা দিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা ওর নিথর দেহটা দেখছি। আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই আগের স্মৃতি গুলো, যে স্বপ্ন দেখত অনেক বড় ডাক্তার হবার, গরীব মানুষের সেবা করার, বিনা চিকিতসায় যাতে কেউ মারা না যায়। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে আজ সে নিজেই রোগী হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে জেতার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
আর হয়ত অল্প কিছু সময়, তার পর সব শেষ। আমি আর ভাবতে পারছি না। নিজের অজান্তে কখন দেখি দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। সারা রাত আমি জেগে রইলাম ওর পাশে। ভোরের দিকে ডাক্তার এসে জানালেন ওর অবস্থা আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়ে পড়ছে, আল্লাহ কে ডাকুন। সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ভোর পাঁচটার দিকে ও সবাইকে চিরবিদায় জানিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। ডাক্তার এসে বললেন ও আর নেই। কথাটা শুনে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি।
আমি কখনই ভাবিনি ও আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবে। কত স্বপ্ন ছিল আমাদের। তোকে ছাড়া আমার জীবনের এই দীর্ঘ পথ কিভাবে পাড়ি দেব, কে আমার ভুল গুলো ঠিক করে দেবে? এই ভয়ংকর সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে সবাইকে এক দিন চলে যেতে হবে, কিন্তু তোর এই অসময়ে চলে যাওয়া সত্যিই অনেক কষ্টের। সত্যিই অনেক অভিমানি তুই…… তা না হলে এভাবে কেন আমাদের সবাইকে একা করে চলে যাবি.........?
নিয়তির পরিহাস নামক জীবনের রূঢ় বাস্তবতার কবলে মানুষের সাজানো সংসার, স্বপ্নগুলো যেন হঠাত করেই বিলীন হয়ে যায়। বসন্ত সময়েই ঝরে পড়ে জীবনের পাতা। অপমৃত্যু, অপঘাত, দূর্ঘটনা এগুলো বুঝি কিছুতেই পিছু ছাড়তে চায় না দুর্ভাগাদের……….।
পুনশ্চঃ মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যা রাতে জেগে ওঠে বিশাল আকাশের বুকে। বিচরণ করে আত্মার মাঝে। মায়ার হাতছানি দিয়ে ডাকে কাছে। বন্ধু তুই কি সেই শুকতারা যে আমাকে ডাকে প্রতিনিয়ত?
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট
পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:
وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন
মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)
ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)
০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।
ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।