somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত মানবতার মুখোমুখি

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কেমন অনুভূতি হয় একজন নব্য মেডিকেল শিক্ষার্থীর, যখন সে প্রথমবারের মতো মানবদেহকে নিজ হাতে মাংসস্তুপে পরিণত করবার দীক্ষা নেয়? চলুন জেনে আসি পল কালানিথি নামের এক প্রখ্যাত নিউরোসার্জনের মুখ থেকেঃ

জীবিত থাকতেই অনেকে নিজের মরদেহ দান করে দিয়ে যায়। মৃতদেহ সংক্রান্ত ভাষার পরিবর্তন এলো এই কারণে। মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের নির্দেশ দেয়া হল এখন থেকে “মৃতদেহ” বলা যাবে না, বলতে হবে “ডোনার”। আর হ্যাঁ, আগের আমলের তুলনায় অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে শবব্যবচ্ছেদের বেলায়। (শিক্ষার্থীদের আর এখন নিজ দায়িত্বে মরদেহ নিয়ে আসতে হয় না, যেমনটা করতে হতো ঊনবিংশ শতাব্দীতে। তাছাড়া মেডিকেল স্কুলগুলো এখন কবর থেকে মরদেহ চুরিকেও সমর্থন দেয় না। খুন করার চাইতে চুরি করা ভাল- এই মতাদর্শ থেকে সরে এসেছে তারা। তবে এই চুরি এতটাই প্রচলিত ছিল যে এই কাজের জন্য আলাদা একটা শব্দই ছিল- “Bruke” অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুযায়ী যার অর্থ হচ্ছেঃ “দমবন্ধ কিংবা গলায় ফাঁস আটকে গোপনে হত্যা করা। কিংবা নিহতের দেহ বিক্রি করা যাতে তা শবব্যবচ্ছেদে উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে।”
অবশ্য যাদের কাছে সমস্ত তথ্যের ভাণ্ডার থাকত- সেই খোদ ডাক্তাররাই কিন্তু কখনও নিজেদের দেহ দান করে যেতেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ ডোনারদের কাছে কতটূকু তথ্য থাকত মরদেহ-দান-পরবর্তী ব্যাপারে? কতটূকু জানতেন তারা? একবার অ্যানাটমির এক প্রফেসর আমাকে বলেছিলেন, “তুমি কখনও অস্ত্রোপচারের বীভৎস বর্ণনা রোগীকে দেবে না, কারণ এতে তাদের ছুরি-কাঁচির নিচে যাবার সম্মতি না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।”
আপনি হয়ত ভাবতে পারেন যে, যখন প্রথমবারের মতো মৃতদেহ কাটা-ছেঁড়া করবেন, অদ্ভুত একটা অনুভূতি হবে। এমনটা মনে হলেও আসলে সব কিছু খুব স্বাভাবিক লাগে। উজ্জ্বল আলো, ইস্পাতের টেবিল, বো-টাই পরা প্রফেসরের দল- সবকিছুই কেমন যেন মানিয়ে যায়। অবশ্য প্রথমবার যখন লাশের ঘাড়ের পেছন থেকে একদম পিঠের নিচ পর্যন্ত কাটবেন, সেই স্মৃতি কোনোদিন ভুলবেন না। স্ক্যালপেলটা এতটাই ধারালো, মনে হবে আপনি চামড়া কাটছেন না, চেইন টেনে খুলছেন। পিঠ উন্মুক্ত হয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়ে চামড়ার নিচে লুকিয়ে থাকা-স্পর্শ নিষিদ্ধ অংশ। যতই মানসিক প্রস্তুতি থাকুক না কেন, আপনি নিজেকে তৈরি রাখতে পারবেন না, লজ্জা অনুভূত হবে সেই সাথে উত্তেজনাও বোধ করবেন। মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রাচীনতম এক প্রথা, যেখানে লঙ্ঘন করা হয় চরম অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। সেইসাথে বয়ে আগে এক ঝাঁক অনুভূতি- উত্তেজনা, হতাশা, ঘেন্না কিংবা উল্লাস। অবশ্য সময় গড়ালে পড়ালেখার একঘেয়েমিতে পেয়ে বসাও বিচিত্র কিছু না। আবেগ-অনুভূতির পরিবর্তন হতে সময় নিতো না এখানে- এই মুহূর্তে আপনি মানুষের শরীর নিয়ে সমাজের চরম পবিত্র নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন তো পরের মুহূর্তেই আপনার বারিটো খেতে ইচ্ছে করছে। কারণ ফরমালডিহাইডের প্রভাবে আপনার ক্ষিদে পেয়ে গেছে।
অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে মিডিয়ান নার্ভ কাটবেন, পেলভিস দু’টুকরো করবেন, হৃদপিণ্ড ফাড়বেন; এসব করতে করতে কলেজে করে আসা আর দশটা ক্লাসের মতোই স্বাভাবিক মনে হবে সবকিছু। যেখানে খুঁজে পাবেন ক্লাসের ভাঁড়ের তকমা পাওয়া ছাত্রটিকে কিংবা মাদুলি-কবচ পরিহিত বিচিত্র চরিত্রকে, এছাড়া আরও বাকি শিক্ষার্থীরা তো আছেই। মরদেহ কাটাকুটি করতে করতে নরম মনের, বিনয়ী স্বভাবের ছাত্রটি একসময় পরিণত হয় অনুভূতিহীন, উদ্ধত স্বভাবের ডাক্তারে।
অ্যানাটমি ল্যাবে লাশকে আমরা লাশ না, বস্তু হিসেবে গণ্য করতাম। একেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, টিস্যু, নার্ভ আর পেশীতে রূপ নিতো দেহগুলো। প্রথমদিন ল্যাবে আপনি মৃতদেহের মানবতাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে যখন চামড়া ছুলবেন, পেশী কাটবেন, ফুসফুস কিংবা হৃদপিণ্ড কেটে বের করে আনবেন আর লিভারের লোব ফেলে দেবেন, তখন আর এই টিস্যুর স্তুপকে মানুষ বলে চেনার জো থাকবে না। একসময় অ্যানাটমি ল্যাবে পবিত্রতাকে লঙ্ঘন করা স্বাভাবিক হয়ে আসে। আর এই উপলব্ধিটা বড় রকমের একটা নাড়া দিয়ে যায় সবাইকে। মাঝে মাঝে আমরা নিঃশব্দে মৃতদেহের কাছে ক্ষমা চাইতাম। মানসিক পরিবর্তনটা অনুভব করতে পারতাম বলে ক্ষমা চাইতাম না, বরং অনুভব করতে পারতাম না বলেই এই নীরব ক্ষমাপ্রার্থনা।

খুব শীঘ্রই পল কালানিথির জীবনী 'হোয়েন ব্রেথ বিকামস এয়ার' আসছে আমার অনুবাদে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৪৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×