somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্যাফেটেরিয়ার জীবন

০৯ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাঁটতে হাঁটতে আচমকা থমকে দাঁড়াল পথিক। এতক্ষণ ধরে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিল সে। আশেপাশের দিকে খেয়াল কম দিচ্ছিল, কর্মব্যস্ত জীবন থেকে আজকে একটু তাড়াতাড়িই ফিরছে বাসায়। সবসময় যে পথ দিয়ে আসে আজকে সে পথ দিয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু সামনে যে জায়গাটা দেখতে পাচ্ছে সেটা গে কখনও দেখেনি সে। এ কী করে হয়!
পথিকের সামনে সতেজ দুর্বা ঘাসে ভরা বিশাল একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে। মনে হয় সবুজ কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। মাঠের শেষ সীমানা দেখা যাচ্ছে না। কী অদ্ভূত তো! এতবড় জায়গা এদ্দিন চোখে পড়ল না কেন?
মাঠটাতে বেশ কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। আরেকটু এগিয়ে গেলো সে।
পথিক ভালমতো লক্ষ করতেই দেখতে পেল মাঠটাতে সব তরুণ-তরুণীরা। বয়স্ক-মাঝ বয়েসী কেউ নেই। হাসছে-গল্প করছে, ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসে একমনে কেউ কেউ লিখছে কী যেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো পথিক অবাক চোখে।
মাঠতাতে বেশ কয়েকটা বেতের চেয়ার পেয়ে রাখা হয়েছে। তাতে মুখোমুখি বসে গল্প করছে প্রেমিক-প্রেমিকারা, অনেকে আবার গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে, হাতে ধরা ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। চুমুক দিতে দিতে মন্তব্য করছে একজন, পরমুহর্তেই জবাব ছুঁড়ে দিচ্ছে আরেকজন। কারো কোনো থামাথামি নেই কথার, অনর্গল বলে যাচ্ছে যার যা ইচ্ছে।
সময়টা খুব সুন্দর। শেষ বিকেলের মিইয়ে আসতে থাকা আলো ধরণীর বুকে নরম-মৃদুপ্রায় উষ্ণতা বিলিয়ে দিচ্ছে শেষবারের মতো। হু হু করে বাতাস বইছে। এই সময়ের বাতাসটা ধাক্কা দিয়ে যায় শরীরে, মনে। প্রকৃতি যেন আদুরে হাতে চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে ছেলে-মেয়েদের। কয়েকজন এদিক-ওদিক হাঁটছে উদ্দেশ্যবিহীন ভঙ্গিতে, কারও ঠোঁট সিগারেট ঝুলছে। একদিকে এক তরুণ প্রেমিকার কোলে মাথা দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে তার চোখের দিকে তাকিয়ে। শব্দহীন হাসি ভর্তি মুখ তার। প্রেয়সী মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে গভীর প্রেম চোখে, দীর্ঘ কালো চুলগুলো বাতাসের তালে তালে মুখে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে প্রেমিকের মুখে। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো পথিক। আহা! এরকম শেষ কবে সময় কাটিয়েছিলো সে? মনে করবার চেষ্টা করল। স্মৃতি ধরা দিচ্ছে না। পথিক এবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে খেয়াল করতে লাগল বাকিরা কে কী করছে।
ওই তো দেখা যাচ্ছে এক দঙ্গল তরুণ উচ্চ কণ্ঠে তর্ক জুড়েছে কী নিয়ে যেন। ভরাট কণ্ঠে বেঁটেখাটো আকৃতির কোকড়া চুলের এক তরুণ হাত নেড়ে নেড়ে ব্যাখ্যা করছে কেন এ দেশে বিপ্লবের সূচনা হওয়া দরকার। গভীর মনোযোগে শ্রোতারা শুনছে তার কথা। শ্রোতাদের মাঝে দুয়েকজনের কপালে কুঞ্চিত ভাব, এরা সম্ভবত বিপ্লবের পক্ষে না। মনে মনে পাল্টা যুক্তি খাড়া করছে কোকড়া চুলোর কথা শেষ হবার ফাঁকে। দলটাকে পেছনে ফেলে এলো পথিক।
মাঠের এক কোণায় বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা টং দেখা যাচ্ছে। টং-এর সামনে দুটো বেঞ্চ পেতে রাখা হয়েছে খরিদ্দারদের জন্য। টং না ঠিক, বড়সড় দোকানই বলা যায়। প্রথম দেখায় টং বলে ভুল হবে সবার। একটা বড় চুলোয় গরম গরম জিলিপি ভাজছে শ্যামবর্ণের এক তরুণী। কোমরে শাড়ির আঁচল প্যাঁচ দিয়ে আটকে রেখেছে, বড় হাতায় তুলে তুলে রাখছে সদ্য ভাজা জিলিপি। জুলফি আর কপাল বেয়ে মুক্তো দানার মতো ঘাম বেয়ে পড়ছে উত্তাপের অত্যাচারে। মুখখানা হাসি হাসি, কষ্টই হচ্ছে না তার কোনো। হাতে বানানো এখনও-কাঁচা সমুচারা অপেক্ষা করছে দ্বিতীয় চুলোয় উঠবে কখন। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল পথিক, “চা হবে?” জবাবে কাজ না থামিয়েই মাথা ঝাঁকাল তরুণী। পেছন ফিরে ডাক দিলো কাকে যেন, “অ্যাই রূপম, চা হয়েছে তোমার?”
এবার খেয়াল করল পথিক- দোকানটার পেছনের দেয়াল বলে কিছু নেই। ফাঁকা পুরোটাই, কাঠামো বলতে দুই পাশে দেয়াল আর মাথার উপর ছাদটুকু আছে দোকানের। দেয়ালটাও বাঁশের। সেখানে তারকাটায় ঝোলানো সারি সারি কাঁচের কাপ দেখা যাচ্ছে। একেকটা কাপের রঙ আর নকশা একেক রকম। উজ্জ্বল রঙের সমাহার সেখানে, বেশিক্ষণ দেখলে চোখ ঝিম ঝিম করে, নেশা নেশা ভাব হয়। তরুণীর হাঁক শুনে পেছন দিকে ব্যস্ত রূপম নামের তরুণ জবাব দিলো চেঁচিয়ে, “হ্যাঁ! হয়ে গেছে এই আরেকটু!”
দোকানের পেছনে দুটো বড় বড় কেটলিতে চা চাপানো হয়েছে। সামনে ভাজাভুজি আর পেছনে চায়ের ব্যবস্থা - মনে মনে হাসল পথিক। এ কী অদ্ভূত স্থাপত্যবিদ্যা রে বাবা!
খাবারের ফরমায়েশ দিয়ে খালি বেঞ্চে বসে পড়ল পথিক। একাই সে। বাকি সবাই মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বেঞ্চ থেকে একটু দূরে তিন-চারজন তরুণী গোল হয়ে ঘাসে বসে আছে। তাদের একজন গিটার নিয়ে গান গাইছে। সুরটা চেনা চেনা লাগছে, দূর থেকে কথাগুলো স্পষ্ট না। বাতাসের তোড়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে এতটা পথ পেরিয়ে আসতে গিয়ে। গাইয়ে মেয়েটার চোখ আধ-খোলা, গানের ভেতরে ডুবে গেছে সে।
বেঞ্চ থেকে উঠে সেদিকে পা বাড়াল পথিক। একলা একলা ব্যস্ত কয়েকজনকে দেখতে পাচ্ছে সে। তাদের কাউকে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করবে- কোন জায়গা এটা? কোত্থেকে উদয় হলো? এতদিন কেন দেখেনি সে?
বাদামী রঙের সুতির পাঞ্জাবি আর কালো প্যান্ট পরা এক তরুণ নিবিষ্ট মনে কী যেন লিখছে মাথা নিচু করে। সবার থেকে আলাদা হয়ে আছে সে। তার মতো আরও কয়েকজন আছে। একজন চায়ের কাপ হাতে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে উদাস চোখে। প্রবল বাতাসে চা এতক্ষণে ঠাণ্ডা পানি হয়ে গেছে নিশ্চিত। সে দিকে তার ভ্রূক্ষেপই নেই। বাতাস, বিকেল, অলসতা আর পরিবেশ উপভোগ করছে সে। দিনটা বুক ভরে দম নেবার মতো একটা দিন।
চা-ওয়ালার সামনে গিয়ে বসল পথিক। তার দিকে তাকায়নি উদাসী তরুণ। নিজ থেকেই কথা শুরু করল পথিক। “ইয়ে, বিরক্ত করলাম না তো?” প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনল তরুণ। “জ্বি করেছেন। তবে করেছেনই যখন, বলে ফেলুন কিছু বলতে চাইলে।” তরুণের কথা শুনে থতমত খেতে গিয়েও খেলো না পথিক। বেশ কিছুক্ষণ ধরে থতমত ছাড়া অন্য কিছু খায়নি সে, আবার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। “এটা কোন জায়গা? আমি এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করি। কখনো মাঠটা দেখিনি। আজকে কোত্থেকে এলো?...আমার কথা শুনে অবাক হবেন না প্লীজ।”
পথিকের প্রশ্ন শুনে হাসল তরুণ। চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল সবুজ কার্পেটে। “এই জায়গায় জীবনে খুব কম মানুষই আসতে পারে। যারা জীবনকে জীবনের মতো করে দেখে। কোনো হিংস্রতা, উগ্রতা, ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে ধরে রাখার মনোভাব যারা পুষে রাখে না- তারাই এই জায়গায় আসতে পারে। এখানে সবাই তরুণ, সবাই তরুণী। কেউ বার্ধক্যে পতিত না, কেউ জীবন নিয়ে চিন্তিত না, কেউ উন্নতি-অবনতি নিয়ে ভাবান্বিত না, কেউ অর্থ লোভী না এখানে, শ্রেণিবিভেদ নেই, ধর্ম নিয়ে রক্তক্ষয় নেই।
এখানে মানুষ কথা বলতে পারে, যে কথা সাদামাটা জীবনে বুকে জমিয়ে রাখতে হয়। এখানে ইচ্ছামতো ভালোবাসা যায়, ইচ্ছামতো হাসা যায়-কাঁদা যায়। শর্ত ছাড়া, পরিকল্পনা ছাড়া আলোচনা করা যায়, যুক্তি দেয়া যায় আবার যুক্তি খণ্ডন করা যায়। এই জায়গার নাম জীবন। তারুণ্যের জীবন। যে জীবনের দেখা তরুণ বয়সেও অনেকে পায় না।”

একদমে কথা বলে লম্বা শ্বাস ফেলল তরুণ। কাপটা তুলে ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিলো। চুমুক দেবার ফাঁকে ভাষণের তোড়ে ভাষা হারানো পথিককে পর্যবেক্ষণ করছে।
“তা-তাহলে আমি কেন এলাম এখানে? আমি তো তরুণ নই। তারুণ্য ফেলে এসেছি অনেক আগেই,” ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল পথিক।
“তা জানি না। হয়তো পথ ভুলে চলে এসেছেন, হয়তো আর কোনো দিন আসতে পারবেন না। কিংবা পুরানো জীবনে ফিরতে পারবেন না। আমরা যারা আছি এখানে, তারা বাস্তবকে মেনে নিতে না পেরে এখানে ঠাই নিয়েছি আজীবনের জন্য। দেহটা আছে আপনার জগতে, মনটা এখানে।”
তরুণের কথা শুনে মাথা ঝিম ঝিম করছে পথিকের। হ্যালুসিনেশন কি এত দীর্ঘ সময় ধরে হয়? নাকি তার মাথা খারাপ হয়ে গেলো? নাকি সে রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়ে কোমায় গিয়ে এসব দেখছে?
কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াল সে। বাড়ি ফিরতে হবে, এই জগত তার না, সে অনাহুত অতিথি এখানে। পুরনো, চিরচেনা, অভ্যস্ত জীবনের রাস্তাটা কোনদিকে…? পথ হারাল নাকি শেষ বিকেলের আলোয়?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:২৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×