somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্ধ আততায়ীবৃন্দ-২ (শেষ)

১০ ই মার্চ, ২০১০ বিকাল ৪:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব এখানে

আলামুতে, মার্কা পোলোর ভাষ্যমতে, গড়ে উঠেছিল এক ‘স্বর্গের নন্দনকানন’ (Garden of earthly delights)। মনে রাখতে হবে, মার্কা পোলো এখানটায় এসেছিলেন আলামুত ধ্বংস হওয়ার পরে, হাসানের মৃত্যুরও প্রায় দেড়শ’ বছর পরে, ১২৭২-৩ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং, তাঁর পক্ষে বাগানটা দেখা সম্ভবপর ছিলো না। যাহোক, এরপর যা বলবো তা গল্প হিসেবেই ধরে নেবেন, ইতিহাস-গবেষকদের চোখরাঙানি মানছি না।
বাগানটা ছিলো দুই পাহাড়ের মাঝখানে। সেখানে কোরানবর্ণিত এক সুরম্য উদ্যানে ছিলো জায়গায় জায়গায় সোনা, রুপো, মুক্তো, হিরের মতো কৃত্রিম রঙে রাঙানো অট্টালিকা। গাছে গাছে পাখিরা নতুন আগন্তুকদের কোরানি বাক্যে অভ্যর্থনা জানাতো “সালামু আলায়কুম তিব্তম ফাদখুলুহা খালেদিন, সালামুন কাওলাম্মের রাব্বির রাহিম” ইত্যাদি বলে। আশিশিন হতে ইচ্ছুক না হলে ওখানে কাউকে আনা হতো না। আলামুতের দরবারে থাকা ১২ থেকে ২০ বছরের নানান বিশ্বাসী ছেলেদের হ্যাশিশ খাইয়ে আনা হতো বাগানে। বলা হয়, কাজভিন থেকে তাদের হ্যাশিশ মেশানো শরাব খাইয়ে বেহুঁশ করে গাধার পিঠে করে বয়ে আনা হতো বাগানে, সাধারণত ৪/৬/১০ জনকে একত্রে আনা হতো। সেখানে জায়গায় জায়গায় বইছে মধু, দুধ, শরাবের নহর। ছিলো শরাব আর বিশুদ্ধ পাহাড়ি জলের ঝর্ণা। নবীন অ্যাসাসিনেরা জেগে দেখতো তাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে স্বর্গবেশ্যারা (হুরি) । তাদেরও আনা হতো নানা জায়গা থেকে অপহরণ করে। তারা নাচতো, গাইতো, সুমধুর বাদ্য বাজাতো, মনোরঞ্জন করতো তাদের নানা উপায়ে। কিভাবে? রবার্ট অ্যান্টন উইলসন তাঁর ‘প্রমিথিউস রাইজিং’ বইতে যা বলছেন তার বিবরণ এখানে ইনজিরিতেই রাখছি।
As he drifted into an ecstatic daze, the girls would go to work on the initiate, giving him a full-body tongue massage, while one girl performed oral sex on him. Eventually, the bedazzled young man would climax into the girl's mouth "as softly and slowly and blissfully as a single snowflake falling."
আহা, স্বর্গসুখ আর কাকে বলে!! এরপরে কি আর গুরুবাক্যের অবাধ্য হওয়া যায়?
আবার তাদের মর্ত্যভূমিতে নিয়ে আসা হতো এবং বলা হতো মৃত্যু হলে আবারো এই স্বর্গেই ফিরে আসবে তারা।
তো, কোন প্রশ্ন?
না। পরিপূর্ণ আনুগত্য এবং আত্মসমর্পণ। তাই মৃত্যুই কাম্য হোক। আধুনিক অ্যাসাসিনেরা অবশ্য আরো মহান মস্তিষ্কের অধিকারী। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাগে না তাদের, শুনেই বা পড়েই হয়ে যায়!
অবশ্য, এই বিবরণের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন অনেকেই। কারণ, মার্কো পোলোর এই বিবরণ যখন লেখা তার প্রায় ২০ বছর আগেই আলামুত দুর্গ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আর, তাছাড়া, হাসান তাঁর দুর্গে সাংঘাতিক কঠোর শরিয়া আইন বজায় রাখতেন। তাঁর দুই পুত্রের তিনি প্রাণদণ্ডের বিধান দিয়েছিলেন-একজনের মদ্যপানের অপরাধে, অন্যজনের চুরির অভিযোগে। এমনকি, বাশিঁ বাজানোর অপরাধে একজনকে দুর্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁর বংশের কেউ তাঁর মৃত্যুর পর আলামুতের উত্তরাধিকারী হয় নি। সুতরাং, তাঁর পক্ষে কাউকে নেশাগ্রস্ত করিয়ে বা কল্পিত স্বর্গের শরাবন তহুরা পান করিয়ে উদ্বুদ্ধ করার প্রশ্নই উঠতো না। আর, তাছাড়া, চেঙ্গিজের নাতি হালাকু খান যখন দুর্গটি ধ্বংস করেন ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে, তখন তাঁর সাথে একজন ‘এমবেডেড’ ঐতিহাসিক ছিলেন বছর ত্রিশেক বয়েসের। তাঁর নাম আতা মালিক জুয়াইনি। তিনি সেসময় একটা বই লিখছিলেন বা তাঁকে লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। বইটার নাম ‘তারিখ-ই-জাহান গুশা’ বা ‘বিশ্ববিজয়ীর ইতিহাস’। ওটাতে এসবের কোন উল্লেখই নেই। আগুন লাগিয়ে দেয়ার আগে একমাত্র তিনিই ঢুকতে পেরেছিলেন অ্যাসাসিনদের গোপন গ্রন্থাগারে এবং সেখান থেকে তাঁর উদ্ধার করা বইগুলোই মূলত হাসান এবং অ্যাসাসিনদের সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়, যার মধ্যে হাসানের আত্মজীবনীও ছিল বলে মনে করা হয়।
অ্যাসাসিন নামের অন্য অনুমিত উৎসগুলো হচ্ছে: ১) নামটা এসেছে হাসানের অনুসারী ‘হাসানিন’ শব্দ থেকে; ২) নিজারিদের বলা হতো তারা আলামুতের নাম দিয়েছিলো ‘আল-আসাস’ বা ‘মৌলভিত্তি’। কারণ, হাসান চাইতেন আলামুতই হবে তাঁর সব কাজের ভিত্তি। এবং, এর কারণেই আল-আসাসের সদস্যদের নাম দেয়া হয় ‘আল-আসাসিন’।
আপনার মন মতো বেছে নেয়ার ইচ্ছে আপনার আছে। বিশ্বাস করুন, এটার নাম অবশ্যই মুক্তবুদ্ধির চর্চা নয়।
প্রায় ১৬৬ বছর ধরে অ্যাসাসিনেরা সমগ্র ইসলাম সাম্রাজ্যে এক আতঙ্কের শিহরণ বইয়ে দিয়েছিলো। তাদের ছুরির ধার থেকে মুক্ত ছিলো না বাদশাহ থেকে শুরু করে কেউই। হাসান এক শাসককে চিঠিতে লিখেছিলেন, “সুলতানের মতো ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু তাঁর চাইতে অনেক বেশি ক্ষতি আমি করার ক্ষমতা রাখি।” সমস্যা ছিলো যে তারা ছিলো আত্মঘাতী, আর তাদের কিভাবেই বা আটকানো যায়? নিজের জীবনের মায়াই যার নেই, তাকে বাঁধবে কে? হাসানের শিক্ষা গুঞ্জরিত হতো তাদের মাথায়, “তোমরা এই পৃথিবীর জন্যে নও, এর পরেরটার জন্যে। পুকুরের মাছ কি ভয় পায় যদি তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় সাগরে?” বস্তুত, হাসানের শিক্ষা বোধহয় আজও কাজ করে চলে।
যাহোক, কোন সালতানাত আলামুতের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে নি। এমনকি, হাসান মৃত্যুবরণ করার পরেও নয়। তিনি ৯০ বছর বয়েসে মারা যান, অর্থাৎ, ১১২৪ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু, আলামুতের পতন ঘটে হালাকু খানের কাছে, ১২৫৬ সালে। তিনি প্রশংসা করেছিলেন দুর্গের আত্মরক্ষা ব্যবস্থার এবং হাসানের। হুকুম দিয়েছিলেন আগুন লাগাতে, প্রতিটি ইট ধ্বংস করতে এবং বিশেষত গ্রন্থাগারটা যেন ধ্বংস হয় সেব্যাপারে বিশেষ নির্দেশ ছিল তাঁর। সাত রাত আর সাত দিন ধরে জ্বলেছিলো আগুন। সেই শেষ হল আলামুতের।
এর মধ্যে ওমরের জায়গা কোথায়?
কিম্বদন্তী, ওমরের ‘সমরখন্দ পাণ্ডুলিপি’ থাকতো হাসানের নিজস্ব কক্ষে। ওটা ওমরের কাছ থেকে চুরি যায় এবং এরপর থেকে আলামুতে হাসানের ঘরের একটা জালে-ঢাকা এলাকায় ওটা সংরক্ষিত থাকতো। হাসান ওমরকে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন তাঁর অধিকৃত দুর্গে আসার জন্যে।
ওহ্, এই প্রসঙ্গে হাসানের ঘরটার কথাও একটু বলি। পুবপাশের একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে দুর্গের নিচের অংশে ঢুকতে হতো। সেখানে ঢালু জায়গাটার পাশে ছিলো ক’টা মাটির ঘর, দুর্গের উঁচু মূল অংশে যেতে একটা খোলা ময়দান পেরুতে হতো। মাঠটার পশ্চিম দিকটা ছিলো তুলনামূলকভাবে সরু। ওই সরু পথটার ওপারেই ছিলো দুর্গটা, হাসানের ঘরটা ছিলো এর ওপরেই। পুরো ঘরে জানালা ছিলো ঠিক একটা, মাঠের দিকটায়। ঘরটা যেন দুর্গের ভেতর আরেক দুর্গ। হাসান ওই ঘরে ঢোকার পর জীবনের শেষ ত্রিশ বছরে মাত্র দু’বার বেরিয়েছিলেন, দু’বারই উঠেছিলেন দুর্গের ছাদে, সম্ভবত দেখেছিলেন দুর্গের দুর্ভেদ্যতা। আকাশ দেখেছিলেন কি? তাঁর জীবনকাহিনিতে এই তথ্যের উল্লেখ নেই।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি ওখানে একটা মাদুরে বসেই কাটাতেন, মাদুরটা ঠিক করা হয় নি বা বদলানোও নয়। নিজের পড়ালেখা, আত্মঘাতী শিষ্যদের শিক্ষাদান-সবই চলতো ওই ঘরের ভেতরে। নামাজ পড়তেন পাঁচ ওয়াক্ত, ওই মাদুরের ওপরেই। কেউ দেখা করতে এলে তার সাথে কথাও বলতেন ওই মাদুরে বসেই।
তাঁর পাশে ছিলো না কেউই। শুধু পাথর আর ভয় দিয়ে গড়া তাঁর পরিপার্শ্ব। শুধু অপ্রেম, শুধু সংঘ, আর আরো উঁচুতে, আরো উঁচুতে, আলবুর্জের আরো ওপরে ওঠার নিরন্তর স্বপ্ন।
শুধু ওমরের প্রতি ছিলো বুঝি অহৈতুকী প্রীতি। মা’আলোফ জানাচ্ছেন, একবার ওমরকে পত্রাঘাত করেছিলেন তিনি, লিখেছিলেন, “পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর চাইতে আপনি আলামুতে আসছেন না কেন? আমি এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে করতে নিজেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছি। এখানে আপনি নিরাপদেই থাকবেন, আপনার যত্ন হবে, সম্মান পাবেন। পৃথিবীর কোন শক্তি আপনার চুলও স্পর্শ করতে পারবে না। এখানে একটা বিশাল গ্রন্থাগার করেছি, আপনার লেখাপড়াও হবে। এখানে শান্তি পাবেন আপনি।”
ওমর আসেন নি।
সূর্যের আলো শেষ দেখেন তিনি ১১৩১ খ্রিস্টাব্দে।
আর তখন আলামুত আতঙ্ক আর সমান্তরাল ক্ষমতার এক কেন্দ্র।
সেলজুক সাম্রাজ্য হাত মিলিয়েছে তার সাথে, করেছে চুক্তি। যদি কোথাও নাজিরি ইসমাইলিদের বাধা দেয়া হলো, তো মৃত্যু অবধারিত। হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হতো সাধারণত শুক্রবারে, দ্বিপ্রাহরিক উপাসনার সময়।
হত্যাকারীর উদয় ঘটতো আকস্মিকভাবে, কিন্তু, কিভাবে তারা নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করতো? জবাব নেই। শিকার মৃত, কিন্তু অ্যাসাসিন পালাতো না; ধরা দিতো আর তারস্বরে ঘোষণা করতো নিজের বিশ্বাসের কথা। রক্ষীরাই তাকে খুন করতো, প্রায়শই তাৎক্ষণিকভাবে। আর আলামুত সম্পর্কে কৌতূহলী হতো লোকেরা, আগ্রহ বাড়তো।
এদিকে আলামুতে হাসানের মৃত্যুর পরে কঠোরতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। চতুর্থ প্রজন্মের আরেক হাসানের হাতে, যাকে মনে করা হতো ইমাম মাহদি, অবশেষে এই অতুলকঠোর ব্যবস্থার অবসান ঘটে। তিনি নিশ্চয় পড়েছিলেন ওমরের রুবাইসমগ্র, আপ্লুত হয়েছিলেন এর স্বর্গীয় সৌরভে, মদমত্ত হয়ে উঠেছিলেন এর সৌন্দর্যের স্পর্শে।
১১৬৪ খ্রিস্টাব্দ, ৮ অগস্ট।
তিনি উঠে এলেন মঞ্চে। পরনে তাঁর সাদা আলখেল্লা। অনবদ্য এবং তুমুল বিস্ময়াবহ তাঁর ভাষণে তিনি জানালেন,
“বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব বাসিন্দা-জিন, ইনসান আর ফেরেশতারা শোন, ইমাম মাহদি তোমাদের আশীর্বাদ করছে আর তোমাদের সব পাপ ক্ষমা করা হলো, অতীত এবং ভবিষ্যতেরও। সে তোমাদের বলছে গোপন আইন বাতিল করা হলো, পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যে বিধান করেছিলেন তা স্বর্গ অর্জনের জন্যে আর নিঃসন্দেহে তোমরা সেই স্বর্গ অর্জন করেছো। আজ থেকে স্বর্গ তোমাদের। আইনত তোমারা এখন মুক্ত। যা কিছু এতদিন নিষিদ্ধ ছিলো সব এখন থেকে বৈধ। আর যা কিছু বিঘ্নসৃষ্টিকারী তা এখন নিষিদ্ধ। দিনে পাঁচবার উপাসনা নিষিদ্ধ, প্রয়োজনহীন-কেননা আমরা এখন স্বর্গে আছি এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে আমরা এখন সরাসরি সম্পৃক্ত, সেজন্য নির্দিষ্ট সময়ে তাঁকে আর নিয়ম করে ডাকার দরকার নেই। যারা ওই কাজ করবে-তারা এই পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করে না বলেই ধরে নিতে হবে। উপাসনাকে এখন থেকে অবিশ্বাসীদের কাজ বলেই গণ্য করা হলো।
অন্যদিকে সুরা পবিত্র কোরানে স্বর্গের পানীয় বলে উল্লিখিত, এখন থেকে যারা সুরা পান করবে না, তাদেরই ইমানে ঘাটতি আছে বলে ধরে নেয়া হবে।”
পুরো সমাবেশ তখন আনন্দের তুঙ্গে। হাসান সাব্বাহ যা চেয়েছিলেন, ঘটেছিলো ঠিক তার বিপরীতটাই। আলামুত এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোয় ইসমাইলিয়াদের অন্য সম্প্রদায়গুলোর কাছে দূত পাঠানো হলো। সবাইকে বলা হলো ঘোষণার দিনটি পবিত্র মনে করার জন্যে, নিচে ছিলো হাসানের স্বাক্ষর। হিজরি, গ্রিক এবং নিশাপুরের ওমর খৈয়ামের তৈরি পঞ্জিকা অনুসরণে দিনটা নির্ধারিত হয়। ওমরের নামের আগে লেখা হয়, “দুই জাহানের সবচে’ জ্ঞানী ব্যক্তি”।
এভাবেই আলামুতের জীবন হয়ে উঠে আনন্দময়, হাসান সাব্বাহ-র আলামুতকে ‘বীরের পুণ্যভূমি’ করার পরিকল্পনা ওখানেই থেমে যায়, ইসলামি রাজ্যগুলোতে থেমে যায় গুপ্তহত্যা, ইসমাইলিয়াদের তিনটি গোত্র মিলে যায় একটিতে। এবং এরপর থেকে ইসমাইলিয়ারা পরিণত হয় রীতিমত ধৈর্যশীল সুফিবাদি এক গোত্রে। আজও তারা আছে, তবে তাদের নেতা আগা খান, আর সংগঠনটা নিতান্তই নিরীহ ধর্মপালনকারী।
কিন্তু, অ্যাসাসিনদের প্রভাব থেমে থাকে নি। ক্রুসেডারেরা তাদের সাথে পরিচিত হয়ে এই সংগঠনের শিক্ষা বয়ে নিয়ে যায় ইউরোপখণ্ডে। নানান রহস্যময় এবং গুপ্ত ভ্রাতৃসংঘে বয়ে চলে অ্যাসাসিনদের ধর্ম এবং কর্মপদ্ধতি। বলা হয়, দ্য টেম্পলারস, দ্য সোসাইটি অব জেসস, প্রায়রি দ্যো সায়ন, ফ্রিম্যাসনস, দ্য রোজিক্রুসিয়ানস, সবাই যেন হাসানের ভাবশিষ্য। অ্যাডাম পারফ্রে-র অ্যাপোক্যালিপ্স কালচার গ্রন্থে টিম ও’ নিল এই প্রভাবের কাহিনি বিস্তৃত করেছেন।
এমনকি, সিআইএ-ও। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে গুয়াতেমালায় মোসাদিক সরকারের বিরুদ্ধে এক গোপন অভিযানে সিআইএ নিজের এজেন্টদের নিযুক্ত করার সময় তাদের হাতে একটা ১,৪০০ পৃষ্ঠার ফাইল ধরিয়ে দেয়। কিভাবে নিজেদের কাজ সারতে হবে তা ওখানে লেখা ছিলো। প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালটার নাম ছিলো ‘আ স্টাডি অব অ্যাসাসিনেশন’। আজও প্রাসঙ্গিক!
এমনকি, সাহিত্যেও। বলা হয় শেক্সপিয়র প্রথম ইংরেজিতে ‘অ্যাসাসিন’ শব্দটি ব্যবহার করেন আর ড্যান ব্রাউন তো রীতিমত তাঁর 'অ্যাঞ্জেলস এন্ড ডেমনস' বইতে একজন অ্যাসাসিনকে দ্বিতীয় খলনায়ক হিসেবেই এনেছেন। এমনকি, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের আফিমের ঘোরে পাওয়া সুখ্যাত কবিতা ‘কুবলা খান’-এও আলামুত আর অ্যাসাসিনদের কিছুটা প্রভাব ছিলো বলে অনেকে মনে করেন। বিটনিক জেনারেশনের লেখকেরাও এড়াতে পারেন নি এর প্রভাব, মানে, মাদক আর হাসান দু’য়েরই। ব্রায়ান গাইসিন নামের এক লেখক ও চিত্রী তাঁর একাধিক কবিতায় হাসানের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর সাথে হাসানের পরিচয় ঘটান ঔপন্যাসিক ও সুরস্রষ্টা পল বোয়েলস। গাইসিন আবার সে- তথ্য সরবরাহ করেন উইলিয়াম এস, বোরোস-কে। তিনি লিখলেন “দ্য লাস্ট ওয়ার্ডস অব হাসান সাব্বাহ” নামে এক চমৎকার কবিতা। আরেক দক্ষ সুরকার বিল লসওয়েল ১৯৯৯ সালে তো রীতিমত একখানা অ্যালবামই বের করে ফেলেন হাশিশিন: এন্ড অব দ্য ল নামে। খুঁজে দেখলে হয়তো এমনি আরো অনেক পাওয়া যাবে।
যাক, আমার কথাটি ফুরলো, আর কি কি হলো তা আর বলে কাজ কি?
শুধু একটি কথাই বলবো। এই লেখা কোন ধর্মীয় গোত্র সম্পর্কে পরীবাদের কোন উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত নয়। শুধু, ধর্মের নামে মানুষ কতটা হিংস্র হয়ে ওঠে, তার কিছু বর্ণনা দেয়া আর আমার প্রিয় এক কবির এতে অনীহ সংশ্লিষ্টতার কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। হাসান আজও অনেকের আদর্শ হতে পারেন, তাঁর একনিষ্ঠতা আর বিশ্বাসের প্রগাঢ়তার জন্যে। ওমরের রুবাইয়ের রসাস্বাদন করার আমন্ত্রণ করার জানিয়ে এখানেই তুলে রাখছি আমার দুর্বল লেখনীখানি।
এই লেখাটি লেখার জন্যে আমি মূলত অনুপ্রাণিত হই আমিন মা’আলোফ-এর ‘সমরখন্দ’ উপন্যাসটি পড়ে, যার কথা বলেছি আগেই। এছাড়া, নিচের লেখাগুলো থেকেও ইচ্ছেমত তথ্যাদি নিয়ে লেখাটির কলেবর বৃহদায়তন করেছি।
১) আমিন মা’আলোফ, সমরখন্দ, অনু: আবীর হাসান, সন্দেশ, ঢাকা, ২০০৯। (বেশ ভালো বই; রাজনীতি, ধর্মান্ধতা, হিংস্রতা, কবিতা, প্রেম, আর সবার ওপরে-ইতিহাস)
২) বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান, সঙ্কলক: মোহাম্মদ মতিওর রহমান, সম্পাদক: মনজুরুর রহমান, বাংলা একাডেমী, তৃতীয় সংস্করণ, ঢাকা, ২০০০। (নিজের সম্প্রদায় সম্পর্কে প্রশংসা এবং অন্যদের সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, এবং বেশ কিছু অনৈতিহাসিক তথ্যে বইটি ভর্তি)
৩) http://en.wikipedia.org/wiki/Hassan-i_Sabbah (উইকির নিজস্ব তথ্যভাণ্ডার, তবে পূর্ণাঙ্গ নয়)।
4)http://old.disinfo.com/archive/pages/dossier/id985/pg1/index.html (দারুণ তথ্যসংকলন, অনেক লিংক পাবেন আরো জানতে চাইলে)।
5) Click This Link ( সিআইএ ম্যানুয়ালটা এখানে পাবেন)
6) http://www.akdn.org (ইসমাইলিয়াদের বর্তমান মানবসেবাময় সংগঠনের নাম)
7) Click This Link (ফিলিপ কে. হিট্টি-র অল্প জায়গায় ভালো তথ্যসংকলন)
8) Click This Link (আমার পড়া সবচাইতে তথ্যঋদ্ধ উপকরণ, অবশ্যই পড়া উচিত)।
9) Click This Link (ব্রিটানিকার হাস্যকর সামান্য উপাদান)।
10) Click This Link (বিল লসওয়েলের এ্যালবামের পুরোটাই পাবেন এখানে)।

৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×