তাবিজের বইয়ের তালিকা মতে, কুমকুম, জাফরান, লাল চন্দন ও মেশকের গুড়া মিশিয়ে লাল কালি বানানো হল। নাহ! কালি যেভাবে লাল হবার দরকার ছিল সে মানের হয়নি। লাল কালির মেজেন্টা পাউডার যোগ করলাম, কালি চিকচিক করে উঠল! মেজেন্টা রংয়ের কথা কিতাবে ছিলনা, আমি নিজে যোগ করলাম। রাজমোহিনী বিদ্যার হাতে লিখা কিতাবের বই থেকে আবিষ্কার করেছিলাম, তাবিজের গুন দ্রুত কার্যকর করতে কবুতরের তাজা রক্ত যোগ করতে হবে। ফলে একজোড়া কবুতর কোরবান হল, রক্ত দিয়ে সেই ঐতিহাসিক তাবিজ, মালেক মৌলভীর মত করে, বড় আদব কায়দার সহিত লিখিত হল! কবুতর জোড়ার একটি দিয়ে সূপ এবং অন্যটি দিয়ে আমার জন্য রসালো খাবার জন্য রান্না হল। আমিও পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম ভাবীও তাঁর তাবিজ পেয়ে আনন্দিত হলেন!
মাস তিনেক পরে এক মহিলাকে আমাদের ঘরে আম্মার পা ধরে পড়ে থাকতে দেখলাম! আমার আম্মা তার কাছে মাফ চাইছেন, সেই মহিলা আম্মার কাছে মাফ চাইছেন! এ ধরনের মাফ চাওয়ার বিরল ঘটনা আমাকে অতিমাত্রায় কৌতূহলী করে তুলল। মাকে প্রশ্ন করলাম কি হয়েছে? মা বললেন কোন কথা না বলে এখুনি এখান থেকে চলে যাও। সেই মহিলা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাউ মাউ করে বলে উঠল, বাবা যাইও না, আমার দুটি কথা শুনে যাও! অবশেষে যা বুঝলাম, এই মহিলার এক কন্যার ১০ বছর ধরে সন্তান হচ্ছেনা, তিনিও একটি তাবিজের আশায় বাড়ীতে এসেছেন। আমার আম্মা এতে কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। তাই তিনি হঠাৎ করে আম্মার পা ধরে বসেছেন। অগত্যা কাউকে কিছু না বলার শর্তে তাকেও একটি তাবিজ লিখে দিলাম।
এক সম্ভ্রাম্ভ ধনী লোকের বউ পাগল হল, তিনি লজ্জা শরমে এই কথা বাহিরে বলতে চাচ্ছেন না। তাঁর মেয়ে আছে, এই কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে, মেয়েদের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। তাই তিনি গোপনে কাজটি সাড়তে চাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক কে কেউ আমার কথা বলেছে, তাই তারা আমার কথাই স্মরণ করছিল। সে হিসেবে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য, আমাদের এক নির্ভরযোগ্য আত্মীয়কে মাধ্যম হিসেবে ধরল। এই বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাথে মা আমাকে ভিন্ন কাজে কয়েক জায়গায় পাঠিয়েছিলেন। সেই ব্যক্তির সাথেই ধনী লোকের বাড়ীতে গমন। গিয়ে দেখি ভদ্রমহিলা চিৎকার করছেন। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভদ্রলোক বললেন, সবার বিশ্বাস তোমার দ্ধারা আমাদের উপকার হবে। কাউকে মূল ঘটনা বলতে পারছিনা, তুমি কিছু দোয়া কালাম পড়ে আমার স্ত্রীকে ঝেড়ে দাও। ‘অনুরোধে ঢেঁকি গেলা’ বাগধারাটি বইয়ে পড়লেও আজ হাতে হাতে তার প্রমাণ পেলাম। যাক, যখন দোয়া পড়তে গেলাম তখন দেখি মহিলা আরো জোড়ে চিল্লাচ্ছে। ভাবলাম দেখিনা আবদুল কাদেরের পরামর্শ কোন কাজে আসে কিনা! হুবহু সেভাবেই করলাম যা আমি ইতিপূর্বে দুই তিন জন রোগীর ক্ষেত্রে দেখেছি। আধা ঘণ্টার মধ্যেই রোগী ভাল হয়ে গেল। ভদ্রলোক আমাকে আশ্চর্য করে দেবার মত পরিমাণ, টাকা দিতে চাইল, আমি না নিয়ে বিদায় হয়ে আসি। ঘটনাটি আমি গোপন রেখেছিলাম বটে, তবে নজির আহমেদ এর কারণে, সে বিষয়টি বিরাট এলাকার কোথাও আর গোপন থাকেনি!
এর পর থেকে চারিদিকে নানা-কথা কানাঘুষা শুরু হল। আমি বুঝতে পারলাম এসব কানাঘুষা আমাকে নিয়েই। মানুষ বলে বেড়াচ্ছে, আমি স্বপ্নে কোন জ্ঞান পেয়েছি, কেউ বলছেন কোন ভাল জিন আমার বশ্যতা স্বীকার করেছে, কেউবা বলছেন, এই বালক একদিন পড় পীর-বুজুর্গ হবেন। রাস্তা দিয়ে চলার সময় বড়োরাও আমাকে সালাম করছিল, বাজারে গেলে ফ্রি চা খাওয়ানোর হিড়িক পড়ে যাচ্ছিল। সর্বত্র অনাহুত ইজ্জত মর্যাদা পেতে লাগলাম! বন্ধুরা বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিল, মুরুব্বীদের রাজ্যের কৌতূহল আমাকে ঘিরে। আমি যেন এই এলাকার নতুন কোন আগন্তুক! মানুষ বলাবলি করতে থাকল, ও যদি সাধারণ বালক হবে, তাহলে তার তাবিজে কিভাবে তের বছর ও দশ বছর পরে মানুষের বাচ্চা হয়! এটা তো দিনের মত পরিষ্কার একটি বিষয়। সে কোনদিন মাদ্রাসায় পড়েনি, অথচ আরবি লিখতে পারে। সে কোনদিন গ্রামের বাহিরে যায় নাই, অথচ অজানা কত মন্ত্র বিড়বিড় করে পড়ে ফেলে। নিশ্চয়ই এসব কিছু গায়েবী ব্যাপার স্যাপার।
অনেকে রাস্তা ঘাটে একটি তাবিজের জন্য বায়না ধরে। যেহেতু রাস্তা ঘাটে আমি তাবিজের বান্ডিল নিয়ে চলাফেরা করিনা, তাই ঘটনাস্থলে তাদের আবদার পূরণ করতে পারিনা। কেউ বলে একটু পানি পড়া দাও, পানি পড়া দিতে যেহেতু পূর্ব প্রস্তুতি লাগেনা তাই কাউকে সুবিধা মত পানি পড়া দিয়ে দিতাম। একদা চট্টগ্রামে ফাতেহা ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে খাবার শুরু করত না। ফাতেহা পড়তেন মৌলভীরা। মেঝ ভাই মাদ্রাসায় পড়েন, তাই তাকে সামাজিক ভাবে ফাতেহা পড়া ও পানি পড়ার কাজ প্রতিনিয়ত করতে হত। শবে কদর, শবে বরাত, মোহররম, মীলাদুন্নবীতে ফাতেহা ও পানি পড়ার ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে তিনি আমাকে এসব শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর অবর্তমানে আমিও কখনও কাউকে, ফাতেহার জট থেকে মুক্তি দিতাম। তাই পানি পড়ার দোয়া সমূহ আমার জানা ছিল।
এতদিন বাজারে, দোকানে অনেকে আমাকে কলা, পেয়ারা, চা খাইয়ে যে মন দখল করেছিল তাদের মতলব পরিষ্কার হওয়া শুরু হল। তারা দাবী করতে থাকল, আমার ঐ কাজটি সফল হবার জন্য একটি তাবিজ বানিয়ে এনো। বুঝতে পারলাম একটা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা এসব করেছে। ফ্রি খাওয়ার মজা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তাই যাদের নিকট থেকে ফ্রি চা, কলা, পেয়ারা, পেঁপে খেয়েছি, তারা আমার জন্য নতুন বিরক্তির কারণ হল। অগত্যা যাদের নিকট থেকে ফ্রি খেয়েছি, তাদের জন্য গোপনে তাবিজ লিখে পরিত্রাণ পেতে চাইলাম।
এখন কেউ ডাকলে ভুলেও ফ্রি খাইনা। তাই মানুষ এবার জোড় করে আমার পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিতে লাগল। টাকা নেবার ক্ষেত্রে আমার পক্ষ থেকে না শব্দ শুনতেই চাইত না। এক পক্ষীয় প্রেমে পাগলা মজনুরা, সন্ধ্যায় আমার বাড়ী যাবার পথে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত! বয়সে বড় এসব প্রেম-কাতর ব্যক্তিরা কাঁচুমাচু ও শরম মার্কা চেহারা নিয়ে আমার কাছে দাবী করত, একটি ভালবাসা সৃষ্টির তাবিজ দিতে। টাকা কড়ি যাই লাগে, আমার চাহিদা পূরণ করা হবে! কারো গ্রামের পাশ দিয়ে যাবার সময়, কেউ আমাকে বলে বসল, তোমার ফুফু আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছে, তোমাকে যেতে বলেছে। বিশ্বাস করে সাথে গিয়ে আরেক মুসিবতে পড়তাম। মহিলাদের যন্ত্রণা সইবার মত নয়, একবার এদের খপ্পরে পড়লে নিস্তার নাই। দলে দলে মহিলা হুমড়ি খেয়ে পড়ত, কার কথা শুনব কি উত্তর দিব বুঝে আসত না। মহিলাদের দাবী গুলো ভিন্ন ধরনের হত, জিনের আছর থেকে মুক্তি, স্বামীর মনকে বাধ্য করা যাতে স্ত্রী ব্যতীত কিছুই চিন্তা না করে, সতিনের সাথে গোলমালে জিতে থাকা, সতিনের ছেলেকে দুর্বল করা, প্রতিবেশীকে পরাস্ত করা, শত্রুকে খতম করা, কারো মনে তাবিজের জোড়ে দখলে রাখা ইত্যাদি! আমার কথা কেউ শুনতে চাইত না, শুধু তাদের কথাই বলতে থাকে। অতি আবেগে কেউ আমাকে টিপু বাবা হিসেবে ডাকতে থাকে। এত অল্প বয়সে অতিমাত্রার ইজ্জত আমাকে কখনও কখনও গর্বিত করে তুলত! বয়সে বড় জনেরা প্রেমের জন্য তাবিজ চাইলে বড় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতাম।
আগের পর্ব: বাবাকে দিয়েই প্রথম যাদু-মন্ত্রের সফলতা যাচাই! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-১০ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।