somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয় ইতিহাসের বরণীয় নারী

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আমার এই লেখাটি ১৪/১৬ ডিসেম্বর ২০০৯ দৈনিক সমকালে প্রকাশ হয়েছিল)

যেভাবেই বলি না কেন এটাই সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। আর এই ইতিহাসের বিনির্মানের তালিকায় নানাভাবে উপেক্ষিত রয়েছে নারীর অবদান। ৭১এ নারীর ভূমিকার কথা উঠলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে সম্ভ্রমহানী আর হাসপাতালের সেবিকার চরিত্রের কথা। তাও আবার গল্পছলে সেটাও নির্বাকই থাকে। ৭১এর ইতিহাসেও রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য। স্বাধীন দেশে নারীর মহান আত্বত্যাগ কিংবা শহীদের তালিকা অথবা বীরত্বপুর্ণ বহু ঘটনা রয়ে গেছে দৃষ্টির আড়ালে। তেমনি কিছু তথ্য এখানে দেয়া হল।

শহীদ চারুবালা
বাড়ীর চৌকাঠের বাইরে তেমন পরিচিত না হলেও ৭১’এর ২ মার্চ শহীদ চারুবালার মৃত্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে যশোরের রাজপথ। যশোরের নারীরা ঝাড়– মিছিল বের করে। এই অসহযোগ আন্দোলন পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের শক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।

শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা
বাবা ক্যান্সারে মারা গেলে পরিবারের অন্ন যোগাতে পত্রিকায় কপি লেখা আর প্র“ফ দেখার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। সেসময়ের প্রায় সব পত্রিকাতেই তাঁর কবিতা ছাপা হত। কিন্তু সংসারের অন্ন যোগাতে গিয়ে এক সময় সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চির চেনা মুখটির অনুপস্থিতি চলতে থাকে। কিন্তু ছোটদুটি ভাইকে তো মানুষ করতে হবে। তাই নিজের সম্ভাবনা ভুলে পরিশ্রম করে গেলেন দিনরাত। এরই মাঝে “সাত কোটি জয় বাংলার বীর! ভয় করি নাকো কোন/ বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে- চির বিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে/ আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি/ চির বিজয়ের অটল শপথ/ জয় এ বাংলায় তুমি....” এই কবিতাটি জানান দেয় বিপ্লবের কথা। পাকি শাসক গোষ্ঠীর প্রতি ছুড়ে দেয়া এই চ্যালেঞ্জে ক্ষমতার ভীত কেঁপে উঠে। তাই তো ২৭ মার্চ ১৯৭১ মিরপুরে প্রতিবেশী বিহারীরা তাঁকে ও তাঁর ছোট দুই ভাইকে বৃদ্ধা মায়ের সামনে ছুড়ি দিয়ে খুঁিচয়ে খুঁিচয়ে হত্যা করে। লোকমুখে শোনা যায়, শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার মাথা কেঁটে কাপড় শোকানোর দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিন
বাংলাদেশকে পঙ্গু করতে ১৪ ডিসেম্বর যেসব মেধাবী সন্তানকে হত্যা করেছিল রাজাকাররা, তাদেরই একজন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিন। ১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় নিজ বাড়ীর ভাড়াটে এসে যখন বলল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেতে হবে, তখন ছেলে সুমন ও দূর সম্পর্কের ভাই সাথে যেতে চাইলেও যেতে পারেনি। সেলিনা বলেছিলেন. “ওরা নিয়ে যাচ্ছেন ওরাই বাড়ী দিয়ে যাবেন”
রায়ের বাজার বদ্ধভূমিতে চোখে গামছা বাধা, সাদা মোজা-জুতা পরিহিতা অবস্থায় পাওয়া যায় গুলিবিদ্ধ তাঁর লাশ।

শহীদ লুৎফুন্নাহার হেলেন
ষাটের দশকের বাম রাজনীতির এই নেত্রী ছিলেন মাগুড়া জেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। গ্রামের বাড়ীতে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে ৫ অক্টোবর শহীদ হন তিনি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তথ্য আদায়ের নামে তাঁকে করা হয় বিভৎস মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। শেষে তাঁকে হত্যা করে জিপের পেছনে লাশ বেঁধে রাস্তার উপর দিয়ে টানতে টানতে মাগুড়া শহরের নবগঙ্গার ড্রাইভারশন ক্যানেল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়।

শহীদ ভগিরথী সাহা
মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে কাজ করতেন তিনি। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়েছিল কয়েকটি অপারেশন। ১৩ সেপ্টেম্বর তাকে বন্দী করা হয়। অতঃপর সুবেদার সেলিম একটি মটর সাইকেলের পেছনে তাকে বেঁধে সদর রাস্তার দিকে টেনে আনা হয়। বলেশ্বর নদীর তীরে যখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাঁর পরিধেয় কাপড় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন। তবু প্রাণ আছে ভেবে সুবেদার সেলিম গুলি করে ভগিরথীকে নদীতে ফেলে দিয়ে যায়।

শহীদ ভ্রমর
সৈয়দপুর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিতমুখ ভ্রমরের অপরাধ ছিল, তিনি ২১ শে ফেব্র“য়ারী পালন করতেন এবং নির্বাচনে তিনি আ.লীগের হয়ে কাজ করেছেন। তাই ১৫ এপ্রিল ১৯৭১ বিহারিরা তাঁকে হত্যা করে বাশেঁর সঙ্গে তাঁর লাশ বেঁধে সারা শহর প্রদক্ষিণ করায়।

শহীদ কাঁকেট
খাসিয়া মেয়ে কাঁকেট তখন ২০/২২ বছরের। মুক্তিবাহিনীকে রাজাকারদের গতিবিধি, অবস্থান ইত্যাদি জানায়। যার প্রেক্ষিতে একটি বড় অপারেশন পরিচালিত হয়। রাজাকাররা তাঁকে সন্দেহ করে পাক সেনাদের তাঁর কথা জানালে, পাক সেনারা ধরে নিয়ে যায় তাঁকে। চলে তথ্য আদায়ে অকথ্য নির্যাতন। তবু তিনি একজন মুক্তিসেনার কথাও জানাননি সেদিন। অত্যাচারে অত্যাচারে একদিন তিনি শহীদ হন।

প্রিনছা খেঁ
প্রিনছা খেঁ ছিলেন রাখাইন স¤প্রদায়ের মেয়ে। ৭১এর মাঝামাঝি পাক আর্মির তৃতীয় বাবুর্চি হিসেবে কাজ শুরু করেন। জ্বালানী কাঠ সংগ্রহকারী বাবুলের সাথে যুক্তি করে অসুস্থতার ভান করে ঝালকাঠিতে ডাক্তারের কাছে আসা যাওয়া শুরু করে। আর ডাক্তারও তাঁকে সাহায্য করতে সৈনিকদের জানালেন যে তিনি অন্তঃসত্ত্বা। তাই প্রতি চারদিন অন্তর তাঁকে আসতে হবে চেকআপের জন্য। অতঃপর এক সন্ধায় ডাক্তারের কাছ থেকে বিষ এনে প্রথমে দুই বাবুর্চিকে খাইয়ে পরে খাবারে মিশিয়ে সরবরাহ করেন পাক সেনাদের। ১৪জন সেনা সেখানেই মারা যায়। বাকিদের ঢাকায় চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।

এমনি আরো শত সহস্র জানা না জানা ঘটনা,গল্প রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও নারীর অবদানকে ঘিরে। এই লেখাটিতে নারীকে মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহ প্রদানকারী, সেবিকা, ধর্ষিতা এসব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। বরং এটি তাদের অন্যরকম অনন্য কিছু উদাহরণ দেয়ার চেষ্টা মাত্র। তারামন বিবি (বীরপ্রতীক), ক্যাপ্টেন ডা. সেতারা বেগম (বীরপ্রতীক), মুক্তিযোদ্ধা কাকঁন বিবি এই তিনকে যেদিন আমরা চিনেছি, তারপর আবারো আমরা অপেক্ষায় কবে আবার নতুন কাউকে চেনাবে কেউ। ৭১এর ভূমিকাকে নানা ভাগে ভাগ করলে দেখা যাবে প্রায় সবকটা বিভাগেই নারীর অবিষ্মরণীয় অবদান রয়েছে। শুধুমাত্র সেক্টর কমান্ডার ছাড়া আর কোথায় নেই নারী! ##
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×