বছর খানেক প্রচেষ্টা ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারকে ঘিরে। আমাদের চেষ্টার কোন কমতি ছিল না কক্সবাজারকে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চার্য হিসেবে সেভেন ওয়ান্ডার্স প্রতিযোগীতায় টিকিয়ে রাখার। কত রকম প্রচারণা, কত ভোট কত কিছু। আর বরাবরের মতো সর্বোচ্চ ভোট নিয়ে এগিয়ে ছিল আমাদের প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্যটি। কিন্তু সব হিসেবকে পাল্টে দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিযোগীতায় নাম লেখালো সুন্দরবন। আমাদেরও ভোটের নাম পাল্টে গেল। নানা রকম প্রচারণা চলল। যেকোন ইমেইল একাউন্ট থেকে সর্বোচ্চ একটি আর মোবাইল থেকে যত খুশি তত ভোট দেয়া যাবে। প্রথম দিকে তেমন তোড়জোড় না থাকল্ওে শেষ এক মাসে এসে সারা দেশ ব্যাপী প্রচারণা আর তোলপাড় ফেলে দিল এই ভোটিং। সবচেয়ে চমৎকার লাগল যখন দেখলাম ঢা.বি.’র টিএসসি চত্বরে পুলিশ আর মানুষ এক কাতারে এসে ভোটিং নিয়ে ক্যাম্পেইন করা শুরু করলো। ইতিমধ্যে দেশে বড় বড় কনসার্টও হয়ে গেছে ভোট ফর সুন্দরবন নামে। একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেল আবার মাঝেমাঝে সেই কনসার্টের অংশবিশেষও প্রচার করেছে ক্ষণে ক্ষণে। আর এদিকে মোবাইল কোম্পানীগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছে নিয়মিত এসএমএস পাঠিয়েছে কিভাবে তার অপারেটরটিকে ব্যবহার করে ভোট দেয়া যাবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটিকে সেরা সাতে টিকিয়ে রাখার জন্য। দেশের বড়বড় শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক, এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থী কেউই বাকি ছিল না প্রায় এই হিসেবটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এত লোকের এত প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত বৃথা গেল মাঝ রাত্তিরের ফলাফল ঘোষণায়। সেরা ১৪ তে সুন্দরবন জায়গা করে নিতে পারলেও সেরা ৭-এ থাকতে পারেনি। অনেকের মাঝে চূড়ান্ত হতাশা বিরাজ করছে ফলাফল ঘোষণার পর থেকে। আমি চেষ্টা করেছিলাম কে কত ভোট পেয়েছে তা জানার জন্য। কিন্তু কোন তথ্য পাইনি এখন পর্যন্ত। (এই লেখাটি চলাকালীন)
যারা মনে কষ্ট পেয়েছে, তারা সবাই দেশ প্রেমের তাড়নায় কষ্ট পেয়েছে। কারণ একটি সুন্দরবন শুধুমাত্র বাংলাদেশের একটি অংশ না হয়ে এক্ষেত্রে সমগ্র বাংলাদেশ হয়ে গিয়েছিল। সুন্দরবন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধি। সারা পৃথিবীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে লড়াই করা আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ যখন মনোকষ্টে ভুগছে তখন সেভেন ওয়ান্ডার্স কর্তৃপক্ষ আর আপামর জনসাধারণের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করা মোবাইল কোম্পানীগুলো কি মুখ গোমড়া করে বসে আছে? বোধহয় না। কারণ, তাদের ব্যবসা যা হবার তা হয়ে গেছে। মানুষ দেশকে ভালবেসে তাদের ভান্ডারে উজার করে দিয়েছে কষ্টার্জিত অর্থের এক একটি অংশ। তাদের এই দেশের প্রতি কতটা দায় আছে সে প্রশ্ন করার যোগ্যতা আমার হয়ত নেই। তবে যেখানে ব্র্যান্ডিং এর সুযোগ ছিল সেখানেই তারা ছিল। তবে কোন এক আশ্চার্য কারণে কেউই সুন্দরবনকে ভোট দেয়ার জন্য এসএমএস খরচ ফ্রি তো দূরের কথা বরং এক পয়স্ওা কমায়নি। আর তার চেয়েও অবাক বিষয় হচ্ছে, যেখানে সরকারের বড় বড় ব্যক্তি বা মন্ত্রীরা এই প্রচারণায় কখনো কখনো অংশ নিয়েছেন সেখানে তারা সরকারী খরচে চলা টেলিটক থেকেও এসএমএস ফ্রি করতে পারেনি, সুন্দরবনকে ভোট দেয়ার ব্যপারে। যে দেশের বৃহত্তর অংশ এখনো পরের বেলা চাল কেনার অর্থ যোগর করতে পারে না, সে দেশের জনগণ কিভাবে কিভাবে ভোট দেবে মোবাইলের মাধ্যমে? এতো আর আঞ্চলিক নির্বাচন নয় যে গেলাম ভোট দিলাম চলে আসলাম। এখানে ভোট মানে পকেটের পয়সা খরচ। তবুও আমি দেখেছি, টিএসসির মোড়ে রিক্সাওয়ালাকে মোবাইলের মাধ্যমে ভোট দিতে (অপরের সাহায্য নিয়ে)।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি সুন্দরবন সেরা সাতে না থাকায়। কারণ সুন্দরবন যদি সেরাতে টিকে থাকতো, তবে এখানে অনেক পর্যটক আসতো। তাদের জন্য সুন্দরবনে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য রিসোর্ট নামে অট্টালিকা নির্মাণ হতো। যেমনটা হয়েছে কক্সবাজারের ক্ষেত্রে। কক্সবাজারে আর কিছুদিন পর হয়ত উন্মুক্ত সমুদ্র সৈকত থাকবে না। সেগুলো হয়ে যাবে না না হোটেল আর রিসোর্টের নামে। সেখানে এখন বিরাজ করছে প্রকৃতির মাঝে অট্টালিকার বস্তি। ফলে সেই হোটেলের ড্রেনেজ, বর্জ কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। একই ভাবে সুন্দরবন হয়ে উঠতো উন্নয়নের ভাগাড়। পর্যটকবান্ধব করতে গিয়ে তার প্রাকৃতিক বিকাশ হতো বিনষ্ট আর পর্যটকদের আপ্যায়নে হরিণ হতো গ্রিল। কারণ আমার অনেক বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সমাপনী উপলক্ষে সুন্দরবন গিয়ে বন রক্ষীদের আঁতাতে হরিণের মাংস ভক্ষণ করার কথা আমাকে জানিয়েছিল ছাত্রজীবনে।
তাই, আধুনিকতার বৈরিতার হাত থেকে সুন্দরবন বেঁচে য্ওায়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আনন্দিত। তব্ওু প্রশ্ন থাকে, সরকারী বা বেসরকারী মোবাইল কোম্পানীগুলো কি ব্যবসার বাইরে একটু দায়বোধ অনুভব করতে পারল না দেশের প্রতি, সরকার কি একবারও ভাবতে পারলো না ফ্রি এসএমএস’র ব্যপারে? না কি তারাও আমার মতো সুন্দরবনকে তার মতো বেড়ে উঠার সুযোগ দিতে চেয়েছিল?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




