somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা এর কথা....

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকদিন বাদে ব্লগে লিখছি, কেমন যেন লাগছে! না লেখার অভ্যেস থেকে কিনা জানিনা! আসলে আমাদের জীবনের উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল গত কয়েক মাস ধরে.. আজ একটি সংগ্রামী মায়ের জীবনের কথা লিখব, জানিনা কতটুকু এর বাস্তবতা তুলে ধরতে পারব এই লেখায়!
এই মা, আসলে আমার প্রয়াত শাশুরী আম্মা--যে আমাদের পরিবারের নিউক্লিয়াস ছিল, যে সবাইকে পরম মমতায় এক আঁচলে ধরে রেখেছিল এতগুলো বছর এই সুদুর নিউ ইয়র্ক শহরে! মা মাত্র ২৯ বছরে ১৯৭১ সালে বিধবা হয়েছিলেন ৪টি ছোট ছোট সন্তান নিয়ে, সেই অকাল বিধবা কন্যাকে পরম স্নেহে নিজ ঘরে তুলে এনেছিলেন তার বাবা, মানে আমার নানা শশুড়। আমার স্বামী তখন শিশুমাত্র, অন্য ভাইবোন দের নিয়ে নিজেদের শহরের বিশাল বাসা ছেড়ে মফঃস্বলের নানাবাড়ীতে আরও অসংখ্য আত্বীয়স্বজনদের সাথে থাকা শুরু কর।...ঘন ঘন ফিট হতেন মা, সেই সাথে খিটমিটে মেজাজ , না খেয়ে থাকতেন বেলার পর বেলা, বাচ্চা গুলোর অসহায় অবস্থা! নানা শশুড় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মেয়েকে আবার বিয়ে দিতে, কিন্তু মা অনড়! খুবই রুপসী ছিলেন উনি, তায় ধনী বাবার একমাত্র কন্যা--এতগুলো ছেলেমেয়ে সহও অনেকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে লাগলেন..কিনতু মা রইলেন শক্ত পাথরের মত অনড়!..দিন কেটে গেল, কেটে গেল অনেকগুলো বছর, ছেলেদের ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করে দিলেন, ওরা মানুষ হয়ে গেল--আমার প্রচন্ড মেধাবী স্বামী টিপিক্যাল ক্যাডেটদের দুস্টুমীর পাশাপাশি খুবি ভাল রেজাল্ট করে বুয়েটে ভর্তি হয়ে গেলেন, ---ওর পড়াকালীন সময়েই মা তার বড়ভাইয়ের মাধ্যমে আমারিকা চলে এলেন ৭০ সালের শেষের দিকে। তারপর একেএকে সবাই..আমার স্বামীও বুয়েট শেষ করে মাস্টার্স করলেন আমেরিকায়, চাকুরী শুরু করলেন, অন্য দুই বোনরাও বিয়ে করে চাকুরি, অতঃপর বিশাল বড় একটা বাড়ী কিনলেন সবাই মিলে শহরতলীতে (suburb)। সবাই মা কে নিয়ে এক সাথে থাকা শুরু করলেন---মা এর কি খুশি! যেন নতুন সংসার পেলেন! সারাদিন উনিই ঘর গোছান, বাগান করেন, রান্না করেন-- ছেলে মেয়ে, মেয়ের জামাইরা সবাই কাজ করে, মা এর হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে উনারাও খুশি। এর পরে একসময় আমিও ঐ বাড়ীতে এলাম বৌ হয়ে, কি যে আদর সবার!..আমি তখন বুয়েটের পড়া ছেড়ে এসেছি, চেস্টা করছি ট্রান্সফার স্টুডেন্ট হয়ে কোন ভাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য! ৯ মাস ছিলাম ঐ বাসায়, এর পর ভর্তি হয়ে ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি বাসা নিয়েছিলাম। ঐ সময় অত বাড়ীতে সারাদিন আমি আর শাশুরী মা থাকতাম, সবাই তো কাজে থাকত। অবাক হয়ে দেখতাম উনি সারাদিন কিছু না কিছু কাজ করছেনই... নিজ নাতীকে দেখার পাশাপাশি আরেকটা বাচ্চা বেবিসিট করতেন, ঘর গোছাতেন, বাগান পরিচর্যা, রান্না..আরও কতকি! মা'র কাজ দেখতে দেখতে আমিই ক্লান্ত হয়ে যেতাম, অথচ উনি আমাকে দিয়ে কিছু করাতেন না..আমি বসে বসে পোর্টফোলিও বানাতাম অ্যাডমিশনের জন্য! উনার হাতের ছোয়ায় সবকিছু সুন্দর হয়ে উঠত! এত পরিপাটি করে ঘর গোছাতেন দেখে আমার একটু হিংসা হত এই ভেবে যে, আমি আর্কিটেক্চারের স্টুডেন্ট হয়েও এত ভাল গোছাতে/অরগানাইজ্ড পারিনা কেন!
কত সময় বয়ে গেল..যেন নদীর মত-- সবার এখন আলাদা, আলাদা বাড়ী! মা ভাগাভাগি করে সবার বাসাতেই থাকতেন, যেন কেউ কস্ট না পায়, শুধু একটাই আবদার ছিল, যেন কেউ নিউ ইয়র্ক ছেড়ে না যায় অন্য কোন স্টেটে--সবাই যেন এক সাথেই থাকে এক শহরে! সবাই চেস্টাও করেছিলাম মায়ের কথাটা রাখতে---শুধু আমার দেবরটা একটু জেদী, ও ফ্লোরিডা থাকত একা একা, ওর জন্য মা সবসময় দুঃচিন্তা করত! হায়রে এখন আর কেউ নেই আমাদের নিয়ে এত চিন্তা করার!
গত বছরের গোড়া থেকেই মা অন্য রকম হয়ে গেলেন, খাওয়া দাওয়া কমে গেল একে বারেই..খুব বাবার কথা বলতেন, বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাইতেন..কিন্তু কিভাবে যাবেন? সবাই এখানে সেটেল্ড! নাতি, নাতনিরা সব অ্যামেরিকানদের মত হয়ে গেছে---কেউ দেশে যেতে চায়না, মেয়ে জামাইরাও একটু অন্য রকম, একটু আত্বকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন! কত ডাক্তার দেখানো হলো, কিছুই ধরা পরেনা! এসময় হসপটালাইজ্ড হয়ে পড়লেন, ওনার মত শক্ত মানুষ কেমন শিশু হয়ে গেলেন..একে একে কঠিন কঠিন রোগ ধরা পড়ল, কেউ চেস্টার ত্রুটি রাখলনা--সবচাইতে ভাল হসপিটালে, ভাল হোম কেয়ার, দিনরাত সবার উপস্থিতি---কোন কিছুই মা কে ভাল করতে পারলনা! আমাদের বাসা থেকে হসপিটালটা ৩৫ মাইল দুরে ছিল, একরাত আমি, পরের রাত আমার স্বামী , এভাবে পালা করে গভীর রাত পর্যন্ত থাকতাম ওনার বেডের পাশে বসে! দিনে ওনার মেয়েরা থাকত পালা করে..শেষের দিকে ঐ হসপিটালের ফ্যামিলি রুমে শুধু আমাদের পরিবারের সবাই, অন্য পেশেন্ট দের আত্বয়ীরা বাইরে দিয়ে হাটাহাটি করত আর বিরক্ত হত!
শেষের দিকে মা কে বেশ কিছুদিন আর্টিফিশিয়াল ভেনটিলেটর দিয়ে রাখা হয়েছিল, ডাক্তাররাও খানিকটা আপসেট হয়ে গিয়েছিল যে, কেন আমরা তাকে এত কস্ট দিচ্ছি, কেন তাকে নরমালি পৃথিবী ছেড়ে যেতে দিচ্ছিনা!...ডাক্তারদের এমন কথা শুনলে ওরা ভাইবোনরা ফূঁপিয়ে কেদে উঠত, কিছুতেই কিছু শুনতনা!..একদিন সব শেষ হয়ে গেল, একদিন ব্রিদিং মেশিন এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেল , হার্টরেট শুন্য হয়ে গেল...৩১ শে জুলাই এই বছরে মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন একেবারেই! আর ফিরে যাওয়া হলনা উনার নিজ মাতৃভূমিতে!
মা কে এখানেই কবর দেয়া হয়েছে, কারন আমরা সবাই আছি এই শহরেই..ছেলেমেয়েরা ওনার প্রতিদিন একবার করে হলেও কবরস্তানে যায়, কেঁদে হালকা হতে চায়, ----নিঃস্তবদ্ধ কবরস্তানের খাঁ খাঁ শুন্য হাওয়া বয়ে যায়, রাজহাঁসগুলো ডানা ঝাপটায়, সবার দুচোখের শুকনো কান্না মাউন্ট সিনাই শহরের অচেনা মাটিতে আর যেন মিশতে চায়না!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:১৪
১৭টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×