৯
মোটা মোসলেমের ছবি জোগাড় হলো সহজেই। সাপ্তাহিক রূপসা সংবাদ-এর রিপোর্টার কমল কান্তি পাড়ার লোক। আমরা তাকে ডাকি ককা’দা বলে। ছবি তার বাসাতেই এক ফাইলে ছিল। এলাকারই এক ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণী সভা। মোটা মোসলেম প্রধান অতিথি। বিজয়ীর হাতে কাপ তুলে দিচ্ছে। মুখে দেঁতো হাসি। বললাম, দুদিনের ভেতর ছবি ফেরত দেব।
‘ছবি নিয়ে কী করবে?’ জিজ্ঞেস করল ককা।
উত্তর আগেই রেডি করে রেখেছিলাম। বললাম,
‘দৌলতপুরে নন্দঘোষ মার্ডার কেসের কথা তো জানেন। বছর খানেক আগের ঘটনা। ভরদুপুরে মোকামে বসা অবস্থায় খুন হয় নন্দঘোষ। খুনিদের সাথে মোটা মোসলেম ছিল। নন্দঘোষের কর্মচারীদের ছবিটা দেখাতে চাই আমি। যদি আইডেন্টিফাই করতে পারে? বাবার উকিলই এ পরামর্শ দিয়েছে।’
‘চিনতে পারলেও মোসলেমের বিরু দ্ধে আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষী দেবে বলে মনে হয় না। শোনো সঞ্জয়, আমি কিন্তু এসবের ভেতরে নেই। তোমাকে ছবি দিয়েছি, এটাও কাউকে বলতে পারবে না। ক্রাইম রিপোর্ট আমি করি। পত্রিকার কাটতি বাড়ে। সম্পাদক পছন্দ করেন। তবে ওগুলো ‘রিকশাঅলা কর্তৃক মেথরানী ধর্ষিত’ টাইপের হয়। বড় বড় চাঁইদের ঘাঁটাতে জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টাররাই সাহস পায় না! ককা কিছু লিখতে গেলে ফান্দে পড়িয়া বকা কান্দেরে অবস্থা হবে।’
ছবি মন্ময় চৌধুরীর হাতে পৌঁছে দিলাম। বললেন, দুদিন পর বিকেল তিনটের দিকে তার দোকানে যাওয়ার জন্য। আরও জানালেন, বাসায় যেন বলে আসি ফিরতে একদিন দেরি হবে।
১০
পরদিন ইনস্যুলিন কিনে জেলে বাবার সাথে দেখা করতে গেলাম। তার ডায়বেটিস আছে। রেগুলার ইনস্যুলিন নেন। বাবার ইনস্যুলিন শেষ। সকাল ন’টায় দরখাস্ত জমা দিয়ে জেলগেটে বাসে আছি। চারদিকে পানের পিক, চুনের দাগ, কলার খোসা, বিড়ির মাথা, প্রস্রাবের ঝাঁঝালো গন্ধ। সাব ইন্সপেক্টরকে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট, একশো টাকা দিয়েছি। দালাল নিয়েছে বিশ। বড় সাহেব এখনো আসেননি। অপেক্ষা করছি তো করছিই। এগারোটার দিকে তিনটা মোটরসাইকেলে পাঁচজন রাজনৈতিক কর্মী সঙ্গে নিয়ে মোটা মোসলেম এসে হাজির। সাব ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়িয়ে গেল। বিষয় কী? তার দুজন ‘ছেলে’ জেলহাজতে আছে। আজকেই বেইল হবে। অথচ তাদের জেল পুলিশ কোর্টে চালান করেনি। সাব ইন্সপেক্টর বলল,
‘বড় ভাই, কোনো চিন্তা করবেন না। দুজন কনস্টেবল দিয়ে এখনই রিকশা করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। বসেন, চা খান। আমি কাগজপত্র রেডি করি। চালানে জেলার সাহেবের সই লাগবে। উনি এখনো অফিসে আসেন নাই। সেটা কোনো ব্যাপার না। সেপাইয়ের হাতে দিয়ে কাগজ পাঠাচ্ছি। সই নিয়ে আসবে। বাসা কাছেই, বেশিক্ষণ লাগবে না। এই হামিদ, ভাইয়ের জন্য ডবল পাতি চা আন। দুধ-চিনি বেশি। সাথে হুগলী বেকারির কেক।’
আমাকে দালাল বলল,
‘ভাই, কালকে আসেন। আজ দেরি হবে। ওপর থেকে চাপ আছে। সাহেব ব্যস্ত।’
রাগে আমার গা কাঁপতে লাগল।
১১
পরদিন জেলে যেতে পারলাম না। মন্ময় চৌধুরীর সাথে দেখা করার কথা, গেলাম সেখানে। আমাকে বসতে বলে ড্রয়ার খুলে বেল কাঠে তৈরি ফুট খানেক লম্বা একটা মূর্তি বের করলেন বাবু। তার কারিগর বানিয়েছে। হাতে নিয়ে দেখলাম ভেতরটা ফাঁপা। কিছুক্ষণ পর জিপে করে রওনা হলাম আমরা।
‘আরও আগে বের হলে ভালো হতো না?’ গাড়ি ছাড়ার পর বললাম আমি।
‘না, হতো না। দিনের বেলা ওখানে যেতে চাই না আমি। সন্ধ্যা আটটা নাগাদ পৌঁছাব আমরা।’
ড্রাইভারকে গোয়ালন্দ বাজারে গাড়ি পার্ক করতে বললেন মন্ময়। পাশেই বড় বড় গোডাউন। চিটে গুড়ের মিষ্টি গন্ধে আকাশ-বাতাস সয়লাব। মালপত্র সমেত দুজন দুটো রিকশায় উঠলাম। দৌলতদিয়ার নিষিদ্ধ পল্লি এখান থেকে চার মাইল দূরে। মাঝবয়সী রিকশাঅলা জিজ্ঞেস করল,
‘স্যার, আপনারা কোন জাগাত যাবেন?’
‘দৌলতদিয়া,’ বললাম আমি।
‘দৌলতদিয়ার কুথায়? ফেরিঘাট, না মাগিপাড়া?’
‘পাড়ায় চলো।’
‘কুড়ি ট্যাকা ভাড়া দিবেন।’
‘কুড়ি টাকাই পাবে, চলো।’
হেরিং বোন্ড রাস্তা। ঝাঁকুনি প্রচণ্ড। রিকশার সিট ছোট। সামনের দিকে ঢালু। বসে থাকা দায়। একবার হুড ধরতে হচ্ছে, আরেকবার রিকশাঅলার সিট। চারদিক ফাঁকা। হু হু ঠান্ডা বাতাস। গুমগুম করে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি শুরু হলে ভিজে ন্যাতা হতে হবে। চর এলাকা, একটা গাছ পর্যন্ত কোথাও নেই। শুধু কাশবন। হঠাৎ পুরো ব্যাপারটিকেই মনে হলো এক অবাস্তব অলীক কল্পনা। আবার এ-ও মনে হলো, আমি এসব কেন করছি? শুধুই প্রতিশোধ, নাকি অদম্য কৌতূহল?
ঘণ্টা খানেক পর ভিজে-পুড়ে যেখানে এসে পৌঁছালাম, সে এক অন্য জগৎ। এখানে কারেন্ট নেই। দোকানে দোকানে হ্যাজাক বাতি। ঘরে ঘরে হারিকেন। অগুনতি ছোট-বড় ঘর, গলি-ঘুপচি। দোকানপাট, ঘরবাড়ি, বাঁশ চাটাই, টিন দিয়ে বানানো। দেদার বিক্রি হচ্ছে পান, সিগারেট, ফুল, বাংলা মদ। কালো কুচকুচে ইয়াবড় কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে পেঁয়াজু, ডালপুরি। ছোট মাইকে গান বাজছে: নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে ও ভোমরা। অনেকগুলো ঘরে শুধু একদিকেই চাটাইয়ের বেড়া। মাটির উঁচু মেঝেতে বাঁশের মাচা। সেজেগুঁজে খোলামেলা শাড়ি, সালওয়ার কামিজ পরে বসে আছে সুবর্ণ কঙ্কন পরা স্বাস্থ্যবতী রমণীরা। খিলখিল হাসি। মাঝেমাঝে গানের কলি। আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন। তবে একটি জিনিস ভালো এদের। উগ্র সাজগোঁজ, ঝ্যালঝেলে মেকাপের বালাই নেই।
বুড়ো এক লোক আমাদের ঘর দেখিয়ে দিল। সরু দরজা, দুুদিকে দুটো কাঠের জানালা, মাটির মেঝে। ঘর পুরো খালি। মন্ময় চৌধুরী পাকা লোক। আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। মন্ময় বুড়োকে দুশো টাকা দিয়ে কী যেন বললেন। কিছুক্ষণ পর লোকটা আমাদের মিশকালো দুটো মোরগ আর একটি কেরোসিনের স্টোভ দিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে হুড়কো লাগিয়ে দিলেন বাবু। ব্যাগ খুলে টুকিটাকি অনেক জিনিস বের করলেন। টকটকে লাল সিঁদুর দিয়ে উল্টো করে বড় একটা ত্রিভুজ আঁকলেন মেঝেতে। ওটার ওপর সোজা আরেকটি ত্রিভুজ। দেখতে হলো ছয় কোনা তারা। তারাটাকে ঘিরে দিলেন আতপ চালের গুঁড়োয় আঁকা প্রকাণ্ড একটি বৃত্ত দিয়ে। ত্রিভুজের ভেতর ছয়টি কোণে সাপের কাটা লেজ, পেঁচার নখ, বাদুড়ের মাথা, ঘোড়ার খুর, শিশুর পাঁজরের হাড়, বানরের থাবা রাখলেন। বৃত্তচাপ এবং তারার পয়েন্টগুলো মিলে আরও ছয়টি কোণ তৈরি করেছে। এরপর এই কোণগুলোতে হালকা লাল রঙের কালি দিয়ে অদ্ভুত সব চিহ্ন আঁকলেন। নতুন একটা ধুতি বের করে আমাকে বললেন পরে নিতে। দুটো ত্রিভুজের মাঝখানে যে পেন্টাগ্রাম তৈরি হয়েছে, ঠিক সেখানে মোরগ দুটো জবাই করলেন। রক্তে মাখামাখি হলো জায়গাটা। শুকনো বালুমাটি খুব দ্রুত রক্ত শুষে নিল। এরপর সেখানে বাঘছাল বিছিয়ে আমাকে বললেন খালি গায়ে পদ্মাসনে বসতে।
হালকা লাল রঙের যে কালিতে চিহ্ন এঁকেছিলেন, সেই তরলের কিছুটা কাঠের মূর্তিটার ভেতর ঢেলে এক চুমুক খেতে বললেন। খেতে খারাপ লাগল না। ঘিয়ের গন্ধ পেলাম। মূর্তিটা ফিরিয়ে নিয়ে বাংলায় লেখা একটা সংস্কৃত মন্ত্র খুব ধীরে একশো চুয়াল্লিশবার পড়তে বললেন। মাটির মালসায় মরা একটা চড়ুই পাখি রেখে ঢেকে দিলেন সরা দিয়ে। কেরোসিনের স্টোভ জ্বেলে তার ওপর মালসাটা রেখে সবটুকু সলতে উসকে দিলেন। লাল গনগনে হয়ে উঠল মালসা। ঘণ্টা খানেক পর আঁচ কমিয়ে সরা যখন তুললেন, তখন দেখলাম, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে চড়–ই। এক চিমটে ছাই তুলে, যে তরলটুকু এখনো বাকি ছিল, তার সাথে মেশালেন মন্ময়। আমাকে বললেন পুরোটা খেয়ে ফেলতে। এইবার চড়–ইয়ের বাকি ছাইটুকু বৃত্তের চারপাশে ছিটিয়ে দিলেন। অন্য একটি কাগজ বের করে দু’লাইনের আর একটি মন্ত্র আমার হাতে দিয়ে বললেন আবারও একশো চুয়াল্লিশবার পড়তে।
মন্ত্র পড়তে শুরু করার পরই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগল। মনে হলো, ঘরের তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে গেছে। দেখলাম, মরু এলাকায় বিশাল এক পাথুরে মন্দিরে বসে আছি। পর মুহূর্তে পাল্টে গেল দৃশ্যপট। দেখতে পেলাম, আদ্যি কালের এক বনের কিনারায় থান পরা শত শত টাকমাথা লোক শয়তানের বিকট এক মূর্তিকে ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করছে। মূর্তির পায়ের কাছে পাথরের বেদিতে সাতটি তরু ণীর কাটা মাথা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বেদি, শয়তানের পা। হঠাৎ অনুভব করলাম, এক অপার্থিব কুৎসিত ঠান্ডা হাত দিয়ে কে যেন আমার হৃৎপিণ্ড চেপে ধরেছে। প্রচণ্ড ব্যথায় জ্ঞান হারালাম আমি।
হুঁশ ফিরে পেয়ে দেখি, সেই বুড়ো লোকটা আমার মাথায় জল ঢালছে। চৌধুরী তার সব জিনিসপত্র গোছগাছ করছেন। মেঝের ওপরকার নকশা উধাও। খুব ভোরে যখন বের হলাম, পাড়াটাকে মনে হলো ভূতের শহর। কোথায় হারিয়ে গেছে রাতের সেই মৌতাত। দুটো রিকশা নিয়ে গোয়ালন্দ বাজারে ফিরলাম আমার। ড্রাইভার রওনা হলো সাথে সাথে। পথে রাজবাড়ী বাজারে নেমে মুরগির ঝোল, নানরু টি দিয়ে নাশতা সেরে আবারও গাড়িতে।
বাসার সামনে আমাকে নামিয়ে দিলেন মন্ময়। হাতে খবরের কাগজে পেঁচানো একটা প্যাকেট আর একটি চিঠি দিলেন। বললেন,
‘প্যাকেট সাবধানে রাখবেন। চিঠিটা ভালো করে পড়বেন।’ ড্রাইভারকে বললেন,
‘বাসায় চলো, জলদি।’
১২
বাসায় ফিরে জানলাম, মা বড় মামার ওখানে। গত রাতে তার স্ট্রোক করেছে। গোসল সেরে খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে চিঠি খুললাম। সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা চিঠি। খুব সম্ভব চৌধুরী আগেই লিখে রেখেছিলেন। দিন, তারিখ কিছু উল্লেখ নেই :
সঞ্জয় বাবু,
আপনার সাথে আমার হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না। তার প্রয়োজনও নেই। সাধনা কতটুকু সফল হয়েছে তা বোঝা যাবে তিন দিনের মধ্যেই। কাগজের প্যাকেটে কাঠের মূর্তিটা আছে। এটা একটা টাইম বম্ব। মূর্তিটার কাজ কার প্রাণনাশ করতে হবে, হাকিনীকে সেই ব্যক্তি চিনিয়ে দেওয়া। সেই অর্থে এটাকে হোমিং ডিভাইসও বলতে পারেন। টাইম বম্ব এই অর্থে যে সময় মাত্র তিন দিন। আজ রাতেই মূর্তিটা, যার ছবি থেকে ওটা বানানো, তার বাসার সীমানার ভেতর পুঁতে রেখে আসবেন। মূর্তিটা ভারী মনে হবে। এর কারণ, ওটার পেটের ভেতর আপনি যেখানে বসে যজ্ঞ করেছেন, সেখানকার মাটি ভরে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করতে পারেন, যে তরল আপনাকে খেতে দিয়েছিলাম, সেটা আসলে কী ছিল? অনেক পুরোনো রেড ওয়াইন এর সাথে একজন বারবনিতার ঋতুস্রাব এবং কালীমন্দিরে যে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলে, সেই পিদিমের ঘি মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে ওটা। এসব কথা আপনাকে বলছি এই কারণে যে আপনি যেন না ভাবেন, আপনাকে বিষাক্ত কোনো কিছু খাইয়ে অসুস্থ করে ফেলেছি। ঋতুস্রাব খেলে মানুষ অসুস্থ হয় না। প্রাক ইসলামি যুগে মক্কার লোকেরা ঋতুস্রাব খেত। তাদের কোনো সমস্যা হয়নি।
আবারও বলছি, যত তাড়াতাড়ি পারেন মূর্তি দাফনের ব্যবস্থা নিন। শুভ কামনা রইল।
লেখকের নাম-ঠিকানা নেই। মোটা মোসলেমের নামের উল্লেখ পর্যন্ত নেই কোথাও। চিঠি অন্যের হাতে যদি পড়েও, মন্ময় চৌধুরীকে জড়ানো যাবে না কিছুতেই। সত্যি কথা বলতে কী, লোকটা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানিনা। এ হচ্ছে পিরামিড। সামনেই আছে অথচ চির রহস্যময়। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। তলিয়ে গেলাম ঘুমের গভীরে। স্বপ্নে দেখলাম, বুড়ির বাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে। তার সেই বীভৎস বসার ঘরের সরু দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল মন্ময় চৌধুরীর সাথে মোটা মোসলেম। আমাকে দেখতে পেয়ে মুখ হা করল। তাদের খোলা মুখ থেকে অসংখ্য ছোট ছোট তির আমার গায়ে এসে বিঁধতে লাগল। আমি দাঁড়িয়েই আছি। কোত্থেকে বুড়ির নাতজামাই ছুটে এল। ধাক্কা মেরে রাস্তার এক পাশে সরিয়ে দিল আমাকে। জেগে উঠে দেখি, বাসার কাজের ছেলে নিমাই আমাকে ঝাঁকাচ্ছে। ঘুম ভেঙেছে দেখে বলল,
‘ও সঞ্জুদা, আপনারে তো মশা খায়ে ফেলালো। সেই ককুন সাঁজ হয়েচে। একুনও ঘোম পাড়তিচেন। ওটেন। আপনের বড় মামা মইরে গেচে। তেনার বাড়িত যাতি হবে। খপর পাটায়েচে।’
মাথায় আকাশ, সৌরজগৎ, ছায়াপথ সব ভেঙে পড়ল। আমরা জাতে হিন্দু। বড় মামার সৎকার করতেই হবে। যত রাতই হোক, শ্মশানে লাশ দাহ করা চাই। মূর্তি কখন দাফন করব, বুঝতে পারছি না। হায়রে সময়! সময় গেলে সাধন হবে না। ছুটলাম বড় মামার বাড়ি। মূর্তি পড়ে থাকল বেড-সাইড টেবিলের ড্রয়ারে। শ্মশান-মশান ঘুরে বাড়ি এসে লোহা-লবণ ছুঁয়ে পাকসাফ হয়ে যখন ঘরে উঠলাম, তখন সকাল আটটা। আবারও সেই রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা।
সারা দিন ঘুমালাম। বিকেলের দিকে হেঁটে হেঁটে মোটা মোসলেমের বাড়ির দিকে গেলাম। আহসান আহমেদ রোডে এক হিন্দু জমিদারের মেয়ের বাড়ি দখল করে বাস করছে মোসলেম। বাড়ির সামনে নিচু প্রাচীরঘেরা একটা ছোট বাগান। এককালে সুন্দর ছিল। এখন সেখানে চার-পাঁচটা কলাগাছ ডানে-বাঁয়ে হেলে আছে। বাড়ির রং ক্যাটকেটে হলুদ, জানালা-দরজা রয়েল ব্লু। মূর্তি দাফনের জন্য বাগানটাকেই বেছে নিলাম। রাত বারোটা নাগাদ দেয়াল টপকে ঢুকলাম ওখানে। ফুট খানেক গভীর গর্ত করতে হবে। কোদাল আনা সম্ভব হয়নি। ছোট একটা খুরপি এনেছি। বাগানে ঢুকে রাস্তার কাছাকাছি এক কোনায় গর্ত খুঁড়লাম। কাগজের মোড়ক সরিয়ে বের করলাম মূর্তিটা। হাতে নিয়ে মনে হলো, ভীষণ ঠান্ডা এবং অনবরত ঘামছে ওটা। মূর্তিটা মাটি চাপা দিয়ে উঠতে যাব, এমন সময় দুটো মোটরসাইকেল আসার শব্দ পেলাম। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হর্ন বাজাতে লাগল চালকেরা। জাগ দলের কর্মী মোটা মোসলেমের সাথে কথা বলতে চায়। দেখে ফেললে সর্বনাশের মাথায় বাড়ি পড়বে। পাঁচিল ঘেঁষে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। ইচ্ছে হলো মাটিতে মিশে যাই। ভেবেছিলাম, লোকগুলো বাড়ির ভেতরে ঢুকবে। ঘটল এর উল্টোটা। বাসা থেকে বেরিয়ে এসে গেটের সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলতে লাগল মোসলেম। কথা আর শেষ হয় না। পাঁচিলের ওপাশে পৌর করপোরেশনের ড্রেন। মশাদের মহাদেশ। শরীরের ওপর চাদর বিছিয়ে দিল তারা। মনে হলো, অনন্ত কাল শুয়ে আছি। অসহ্য হয়ে উঠল মশা আর অদৃশ্য পোকার কামড়। সবকিছুরই শেষ আছে। কর্মীরা বিদায় হলো, মোটা ঘরে ফিরল। পাঁচিল টপকে আমি ফিরলাম বাসায়।
পরদিন বিকেলে চা নাশতা খেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড় ঘুরে হাঁটতে লাগলাম আহসান আহমেদ রোড ধরে। মনে প্রশান্তি। মিশন অ্যাকমপ্লিশড। দেখিব, খেলাতে কে হারে কে জেতে! মোসলেমের বাড়ির সামনে এসে খেলাম জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা। ধুন্ধুমার কাণ্ড। বাগান, কলাগাছ, পাঁচিল সব উধাও। পুরো জায়গাজুড়ে ফাউন্ডেশনের গর্ত। ওখানে নিচে মার্কেট, ওপরে জাগ দলের অফিস হবে। দুটো বাঁশের খুঁটিতে সাইনবোর্ড টাঙানো : দোকান-কোঠা বরাদ্দ চলছে। তিনটে বেডফোর্ড ট্রাক দাঁড়ানো। সারা দিন মাটি টেনেছে ওগুলো। এই বিরাট শহরে কোথায় মাটি ডাম্প করেছে কে বলতে পারে?
সন্ধে থেকে একটানা ডায়েরি লিখছি। মা মরা বাড়িতে। ন’টার দিকে নিমাই এসে খবর দিয়েছে খাবার রেডি। বলেছি রাতে খাব না। এক মহাজাগতিক হতাশায় ডুবে আছি। অপেক্ষা করছি চূড়ান্ত পরিণতির। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। জানালার শিক গলে ঘরে ঢুকল কনকনে ঠান্ডা বাতাস। পর্দা ফুলে ঢোল। বাড়ির সামনে দেখতে পেলাম জমাট বাঁধা একতাল ঘন অন্ধকারকে। মনে হলো, আষাঢ়ি অমাবস্যার রাতে ডবল সাইজ গরিলা দাঁড়িয়ে। খুব ধীরে জানালার দিকে এগোতে শুরু করল ছায়াছায়া কিংকং। হাকিনী তার শিকার চিনে ফেলেছে . . .।