১৬
পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, জীবন বাবুর দাদুর ঘরটিই বর্তমানে আমার ঘর। আরও মনে হলো, ভদ্রলোক আমার সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানেন। ইচ্ছে করেই এসব শোনাচ্ছেন উনি, কিন্তু কেন? সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,
‘এত কথাই যখন বললেন, তখন আরও দুটি প্রশ্নের উত্তর কি আমাকে দিতে পারবেন?’
part1 Click This Link part 2 Click This Link part3 Click This Link part4 Click This Link part5 Click This Link
‘আগেই বলেছি, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে একাধিক প্রশ্ন করেন, ভুলে গেছেন সে কথা?’
‘এই লিলিথের বিষয়টি আরেকটু ক্লেয়ার করতে পারবেন? তা ছাড়া বাড়ি বয়ে এসে আমাকেই বা এত কিছু শোনাচ্ছেন কেন?’
‘আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা আগে দেই। আমার ঠাকুর্দা মারা যাওয়ার পর ওই বাড়িটা খালি পড়েছিল অনেক দিন। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওখানে ব্রিটিশ আর্মির লোকেরা থাকত। ৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকারের কাস্টম্স বিভাগের মালখানা বানানো হয় ওটাকে। ৭১-এর পর সরকার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া একজন রেলওয়ে অফিসারের পরিবারের সদস্যদের দেয় ওটা। তবে করিম কমিশনার ওই পরিবারের কাউকেই ও বাড়িতে উঠতে দেয়নি। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা বিদায় হওয়ার পর আপনি ছাড়া আর মাত্র চারজন থেকেছে ওখানে। নারায়ণের সাথে কথা বলে জেনেছি, একমাত্র আপনিই দুবছরের বেশি সময় ধরে আছেন ওখানে। এরই মধ্যে খুব সময়ে টাকাও আয় করেছেন প্রচুর। অথচ এখনো পড়ে আছেন ওই পোড়োবাড়িতেই। আগেই বলেছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই বাড়িকে ঘিরে একটা রহস্য না থেকেই পারে না। এই একটি বিষয়ে যত গবেষণা আর সময় ব্যয় করেছি, তার অর্ধেকও কখনো অন্য কিছু তে করিনি। কে বলতে পারে, আপনিই হয়তো এ রহস্যের একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। ‘যেখানে দেখিবে ছাই. . .।’
এবার লিলিথের প্রসঙ্গে আসি। লিলিথ হলো দুনিয়ার সব থেকে পুরোনো অপদেবী। খ্রিষ্টের জন্মেরও তিন হাজার বছর আগে থেকে মানুষ এর পুজো করে আসছে। পৃথিবীর প্রথম গল্প গিলগামেস-এর ভূমিকায় একে উল্লেখ করা হয়েছে ‘হৃদয়হরণকারী সকল ইন্দ্রিয় সুখের উৎস’ হিসেবে। বহুকাল আগে হারিয়ে গেছে, এমন সব ধর্মে লিলিথকে বলা হতো ‘কিসকিলিলাকে’। তালমুদ হলো ইহুদিদের হাদিসের বই। এই তালমুদ এবং তাওরাত দুখানেই বলা হয়েছে ‘হে বিশ্বসীরা, পাষণ্ড দেবতা এনলিলের স্ত্রী লিলিথের কাছ থেকে শত হাত দূরে থাকবে।’ তবে লিলিথ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো তথ্য পাওয়া গেছে ডেড সি স্ক্রল থেকে। এই ডেড সি স্ক্রল হলো প্রাচীনতম বাইবেল। পঞ্চাশের দশকে এক রাখাল ইসরাইলের উষর মরু অঞ্চলে ভেড়া চরাতে চরাতে এক দুর্ভেদ্য পাহাড়ি গুহায় গিয়ে পৌঁছায়। ভেতরে ঢুকে দেখতে পায়, ধুলোভর্তি অনেকগুলো মাটির কলসি। সব কলসির মুখ খুব ভালোভাবে সিল করা ছিল। রাখাল ভেবেছিল, বিরাট কোনো গুপ্তধন পেয়ে গেছে সে। কলসিগুলোর মুখ খুলে দেখে ভেতরে পার্চমেন্টে হিব্রু ভাষায় লেখা তাড়া তাড়া কাগজ। এই স্ক্রল এত বেশি গোপনীয় যে এ পর্যন্ত মাত্র দশজন স্কলার ওটা পড়তে পেরেছেন। ডেড সি স্ক্রল-এর একটি চ্যাপ্টারের নাম ‘বুক অভ প্রভার্ব’। এখানে বলা হয়েছে, ‘লিলিথের মন্দিরের প্রবেশদ্বার হলো নিশ্চিত মৃত্যুর প্রবেশদ্বার। ওই মন্দির থেকে সে (লিলিথ) যাত্রা করে শেওলের অনন্ত নরকের উদ্দেশে। সেখানে যে একবার প্রবেশ করেছে, সে আর কোনো দিনই ফিরতে পারবে না এবং যারা তার আরাধনা করে তাদের স্থান হবে নরকের শেষ ধাপে।’ লিলিথ হলো নিষিদ্ধ ইন্দ্রিয়সুখ, বিকৃত যৌনক্রিয়া, মদ, জুয়া এবং বীভৎস অসুখের সব থেকে প্রাচীন একচ্ছত্র দেবী।
প্রায় দেড়শো বছর আগে বাগদাদের কাছে চার হাজার বছরের পুরোনো একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ভেতর লিলিথের দুর্লভ একটি মূর্তি খুঁজে পান প্রফেসর বার্নি। মন্দিরটির গর্ভগৃহের সরু একটা চেম্বারের দেয়ালে আটকানো অবস্থায় ছিল ওটা। এই মূর্তির পায়ের কাছে অতি প্রাচীন কিউনির্ফম লিপিতে লেখা ছিল, ‘রাতের রানি লিলিথ তার বোন এরেশকিগালকে নিয়ে ব্যাবিলনের সমস্ত বেশ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে’। আপনি অবশ্যই জানেন, হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনে প্রকাণ্ড সব বেশ্যালয় গড়ে উঠেছিল। ইতিহাসের প্রথম এবং সব থেকে বড় ‘সিনসিটি’ ওটাই। বার্নি যে মূর্তিটা পেয়েছিল, সেটিতে দেখা যায়, উদ্ভিন্নযৌবনা লিলিথ একটা মোটা সাপকে জড়িয়ে ধরে আছে। সাপের মাথাটা ঝুলে আছে তার ডান কাঁধের ওপর। লিলিথের দুদিকে তরুণীর পায়ের মতো পা-অলা দুটো পেঁচা।
লিলিথের পুজো করা খুবই সহজ। সন্ধের সময় মূর্তির দুদিকে দুটো মোমবাতি জ্বালালেই লিলিথ তাকে পূজারি হিসেবে গ্রহণ করে। এরপর পূজারির ভালো-মন্দের দায়িত্ব তার। ভীষণ ক্ষতিকারক বলে যুগের পর যুগ ধরে ইহুদি আর খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা লিলিথের সব মূর্তি ধ্বংস করে ফেলে। ১৮২৭ সালে প্রফেসর বার্নির লিলিথের মূর্তিটা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত দুনিয়ার মানুষ জানতই না লিলিথ দেখতে কেমন। শোনা যায়, সচরাচর কোনো পূজারিকেই লিলিথ বেশি বাঁচতে দেয় না, যদি না অন্য কেউ ওই সময়ের ভেতর স্বেচ্ছায় তাকে পুজো দেয় এবং আগের পূজারি চিরতরে লিলিথকে ত্যাগ করে সৎ জীবন বেছে নেয়। কোহেন সে অর্থে কিছুটা বেশি দিনই বেঁচেছিল বলতে হবে। আমি যেটা কিছুতেই ধরতে পারছি না সেটা হলো, বাড়িটিতে লিলিথের প্রভাব এত স্থায়ী হলো কীভাবে?
১৭
ততক্ষণে জীবন বাবুর লেকচার শুনে শুনে দুই আর দুইয়ে চার মেলাতে শুরু করেছি। তাঁকে বললাম,
‘বাবু, আপনার রহস্যের কিছুটা সমাধান আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমার ধারণা, যেভাবেই হোক, কোহেন সিরীয় কাবালিস্ট গুরুদের কাছ থেকে লিলিথের মূর্তির একটা কপি হাসিল করে। মূর্তিটাকে নিয়ে আসে এই বাড়িতে, রক্ষা করে সর্বোচ্চ গোপনীছু া। ভুলেও যাতে কারও হাতে না পড়ে ওটা, সে জন্য ছোট্ট একটি মন্দির বানায় সে। কেউ যাতে সন্দেহ না করে সে জন্য বাইরে থেকে ওটাকে একটা ক্লজিটের রূপ দেয়। স্বীকার করতেই হবে দুর্দান্ত এক বুদ্ধি বের করেছিল লোকটা। তবে কোহেন হঠাৎ খুন হয়ে যাওয়ায় মন্দির রয়ে গেল যে কে সেই। আপনার ঠাকুর্দা যে করেই হোক খুঁজে পান ওটা, খুব সম্ভবত নিলামে কিনে নেওয়ার পর বাড়িটা ঠিকঠাক করার সময়। আমি নিশ্চিত, তিনিও ওটাকে নিয়মিত নৈবেদ্য দিয়েছেন। বেশ কিছু দিন আগে ক্লজিটটা পরিষ্কার করতে গিয়ে মূর্তিটা খুঁজে পাই আমি। ক্লজিটের ভেতর কাঠের একটা তক্তা দিয়ে চমৎকারভাবে আড়াল করে রাখা ছিল ওটা। খুব ভালো করে খুুঁটিয়ে না দেখলে এই কেলোর কীর্তি কারও বোঝার সাধ্য নেই। তার পরও কেউ যদি দেখেও ফেলে, তবু ওটা আসলে কী, সেইটে বুঝতে পারা প্রায় অসম্ভব। কোনো কিছু বোঝার আগেই সর্বনাশ যা ঘটার ঘটে যাবে। আমার কথাই বলি, আপনার সাথে দেখা না হলে কিংবা দেখা হলেও, যদি আপনি এত কিছু না বলতেন তাহলে জানতে পারতাম না কিছুই।’
সবকিছু শুনে জীবন বাবু কেমন যেন হয়ে গেলেন। তাঁর কপালে দেখা দিল চিকন ঘামের রেখা, বুক চিরে বেরিয়ে এল ঠান্ডা দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎই অত্যন্ত ক্লান্ত ও বয়স্ক মনে হলো মানুষটিকে। কোলের ওপর ফেলে রাখা হাত দুটোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন জীবন বাবু। সারা জীবন ধরে তাড়া করে ফেরা রহস্যের সমাধান পাওয়া গেছে অবশেষে। এর পরের ঘটনা ঘটল অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। এখন বসে ভাবলে পরের ঘটনাগুলোকেই বেশি অদ্ভুত মনে হয়।
জীবন বাবু হোটেলে ফিরে গেলেন। আমি ঢাকা ক্লাবে মেজবানি খেয়ে ফ্ল্যাশ খেলতে গিয়ে হেরে ভূত হতে লাগলাম। এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। জুয়া খেলায় আমি প্রায় অজেয়। আজ মন বসাতে পারছি না কিছুতেই। দেখলাম, এমডি সাহেবও মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে তাকাচ্ছেন আমার দিকে। উনি সব সময়ই আমার পার্টনার। আমি হারলে সে দায়ভাগ নিতে হয় তাঁকেও। সন্ধের দিকে উনি বললেন, ‘আজকে না হয় বাদ দেন। লাক ফেভার করছে না। কালকে আবার ট্রাই করে দেখা যাবে, কী বলেন?’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।
ক্লাব থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরলাম লিলিথ হাউসে। সত্যি কথা বলতে কি, জীবন বাবুর একটা কথা ভুলতে পারছিলাম না কিছুতেই : ‘শোনা যায়, সচরাচর কোনো পূজারিকেই লিলিথ দু’বছরের বেশি বাঁচতে দেয় না।’ সাঙ্ঘাতিক মন খারাপ হয়ে গেল আমার। মনে হলো, এই হেঁটে চলা, রাস্তাঘাট, জগৎ-সংসার সবকিছু অলীক। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই পৃথিবী, আমি কেউ নই এখানকার। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো আমার। হাঁটতে হাঁটতে কখন বাসার সামনে চলে এসেছি, বুঝতেই পারিনি। সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠতে যাব, এমন সময় চোখ গেল আমার ঘরের খড়খড়ি দেওয়া জানালার দিকে। মনে হলো, ভেতরে খুব হালকা একটা আলো জ্বলছে। ঘরের সামনে গিয়ে দেখলাম দরজার তালা খোলা, সামান্য ফাঁক হয়ে আছে পাল্লা। মুকুলের মা ঘর পরিষ্কার করে আলো জ্বেলে, অন্ধকার করে নয়। আস্তে করে দরজা ফাঁক করে উঁকি দিলাম ভেতরে। দেখলাম, ক্লজিটের দরজা খুলে বের হয়ে আসছে মুকুলের মা। হাতে মোমবাতি!
১৮
পরিশিষ্ট : আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ছাত্র। আমাদের বিভাগেরই এক প্রফেসর ঢাকা হেরিটেজ শিরোনামে একটি বড় বই লিখেছিলেন। বইটিতে ঢাকা শহরের পুরোনো সব বাড়িঘরের ছবিসহ বর্ণনা ছিল। ওই বইটি লেখার সময় প্রফেসর সাহেব এক কান্ড করলেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠকদের অনুরোধ করলেন, কোনো বিশেষ বাড়ি বা দালান সম্পর্কে কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে তাঁকে লিখে জানানোর। বিজ্ঞাপন ছাপা হওয়ার পর পাঠকদের কাছ থেকে প্রচুর চিঠি পান স্যার। চিঠিগুলো পড়ে বাছাই করার দাছিু ¡ পড়ে আমার ওপর। অন্যান্য অনেক চিঠির সাথে আমি ওপরের লেখাটি পাই। ওই লেখক স্যারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন তার লেখা যেন ছাপা হয়। তার দাবি, এ লেখার প্রতিটি কথা সত্যি। চিঠিটা পড়ে ওটা সাথে সাথে বাতিল করে দিই আমি। স্যার একজন প্রখর যুক্তিবাদী ইতিহাসবেত্তা। এই দীর্ঘ বর্ণনা পড়লে তিনি বিরক্ত তো হবেনই, উল্টো আমার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলবেন। তবে স্যারকে না জানালেও রহস্যপ্রিয় মানুষকে জানাতে দোষ কী? লেখক বানিয়ে বানিয়ে বলেছেন, না সত্যি বলেছেন, সেই বিচার তাঁরাই করুন।
[email protected]