somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট গল্প “বিনুর আবদার”

২৩ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সোবহান সাহেবের মেজাজ প্রচন্ড রকম খারাপ ৷ ঘর থেকে বেরোনোর মুখেই বাঁধা পড়েছে ৷ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চার তলার আফজাল সাহেবের স্ত্রী’র সাথে দেখা ৷ হাতে এক গাদা লাল শাক আর মিষ্টি কুমড়া হাতে ভদ্র মহিলা উপরের দিকে উঠছেন ৷ লাল শাক থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে ৷ ক্ষেত থেকে তুলে আনা টাটকা লাল শাক, দেখেই বোঝাই যাচ্ছে ৷ বাড়ির নিচতলায় রোজ দশটা বাজলেই ইদানিং এক সব্জিওয়ালার ভ্যান দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ৷ হয়তো সেই সব্জিওয়ালার কাছ থেকেই কেনা ৷ উনার পায়ে হয়তো কোনো সমস্যা আছে ৷ ভদ্র মহিলা হাঁটার সময় থপথপ শব্দ করে হাটেন ৷ স্যান্ডেল পায়ে নিচতলা থেকে উপর তলায় যখন উনি হেঁটে যান, সোবহান সাহেবের তিন তলার ফ্ল্যাটে সবচেয়ে ভেতরের দিকের রুম থেকেও সেই শব্দ পাওয়া যায় ৷ মাঝে মাঝে রাতের বেলায়ও উনি ঘরের ভিতর স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে থপথপ করে হাটেন ৷ ঘরের ভেতর স্যান্ডেল পড়ে হাটার দরকারটা কি? বিরক্তিকর!
আফজাল সাহেবের স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ পড়তেই ভদ্র মহিলা আন্তরিক ভাবে হেসে দিলেন ৷ থপথপ করে হাটলেও মহিলার হাসি বেশ সুন্দর ৷ ঝকঝকে পরিস্কার দাঁত ৷ দাঁতগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয় কেউ একজন স্কেল দিয়ে মেপে মেপে দাতগুলো সুন্দর করে সাইজ মত সমান্তরালে সাজিয়ে দিয়েছে ৷ এমনি ভদ্র মহিলা কথা খুব কম বলেন ৷ আফজাল সাহেবরা গতমাসেই এই বাসায় ভাড়া এসেছেন ৷ মাঝে মাঝে সিঁড়ির গোড়াতে দেখা হয়ে গেলে ভদ্র মহিলা আন্তরিক ভাবে হাসেন শুধু, বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি এখনও ৷
সোবহান সাহেবের মেজাজ খারাপের কারন হলো সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আফজাল সাহেবের স্ত্রীকে সাইড দিতে গিয়ে সিঁড়ির গোঁড়ায় দেয়ালে ছোট্ট একটা পেঁরেকে লেগে পাঞ্জাবির একটা কোণা হঠাৎ ছিঁড়ে গেলো ৷ বেশ ভালো ভাবেই পাঞ্জাবিটা ছিঁড়েছে, পকেটের দিকে একটা কোণা বিশ্রি ভাবে ঝুলে আছে ৷ গত ঈদেই মাত্র কেনা হয়েছিল, বেশি একটা পড়াও হয়নি ৷ বাসায় গিয়ে পাঞ্জাবি চেইঞ্জ করে আসারও উপায় নেই ৷ বাসা থেকে উনি বেরিয়েছেন স্ত্রী বিনুর সাথে ঝগড়া করে ৷ বিনু এমনি খুব শান্তশিষ্ট মানুষ ৷ রেগে গেলে কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি করে না ৷ কিন্তু খোঁচা দিয়ে খুব কড়া কড়া কথা বলে ৷ মাঝে মাঝে সোবহান সাহেবের চোখে পানি চলে আসে বিনুর এমন ব্যবহারে!
আজকের ঘটনাটা তেমন সিরিয়াস কিছু না ৷ সাদমান তার দিদুইয়ের কাছে একটা সাইকেল আব্দার করেছে ৷ আজকে সাদমানের জন্মদিন ৷ সাদমান হচ্ছে সোবহান সাহেবের ছোট ছেলে আদনানের ৪ বছর বয়সী ছেলে ৷ বড় ছেলে আরমান, ছোট ছেলে আদনান, আদনানের বৌ দিনা, সোবহান সাহেবের স্ত্রী বিনু আর নাতী সাদমানকে নিয়ে হাজিরাপুরের একটা ফ্ল্যাটে ছোট্ট সংসার ৷ বড় ছেলে আরমান বিয়ে করেনি এখনও, করার সম্ভাবনাও খুব কম ৷ কোন এক কলেজের বান্ধবীর শোকে সে চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷
সোবহান সাহেব সরকারী কর্মচারী ছিলেন ৷ সরকারী একটা অফিসের এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পোষ্টে ৷ বছরখানেক হলো রিটায়ার্ড করেছেন ৷ প্রতি মাসের ৪ তারিখে উনার ব্যাংকে ১৬ হাজার টাকা জমা হয় ৷ ১২ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়ার জন্যে তুলে এনে ২ হাজার টাকা উনি ব্যাংকে ডিপিএস করে জমা রাখেন ৷ আর ২ হাজার টাকা নিজের হাত খরচ হিসাবে রাখেন ৷ দুই ছেলে সংসারের বাকি খরচ চালায় ৷ ডিপিএসের টাকাটা বিপদের সম্বল ৷ গত বছর তার এ্যাপেন্ডিক্সের অপারেশনের সময় ছোট ছেলের অনেক বাড়তি খরচ হয়ে গেছে ৷ আদনান মুখে কিছু না বললেও সোবহান সাহেব খুব লজ্জায় পড়েছেন ৷
সাতসকালে চা হাতে পত্রিকা নিয়ে বসার কিছুক্ষন পরে বিনু এসে সাইকেলের কথা বলতেই সোবহান সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো ৷ ছোট্ট ফ্ল্যাট বাসা, তিনরুম আর ছোট্ট ডাইনিং স্পেস ৷ হাটা-চলারই জায়গা নেই, এইটুকু জায়গায় আবার সাইকেল চালানো কি? আশেপাশে খোলা মাঠও নেই যেইখানে বাচ্চারা একটু দৌড়াদৌড়ি করে খেলাধূলা করবে ৷ সোবহান সাহেবের ভোঁতা মুখ দেখে বিনু খোঁচা দিয়ে গা জ্বালানো কথাবার্তা শুরু করলো ৷
- কোনোদিন অন্যের শখ আল্লাদের দিকে তাকিয়ে দেখেছো? অন্যের কথা বাদ, নিজের বৌকেই শেষ কবে একটা শাড়ি এনে হাতে দিয়েছো বলো? অথবা একশ’টা টাকা হাতে দিয়ে কোনোদিন বলেছো যে সংসারে কিছু লাগলে বা ভালমন্দ কিছু খেতে ইচ্ছা হলে কিনে খেতে? ছেলেদের কাছে সবসময় হাত পাঁতা যায় ছোটখাট বিষয়ে? আজকে নাতীটার জন্মদিন, একটা সাইকেলের বায়না ধরেছে আমার কাছে ৷ এইটুকুও যদি দিতে না পারো, তাহলে এক কাজ করো ৷ আমাকে গার্মেন্টসে একটা চাকরী খুঁজে দাও ৷ আমি কিছু পয়সা জমাই, সেই পয়সায় আমি আমার নাতীকে ভালমন্দ কিনে দেবো ৷
একনাগাড়ে কথাগুলো খুব শান্ত ভঙ্গীতে বলে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বিনু রান্নাঘরে ঢুকে গেলো ৷ রাগ কমানোর জন্যে সোবহান সাহেব চেয়ার থেকে উঠে গায়ে পাঞ্জাবি চাপালেন ৷ আজকে সন্ধ্যার আগে উনি বাসায় ফিরবেন না বলে ঠিক করলেন ৷ জন্মদিন-টন্মদিনে নিশ্চয়ই কেক কাটাকাটি হবে ৷ এইসব ঝামেলা শেষ হলে তারপর উনি ঘরে ফিরবেন ৷ ঘরে থাকলে বিনু একটু পরপর এসে খোঁচা দিয়ে কথা বলবে ৷ এখন বলেছে গার্মেন্টসে চাকরি খুঁজে দেবার কথা, একটু পরে হয়তো বলে বসবে গাঢ় লাল রঙয়ের লিপস্টিক কিনে এনে দিতে ৷ সেটা মেখে সে আমিনবাজারের মোড়ে সন্ধ্যায় গিয়ে দাড়াবে কাস্টোমারে খোঁজে ৷ বিনুকে বিশ্বাস নেই, এইসব কথা তার পক্ষেই বলা সম্ভব ৷ কথার ধার যতটুকুই হোক না কেন, বিনুর খোঁচা দিয়ে কথা বলার ভঙ্গীটা হয় এমন শান্ত আর নির্লিপ্ত যে গায়ে আগুন ধরে যায় একেকটা কথায়!
ঝগড়া করে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই পাঞ্জাবিটা বিশ্রিভাবে ছিঁড়ে গেলো ৷ উপরে গিয়ে চেইঞ্জ করে আসতেও ইচ্ছা করছে না ৷ ইচ্ছা করছে আজকে সারাদিন রিক্সা করে ঘুরতে ৷ আজকে আবহাওয়াটা বেশ ভাল ৷ খুব গরমও না, আবার ঠান্ডাও না ৷ গত কয়েকদিন বেশ গরম পড়েছিল ৷ মেইন গেট থেকে বের হয়ে মোড় পর্যন্ত হেঁটে বাজারের গলির কাছাকাছি গেলেই রিক্সা পাওয়া যাবে ৷ নিয়ে নেবেন নাকি একটা রিক্সা? ঘন্টায় ১০০ টাকা চুক্তি ৷ পকেটে ১ হাজার টাকা আছে ৷ ১০০ টাকায় চুক্তি হিসাবে ৮ ঘন্টা সারাদিন ঘুরবেন, আর বাকি ২০০ টাকা দিয়ে এটা-ওটা কিনে খাবেন ৷ প্ল্যান মন্দ না ৷ সোবহান সাহেব এগিয়ে গেলেন মোড়ের গলির দিকে ৷
রিক্সার জন্যে বাজার পর্যন্ত অতদূর যেতে হয় না, মোড়েই কাছের মুদি দোকানটার সামনেই রিক্সা বসে থাকে অনেক ৷ তবে উনি কখনও মোড়ের দোকানের কাছ থেকে রিক্সা নেন না ৷ বাজার পর্যন্ত ১৫ মিনিট হেঁটে যান ৷ গলির ১০টা বাড়ি পরে যে বাড়িটা, ওদের দেয়াল বেঁয়ে বেলি ফুলের গাছ রাস্তার দিকে ঝুঁকে আসে ৷ বাড়িটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে সোবহান সাহেবের বড় ভাল লাগে!
বাজারের কাছে রিক্সা স্ট্যান্ডে তিনটা রিক্সা দাড়িয়ে আছে ৷ এত সকালে মানুষজনও কম ৷ প্রথম রিক্সাটা চ্যাংড়া মতন এক ছেলের, ফুল প্যান্ট পড়ে রিক্সাচালকের সিটে বসে আছে ৷ ফুল প্যান্ট পড়ুয়া রিক্সাওয়ালা সোবহান সাহেব আগে কখনও দেখেননি ৷ যুবক-বুড়ো সব রিক্সাওয়ালাকেই লুঙ্গী পড়ে রিক্সা চালাতে দেখা যায় ৷ লুঙ্গীতে কি বিশেষ কোনো সুবিধা হয় রিক্সা চালাতে? সোবহান সাহেবের ধারনা হাফপ্যান্ট বা ফুলপ্যান্টেই তো বেশি সুবিধা হওয়ার কথা ৷ প্যাডেল মারতে মারতে লুঙ্গীর গিঁট আলগা হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে ৷ তবুও রিক্সাওয়ালাগুলো লুঙ্গী পড়ে রিক্সা চালায় কেন? কোনো এক ফাঁকে আজকে জেনে নিতে হবে ব্যাপারটা ৷ রিক্সায় বসে রিক্সাওয়ালার সাথে আলাপ জুড়তে সোবহান সাহেবের বড় ভাল লাগে ৷ বাসায় কথা বলার লোক কম ৷ তার কথা মনযোগ দিয়ে কেউ শোনে না আজকাল ৷ দুই ছেলে সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে ৷ ঘরে দিনা সারাদিন ব্যস্ত থাকে সাদমানকে নিয়ে ৷ সাদমানটাও দাদুইয়ের সাথে খুব একটা কথা বলে না ৷ কিন্তু তার দিদুইয়ের সাথে বেশ খাতির ৷ বিনু আর সাদমান কুটকুট করে গল্প করে ৷ কোনো এক অজানা কারনে সাদমান সোবহান সাহেবকে হয়তো পছন্দ করে না, দূরে দূরে থাকে ৷ সোবহান সাহেব খুব কষ্ট পায় ৷ একমাত্র বাকি থাকে বিনু ৷ বিনুর সাথে কথা বলা যায়, তবে কখন আবার খোঁচা দিয়ে কি বলে বসবে সেই ভয়ে সোবহান সাহেব সবসময় ভীত থাকেন ৷
প্যান্টপড়ুয়া রিক্সাওয়ালার সামনের রিক্সাটায় এক মধ্যবয়সী রিক্সাওয়ালা, হুড তুলে সিটে পা উঠিয়ে ঘুমাচ্ছে ৷ এই সকাল এগারোটায় রিক্সার সিটে পা তুলে স্যারের নবাবী ঘুম! সোবহান সাহেব তার সামনের রিক্সাটার দিকে এগিয়ে গেলেন ৷ বয়স সোবহান সাহেবের চেয়ে কিছু কম ৷ চুলে পাঁক ধরা বয়স্ক একজন মানুষ ৷ চোখেমুখে একটা মায়া আছে ৷ প্যান্টপড়ুয়ার রিক্সায় উঠলে চ্যাংড়াটা জোরে টান দিবে, গল্পগুজব কম হবে ৷ তাছাড়া চ্যাংড়া জওয়ান ছেলে, সারাদিনে সে অন্য রিক্সাওয়ালার চেয়ে বেশিই প্যাসেঞ্জার টানতে পারবে ৷ এরচেয়ে বুড়োর রিক্সায় উঠে পড়াই ভাল ৷ ৮ ঘন্টায় আস্তে আস্তে রিক্সা টানলেও সমস্যা নেই, এক ধাক্কায় ৮০০ টাকা ইনকাম করতে পারবে ৷ এর মধ্যে যদি আগেই সোবহান সাহেবের মেজাজ ভাল হয়ে যায়, দেখা যেতে পারে ৪-৫ ঘন্টা ঘুরেই উনি বাড়ি ফিরে যাবেন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ৷
বুড়োকে ৮০০ টাকার চুক্তির কথা বলতেই বুড়ো রাজি হয়ে গেলো ৷
- আহেন, উঠেন স্যার! যেইহানে যাইতে চান ঘুরায়া ঘুরায়া নিয়া যামু ৷ কোনো সমস্যা নাই ৷
- কি নাম আপনার?
- জলিল, স্যার ৷ টাইট হয়া বয়েন ৷ হুক তুইলা দিমু?
- না না, থাক ৷ হুড ওঠানোর দরকার নেই ৷ আপনি আস্তে ধীরেই চালান ৷ আমার তাড়া নেই ৷ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরবো ৷ আপনার যেখানে ইচ্ছা রিক্সা চালাতে থাকেন ৷
- জ্বী আচ্ছা স্যার ৷
- বাসায় কোথায় আপনার?
- আমতলী পাড়ায় ৷
- সে তো এখান থেকে অনেক দূর! বাসে যেতেই প্রায় দেড় ঘন্টার রাস্তা!
- হ স্যার ৷ দূর আছে ৷ আমিনবাজারে প্যাসেঞ্জার নিয়া আইছিলাম চুক্তিতে ৷ আমতলী থেকা আমিনবাজার চুক্তি হৈছিলো আমারে ৩০০ ট্যাকা দিবো ৷ সারাদিনের পোর্থোম ক্ষ্যাপ ৷ ব্যাটায় পাশশো ট্যাকার নোট দেখায়া কৈলো ভাঙ্গায়া আনি, আর খবর নাই! আধাঘন্টা ধৈরা বয়া আছি এইহানে ৷
- আহহা! বলেন কি!
- হ স্যার ৷ আজকের দিনটাই খারাপ মতন শুরু হৈলো ৷
- আমার দিনটাও আজকে খারাপ ভাবে শুরু হয়েছে ৷
- হ স্যার ৷ আপ্নেরে দেইখাই বুঝছিলাম ৷
- কিভাবে বুঝলে?
প্যাডেল মারতে মারতে পেছনে ফিরে জলিল পান খাওয়া দাঁত বের করে বললো -
- আপ্নের পাঞ্জাবি দেইখা স্যার ৷ ছিঁড়ালাইছেন ক্যামনে?
- বাসা থেকে বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে বের হয়েছি ৷ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পাঞ্জাবিটাও ছিঁড়ে গেছে ৷
জলিলের সাথে সোবহান সাহেবের আলাপ জমে উঠলো ৷ জানা গেলো আমতলী বাজারের বস্তিতে দুই মেয়ে নিয়ে জলিলের সংসার ৷ জলিলের স্ত্রী মারা গেছে দ্বিতীয় কন্যা জন্ম দেয়ার সময় ৷ বাচ্চাটা মায়ের পেটে উল্টো হয়ে ছিল ৷ দাঁই এসে জানালো অবস্থা খুব খারাপ ৷ দুইজনের একজন বাঁচবে ৷ জলিল কাদঁতে কাঁদতে বললো তার স্ত্রী আমেনাকে বাঁচাতে ৷ হয়ে গেলো উল্টোটা ৷ পরীর মত ফুটফুটে একটা মেয়ে পৃথিবীতে আসলো, আর আমেনা বেগম পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো ৷ পরীর মত দেখতে ফুটফুটে মেয়ে, তাই জলিল তার ছোট মেয়ের নাম রাখলো পরী ৷ বড় মেয়ে কুসুম, কাজ করে গার্মেন্টসে ৷ ভাড়ার রিক্সা চালিয়ে জলিল সংসার চালায় ৷ দিন শেষে ২০০ টাকা রিক্সার গ্যারেজের মহাজনকে দিতে হয় ৷ বাকি যা থাকে, তাতেই সংসার কোনো মতে চলে ৷ ৮-১০ ঘন্টা রিক্সা টানলে মহাজনের টাকা দেয়ার পরেও ৪০০-৫০০ টাকা জলিলের পকেটে থাকে ৷ পরীর বয়স ১৭, সামনের মাসে ১৮ তে পা দেবে ৷ ২৩ বছরের কুসুমের জন্যে জলিলের খুব চিন্তা ৷ পাড়ার সগীর ইদানিং বড্ড জ্বালাতন করছে ৷ গার্মেন্টস থেকে কুসুম ফেরার পথে রাস্তায় তাকে জ্বালানত করে সগীর হারামজাদাটা ৷ খারাপ খারাপ কথা বলে, আর ময়লা দাঁত বের করে হাসে ৷
- জানেন স্যার, গত হপ্তায় হারামজাদাটা কর্ছে কি? কুসুম সন্ধ্যায় ছুটি হওয়ার পরে বাসায় ফির্তাছে, লগে ওর বান্ধবীরাও আছিলো ৷ শুওরটা অর বন্ধুগো লগে চায়ের দোকানে বৈসা আড্ডা দিতাছিলো ৷ কুসুমরে দেইখা জোরে চিল্লায়া উঠলো, “ময়না পাখি কুসুম, কবে তরে চুষুম?” সারাদিনে ক্ষ্যাপ মারা শ্যাষে রিক্সা লয়া আমি গ্যারেজের দিকে ফিরতাছিলাম ৷ নিজের চোক্ষের সামনে মাইয়াডার এই অবস্থা দেইখা চোক্ষে পানি আয়া পড়লো! বুড়া বাপ হয়া মাইয়ার বিয়া দেওনের মত পয়সাডাও এহনও জোগাড় করতে পারি নাই ৷ থুহ!
একদলা থুথু ফেলে জলিল গামছার কোনা দিয়ে চোখ মুছলো ৷ সোবহান সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না ৷ ভ্যাপসা গরম লাগছে ৷ বাসা থেকে বের হবার সময় এতটা গরম লাগেনি ৷ সোবহান সাহেব জলিলকে মুন্সীবাড়ির কোণার চায়ের দোকানটার কাছে থামতে বললেন ৷ এই চায়ের দোকানে সোবহান সাহেব প্রায়ই আসেন ৷ বলতে গেলে প্রতি মাসে একবার-দুইবার এখানে তার আসা হয় ৷ এই দোকানের চা টা বেশ ভাল ৷ যে গরম পড়েছে, এককাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ের জন্যে বুক ফেঁটে যাচ্ছে ৷ বাড়ির সকালের চা টা ঠিকমত খাওয়া হয়নি আজকে ৷
দোকানদারকে দু’কাপ চায়ের কথা বললো সোবহান সাহেব ৷ উনার বাজে কোনো নেশা নেই ৷ বিড়ি-সিগারেট খান না, মদ্যপানও করেন নাই কখনও ৷ একবার করার ইচ্ছা আছে ৷ কৌতুহলের বশে, অন্য কিছু না ৷ পান খাওয়ারও অভ্যাস নেই ৷ বিনু মাঝে মধ্যে পান খায় ৷
মাথা নিচু করে জলিল চুপচাপ চা খাচ্ছে ৷ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি ৷ প্রথম প্যাসেঞ্জারের কারনে পকেটে পয়সাও নেই যে নাস্তা কিনে খাবে ৷ জলিল সাহেব এক প্যাকেট বিস্কিট কিনলেন ৷ ঝোলানো ছড়া থেকে দু’টো কলা ছিঁড়ে একটা জলিলকে দিলেন, অন্যটা নিজে খেলেন ৷ জলিল খুব দ্রুত বিস্কিটের প্যাকেটটা চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেয়ে শেষ করে ফেললো ৷ সোবহান সাহেব পকেট থেকে পয়সা বের করে দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বের হলেন ৷
সোবহান সাহেবের পানের নেশা নেই ৷ তবুও এই মুন্সীবাড়ি এলাকায় এলে উনি পান কেনেন ৷ চায়ের দোকানটার চা টা খুব ভাল, কিন্তু খাওয়ার কিছুক্ষন পরেই মুখ মিষ্টি মিষ্টি লাগে ৷ আধাঘন্টা পর মুখ থেকে দূর্গন্ধ বের হয় ৷ এখানে চা খাওয়ার পরে তাই সোবহান সাহেব একটা পান খান ৷ এই চায়ের দোকানদার পান বিক্রি করে না ৷ সামনে ৩ মিনিট হেঁটে গেলে মুন্সীবাড়ির গলির মাথায় এক ভ্যানওয়ালা প্রায়ই বসে থাকে ৷ সবসময় এই ভ্যানওয়ালা থাকে না ৷ ভ্যানে নানা ধরনের আইটেমের পশরা সাজিয়ে বসে থাকে ৷ খেলনা, চকলেট, ধর্মীয় বই, মাফলার, টুপি, মেছওয়াক, তসবী আরো কত কি! পাশেই পানের ডালা ৷ বললেই চট করে স্পেশাল পান বানিয়ে দেয় ৷
সোবহান সাহেব জলিলকে ভ্যানের সামনে রিক্সা থামাতে বললেন ৷ ভ্যানওয়ালাকে মুন্সীবাড়ির আশেপাশে প্রায়ই দেখা যায় ৷ মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ ৷ পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পড়া ৷ কপালে সেজদার কালশিটে কালো দাগ ৷ টুপি পড়া ভ্যানওয়ালা মোকছেদুল মোমেনিন হাতে বসা, মনযোগ বইয়ের দিকে ৷ ব্যাবসা-বাণিজ্য হয়তো তেমন নেই আজকে ৷ সোবহান সাহেব তিন খিলি পান কিনলেন ৷ দুই খিলি পকেটে রেখে দিয়ে এক খিলি নিজে খেলেন ৷
- জানেন স্যার, আমার মাইয়া পরী খুব সুন্দর গান করে! বড় মিডা গলাটা ৷ পয়সা থাকলে অরে গান শিখাইতাম, হারমুনি কিনা দিতাম ৷
- তাহলে পয়সা জমান এখন থেকেই ৷ তাহলেই তো হয় ৷
- হেহ, গরীবের আবার হারমুনি! পয়সা তো জমাইতাছি স্যার ৷ তয় হারমুনির লেগা না ৷ একটা নয়া রিশকার লেগা ৷ ২ হাজার ট্যাকা জমছে ৷ আরো ৮ হাজার জমাইতে পারলে একটা নয়া রিশকা খরিদ করমু ৷ সেই ভোরে ক্ষ্যাপ দিতে বাইর হৈ, ফিরি সন্ধ্যায় ৷ সন্ধ্যার আগে আগে রিশকা জমা না দিলে মাহাজন ৫০ ট্যাকা জরিপানা করে ৷ গালাগালি করে ৷ সারাদিনে ইনকাম হয় ৬০০-৭০০ ট্যাকা ৷ তার মৈদ্ধেত্তে যদি ২৫০ ট্যাকা মাহাজনরেই দেই, তাইলে আমার সংসার চলে ক্যামনে কন?
- তা তো ঠিকই ৷
- একটা নয়া রিশকা খরিদ করতে পারলে যহন খুশী রিশকা লয়া বাইর হমু ৷ রাইতেও ক্ষ্যাপ দিতে পারুম ৷ সন্ধ্যার পরে রিশকা দিয়া কুসুমরে বাসায় লয়া আইতে পারুম ৷ কুত্তার বাচ্চা সগীর বড্ড জ্বালায় আমার মাইয়াডারে! থুহ!
জলিল আবার একদলা থুথু ফেললো ৷ সগীরের প্রসঙ্গ মনে আসলেই তার মুখে থুথু জমে ৷ সোবহান সাহেব আরেক খিলি পান বের করে মুখে দিলেন ৷ জলিলের দিকে অন্য খিলি পানটা এগিয়ে দিলেন ৷ জলিলের পান খাওয়ার অভ্যাস আছে, দেখলেই বোঝা যায় ৷ দাঁত লাল হয়ে আছে ৷ জলিল হাত বাড়িয়ে পান নিয়ে জোরে জোরে প্যাডেল মারতে লাগলো ৷ সগীরের উপর তার মেজাজ খুব খারাপ হয়েছে সেইদিনের পর ৷
মুন্সীবাড়ি থেকে ২০ মিনিট দূরত্বে এই জংলাবাড়ি স্টেশনে লোকজন নেই বললেই চলে ৷ স্টেশনে স্টেশন মাস্টার আর একজন কর্মচারি ৷ ট্রেন থামে না এখানে ৷ সকালে একটা ট্রেন, আর রাতে একটা ট্রেন থামে ৷ জনবসতিও নেই তেমন ৷ জংলা এলাকা ৷ পান খাওয়ার ১০ মিনিট পর জলিল জংলাবাড়ি স্টেশনের কাছাকাছি এসে হড়হড় করে বমি করলো ৷ নাকমুখ দিয়ে সমানে বমি হচ্ছে জলিলের ৷ চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে ৷ সোবহান সাহেব রিক্সা থেকে নামলেন ৷ পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট্ট একটা কৌটা বের করলেন ৷ হাতে প্লাস্টিকের ডেসপোসেবল গ্লাভস পড়লেন যেন কাজ শেষে খুলে ফেলে দেয়া যায় ৷ কৌটা থেকে অল্প মলম নিয়ে জলিলের টকটকে লাল চোখে ডলে দিলেন ৷ পেট ব্যাথা আগেই ছিল, সাথে চোখের জ্বলুনীতে জলিল চিৎকার করতেও ভুলে গেছে ৷ বদি’র এই মলমটা খুব কাজের ৷ ভিকটিমের চোখে দেওয়া মাত্র ভিকটিম চিৎকার চেঁচামেচি করতে ভুলে যায় ৷
জলিল ব্যাথায় ছটফট করছে, তার মুখ দিয়ে ফ্যানা ভাঙ্গছে ৷ রাস্তায় গড়াগড়ি করছে আর “ও কুসুম.. ও মা পরী!” বলে ফিসফিস করে বিড়বিড় করছে ৷ সোবহান সাহেব রিক্সাটা নিয়ে টেনে টেনে স্টেশনের দিকে রওনা হলেন ৷ ৫ মিনিট হেঁটে গেলেই স্টেশন ৷ সেখান থেকে বদি কে ফোন করে দিলেই বদি পিকআপ গাড়ি নিয়ে চলে আসবে ৷
বেশিক্ষন লাগলো না ৷ ২০ মিনিটেই রিক্সাসহ সোবহান সাহেবকে গাড়িতে তুলে নিলো বদি ৷ আমিনবাজারে সোবহান সাহেবকে বদি নামিয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু সোবহান সাহেব উনাকে সাইকেলের দোকানে নামিয়ে দিতে বললেন ৷ সাদমানের জন্যে একটা লাল সাইকেল কিনবেন ৷ হাতে নগদ ৫ হাজার টাকা আছে এখন ৷ ৩ হাজার টাকায় একটা ভাল সাইকেল পেয়ে যাওয়ার কথা ৷ বিনু কখনও তেমন কিছু চায় না ৷ আজকে আবদার করেছে নাতীকে সাইকেল কিনে দেবার জন্যে ৷ বিনুর জন্যেও একটা ভাল দেখে শাড়ি কিনবে ৷ জন্মদিনে সেই নতুন শাড়িতে বিনুর হাসি হাসি মুখ, ভাবতেই সোবহান সাহেবের বেশ ভাল লাগছে ৷ শাড়ি আর সাইকেল পেলে বিনুর মুখটা হবে দেখার মত ৷ স্বামীকে আর কটু কথা বলতে পারবে না, খোঁটা দিতে পারবে না ৷ বাজার থেকে ভাল দেখে কিছু চিংড়ি মাছ, আর লাল শাকও কিনতে হবে ৷ আফজাল সাহেবের স্ত্রী’র হাতে লাল শাক দেখে এখন হঠাৎ লাল শাক খেতে ইচ্ছা করছে ৷ চিংড়ি মাছ দিয়ে লাল শাক, মন্দ হবে না ৷ চিংড়ি দিয়ে লাল শাকের কথা ভাবতেই সোবহান সাহেবের খুব ক্ষিদে পেয়ে গেলো ৷
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:২৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×