বছরখানেক আগের কথা। আমি একটা রেস্টুরেন্ট থেকে চা পান করে বের হয়ে একটা পানের দোকানের সামনে যাই সিগারেট নিতে। সিগারেটটা ধরিয়ে কেবল একটা টান দিয়েছি, ঠিক সে সময় একজন ব্যক্তি এসে আমাকে বেশ রাগাম্বিত হয়ে বললেন,
-’আপনি আপনার মোচের জন্য কত টাকা পান?’ আমি কথাটা শুনে, অবাক হয়ে ঐ ব্যক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমাকে এভাবে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে আবার তিনি বললেন,
-’বললেন না, আপনি আপনার মোচের জন্য কত টাকা পান?’ এবার আমি নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
-’আমি আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি কি আমাকে বিষয়টা ভাল করে বুঝিয়ে দেবেন?’ তিনি বললেন,
-’সরকারের কাছ থেকে আপনি মোচের ভাতা নেন না?’ আমি বললাম,
-’এটা কোন অফিস থেকে প্রদান করা হয়, একটু অনুগ্রহ করে বলবেন? তাহলে আমি অনেক উপকৃত হবো। কারণ আমি বর্তমানে ভীষন অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছি। ভাতাটা পেলে হয়তো কিছুটা আমার জন্য সুবিধা হতো।’
-’আমি আপনাকে খুব ভাল করে চিনি। আপনি একজন মুসলমানের সন্তান হয়ে, এত বড় বড় মোচ রেখেছেন, এটা কি ঠিক করেছেন? জানেন না মোচের পানি হারাম?’ কথাটা আমার কানে পৌঁছাতেই মনে মনে বললাম, ’আজ তুমি মরেছো। ভাল লোকের পাল্লায় তুমি পড়েছো।’ ঠোঁটের কোনে একটু মুচকি হাসি এনে বললাম,
-’মোচের পানি হারাম, এটা আপনি কোথায় পেয়েছেন? একটু বলবেন?’
-’কেন আপনি জানেন না, এটা হাদিসের কথা।’
-’কোন হাদিসের কত নম্বর হাদিস বলতে পারেন?’
-’না, তা আমি জানি না।’
-’তাহলে এটা পেলেন কোথায়?’
-’কেন হুজুরেরা ওয়াজে বলেন। এই বিষয়ের উপর একজন হুজুরের সিডিও আছে।’
-’হুজুর বললো, সেটা শুনে আপনি আমাকে বলতে আসলেন? আপনি হাদিস পড়েন নি কোন? আপনি জানেন, কোরআনের প্রথম শব্দটা কি ছিল?’
-’কি?’
-’ইকরা। ইকরা শব্দের অর্থ কি জানেন?’
-’না।’
-’ইকরা শব্দের অর্থ হলো ’পড়’। অর্থাৎ আল্লাহ শুধু নবীকে পড়তে বলেন নি, সবাইকেই পড়তে বলেছেন। না পড়লে যে আল্লাহকে চেনা বা জানা যাবে না।
আর আল্লাহকে না চিনলে যে আল্লাহর সব আদেশ নিষেধ সঠিকভাবে জানতে পারবেন না। না জেনে কাউকে কিছু বলাটাও কিন্তু এক প্রকার পাপ। এটা বুঝেন?’
-’তাহলে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, হুজুর মিথ্যা বলেছেন?’
-’এটা আপনিই ভাল বলতে পারবেন। এতদিন হুজুরের ওয়াজ শুনেছেন। এবার আমার ওয়াজ শুনবেন?’
-’বলেন।’
-’আচ্ছা, হারাম মানে তো নিষেধ বা বাতিল?’
-’হ্যাঁ।’
-’মানুষের জন্য নিষেধ বা বাতিল কে করতে পারে, এটা কি বলতে পারেন?’
-’আল্লাহ ও আল্লাহর নবী (সঃ)।’
-’না, আপনি সম্পূর্ণটা ঠিক বলেন নি। মানুষের জন্য কোন কিছু নিষেধ বা বাতিল একমাত্র আল্লাহই করতে পারেন। আল্লাহর নবী হলো সেই বাতিল বা নিষেধের বার্তাটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন মাত্র। নবীর কোন এক্তিয়ার নেই কোন কিছু নিষেধ করা। আর যেহেতু আপনি বলেছেন এটা হাদিসে আছে, সেহেতু মোচের পানি হারাম এটা ঠিক না। আপনি কি বলতে পারবেন, মোচের পানি হারাম এটা কোরআনে কোথাও লিখা আছে?’
-’না। আমি শুনেছি এটা নাকি হাদিসেই লিখা আছে।’ এরপর তাকে সহি হাদিসের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে অনেক হাদিসের বরাত দিয়ে আলোচনা করলাম এবং বোঝালাম যে,
-’সব সহি হাদিস সঠিক না। আর হারাম হালালের কথা হলে তাতো হাদিসের মধ্যে থাকার কথা না। আল্লাহ কোরআনের মধ্যে সব হারাম হালালের কথা উলেখ করেছেন। আর নবীকে (সঃ) আল্লাহ শুধু তার বাণী মানুষের কাছে অনুশীলনের মাধ্যমে পৌঁছানোর জন্য বলেছেন। এজন্য আল্লাহ বলেছেন ’আল্লাহ এবং আল্লাহর নবীর তাবেদারী করতে।’ এর অর্থ এই নয় যে নবী নিজেই আল্লাহর ভুমিকায় নিজেকে দাঁড় করাবেন। যদি তা করতেন তাহলে তিনি নিজেই নিজেকে কুফরির মধ্যে ফেলতেন। নবী এটা কখনই করতে পারেন না। তাই তিনি হাদিসে আল্লাহর হুকুম হিসাবে কোন হারাম হালাল এর নির্দেশনা দিতে পারেন না। যাহোক আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি একজন মুমেন ব্যক্তি। আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে মানুষ চলাফেরা কর“ক সেটা আপনি মনে প্রাণে চান। আচ্ছা আপনাকে এখন আমি জিজ্ঞাসা করি, কোরআনে যে সব হারাম হালালের কথা উলেখ আছে যেমন, মিথ্য কথা বলা যাবে না, অন্যায় করা যাবে না, দুর্নীতি করা যাবে না, অন্যের হক আত্মসাৎ করা যাবে না, সকলের হক সঠিক ভাবে আদায় করতে হবে ইত্যাদি। যেমন একটি মিথ্যা কথা দিয়ে একজনের জীবন নেয়া যায় বা অন্যের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়া যায় বা যে কোন একজন সমাজে অপমানিত করা যায় ইত্যাদি। মিথ্যা কথা বলা, অন্যায় করা, দুর্নীতি করা, হক ছিনিয়ে নেয়া ইত্যাদি হারাম এবং এই কাজগুলো দিয়ে অন্যের প্রতি জুলুম করা হয়, যা কোরআনে উলেখ করা আছে। আপনি কি কখনও ঐ হারাম প্রসঙ্গে কারও নিকট প্রাতিবাদ করেছেন?’
-’না।’
-’অথচ যে হারামের কথা কোরআনে বলা নেই, যে হারাম দ্বারা অন্যের কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই, যদি কোন ক্ষতি হয় তা আমার নিজেরই ক্ষতি হতে পারে, সেই হারামকে আপনার কাছে এত রড় আকারে হারাম বলে মনে হলো যে, প্রতিবাদের সুরে আমাকে প্রতিবাদ করতে ছুটে আসলেন এবং এই হারাম কাজ করেছি বলে আপনি আমার বংশ শুদ্ধ মুসলমান ছিল কি না সেই প্রশ্নও তুলে বসলেন। আসলে এটা আপনার দোষ না। এটা হলো আপনি যে একজন ধর্মান্ধ ধার্মিক, এটা তার পরিচয়। মন খারাপ করবেন না। সত্যিকার অর্থে কি, আমাদের মুসলমাদের এটাই আসল চরিত্র এবং পরিচিতি। আমরা না জেনে, না বুঝে, না শুনে, না পড়ে মুসলমান। তাই নিজের ভুল না দেখে অন্যের ভুল দেখে বেড়াই। আর এজন্যই আমার মোচগুলো এত বড় বড় রেখেছি, যাতে আমার মোচ দেখে আমাকে প্রশ্ন করেন, আমিও আপনাদেরকে আমার মোচের পানি খেয়ে আপনাদের অজ্ঞতাগুলোকে আঘাত করতে পারি, যাতে আপনারা আপনাদের ধর্মন্ধতা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন।’ আমার কথাগুলো শুনে লোকটি আমাকে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেলেন। এরপর বিকেলে যখন তার সাথে দেখা হলো, অনেক দূর থেকে আমাকে সালাম জানিয়ে কাছে এলেন। এখনও তার সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হয়, কথা হয়, তবে সে আমার কাছ এলে, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করতেই এখন মজা পান বেশী।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




