ঊর্মিকে আমার ভালো লাগত। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল ওয়াপদা কলোনি। ঊর্মির বাবা ওয়াপদাতে চাকরি করতেন। ঊর্মি আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। কোন ক্লাসে পড়তাম? ক্লাস টু। গাড়াগন্ধ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুল ছুটির পর ওয়াপদাতে যেতাম। ঊর্মিদের বাসার পেছনেই কদমগাছ, এ রকম বর্ষায় কত কত কদম ফুটে থাকত। ছয় কি সাত বছরের সেই কদম, সেই বর্ষা, সেই ঊর্মি এখন কোথায়? আর কোনোদিনও ফিরে আসবে ছোটবেলা? ছোটবেলার বৃষ্টিবাদল, ঊর্মিকে দেখার লোভ?
ভাবছি, ঊর্মিকে নিয়ে একটা বড়সড় কবিতা লিখব। না, কোত্থাও ছাপাতে দেব না। কবিতাটি ঊর্মিকে পড়তে দেব। কিন্তু ওকে পাব কোথায়? পৃথিবী এমন কেন? মানুষ কেন বড় হয়ে যায়? আমি কেন ঊর্মিকে হারাই? সত্যি সত্যি আর কোনোদিন আমি ঊর্মির দেখা পাব না? শুধু তো দেখাই... তাই ঊর্মিকে নিয়ে যদি সত্যি সত্যি একটা কবিতা লেখা হয়ে যায়, ঊর্মিকে না পেলে কবিতাটি কাউকে পড়তে দেব না। সমুদ্রের দিকে যখনই যাব, জাস্ট ঢেউয়ের ওপরে ছুড়ে মারব আমার ঊর্মিকে নিয়ে কবিতা। জানি, ঊর্মি একদিন আমার লেখা পড়বে। জানি, ঊর্মি হয়তো আমার লেখা কখনই পড়বে না, ও হয়তো ভুলেই গেছে সেই ছোটবেলার বৃষ্টি-বর্ষা-কদম-টু'তে পড়া ছেলেটাকে। আচ্ছা, এই লেখা কি কোনোভাবেই পড়তে পারে ঊর্মি? সেটা সম্ভব? কে জানে?
এরপর বলব রূপালির কথা। রূপালির বাবাও ওয়াপদাতে চাকরি করতেন। আমি রূপালিকে খুব পছন্দ করতাম। রূপালিও জানত। ফোরে পড়ি তখন আমরা। রূপালিকে আমি কী বলে যেন খুব ক্ষেপাতাম। রূপালিও ক্ষেপে যেত। ওর ক্ষেপে যাওয়াটাই আমার বেশি ভালো লাগত। এ রকম বর্ষার দিনে একবার স্কুল ছুটি হয়ে গেল। ঘণ্টা পড়ল। ছেলেমেয়েরা সবাই বেরিয়ে গেছে। আমাদের স্কুলের ক্লাসরুমে কোনো তালা লাগানো হতো না তখন। তো যখন ঘণ্টা পড়ে, তখন আমি ক্লাসের বাইরে ছিলাম। ফলে দৌড়ে ক্লাসের দিকে গেলাম। ক্লাসের বেঞ্চের ওপর আমার বইখাতা রাখা আছে। সেগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরব। কিন্তু ক্লাসে গিয়ে দেখি, শুধু রূপালি ছাড়া ক্লাসরুমে আর কেউ নেই। ওকে একা দেখে বললাম, 'সবাই চলে গেছে, তুমি বসে আছ কেন?' রূপালি বলল, 'তোমার জন্য।' কী আশ্চর্য! এ লেখা যারা পড়বে কী ভাববে, ক্লাস ফোরের দুটো ছেলেমেয়ে এ কী রকম কথা বলে? ওই পিচ্চি বয়সেই এসব কিসের লক্ষণ?
ক্লাস ফোরে থাকতেই রূপালির বাবাও বদলি হয়ে চলে গেল। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। রূপালি যে এখন কোথায়, কেমন আছে_ জানি না, কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে। সেদিন আমি আর রূপালি যখন ক্লাসরুম থেকে বের হব তখনই নামল বৃষ্টি। আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় আটকা পড়লাম রুমের মধ্যে। পুরো স্কুল তখন ছুটি। সবাই চলে গেছে। আমি রূপালিকে বললাম, 'বাসায় যাবা না?' রূপালির জবাব, 'এত বৃষ্টি! কীভাবে যাব?' তারপর আমরা আর কী কী বলেছি সেদিন_ তা কী আর মনে আছে?
রূপালিকে নিয়েও একটা বড়সড় কবিতা লিখব। রূপালিকেই পড়তে দেব। কিন্তু ওকে আমি পাব কোথায়? রূপালিকে যদি না পাই দেখা আর, একদিন, জোছনায় রূপালিকে নিয়ে লেখা কবিতাটি পকেটে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব কুমার নদের পাড়ে, রূপশালী চরাচরে বালুর মধ্যে পুঁতে দেব কবিতাটি। কেউ জানবে না, আমি রূপালিকে মনে রেখে কবিতা পুঁতছি বালুচরে, জোছনায়। আর তখন যদি বৃষ্টি এসে পড়ে, বালুচরে শুয়ে থাকব সারারাত।
জোছনায়, রূপালি বালুর চরে কবিতা পুঁতে রাখলে কবিতাগাছ জন্ম নেয়। অঙ্কুরিত কবিতাগাছ একদিন বড় হয়। কবিতাগাছের পাতায় পাতায়, ডালে ডালে শুধু কবিতা ফুটে থাকে। কবিতাফুল ফোটে। কবিতাফুল ঝরে। রূপালি হয়তো কোনোদিনই জানবে না, তার জন্য কবিতাগাছ জন্ম নিয়েছে বালুচরে, জোছনায়। যে গাছ পুঁতেছি আমি। গাছ মানে কবিতা। কবিতা পুঁতেছি আমি। যারা পড়ার পড়বে, কেউ না পড়লেও কোনো অসুবিধা নেই।
এরপর কি শিখার কথা বলব? শিখা কোথায়? শিখা আজ কোথায় জ্বলতেছে? কোনোদিন দেখা পাব ওই স্কুলপড়া মেয়েটাকে? কোত্থাও খুঁজে পাব স্কুলবান্ধবী সাধনাকে? সাধনা কোথায়? সাহিদা কোথায়? জেসমিন কোথায়? স্বপ্না কোথায়? স্বপ্নার সৎমায়ের মেয়ে যমুনাইবা কোথায়? স্মৃতি, খুব কোঁকড়ানো ছিল ওর চুল_ স্মৃতি কোথায়?
কোথায়, কোথায়, কোথায়? আমিইবা কোথায়?
আজ মন বরষাপীড়িত। আজ মন উতলা। আজ মন নিজের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ দেখাচ্ছে। স্কুল লেভেলের মেয়েগুলোকে আমি আর হয়তো দেখা পাব না, তবু ওদের জন্য কবিতা লিখব। কোনো কবিতা সমুদ্রে ভাসিয়ে দেব বোতলবন্দি চিঠির মতো করে, কোনো কবিতা জোছনায় নদীচরে বালির মধ্যে পুঁতে দেব। কারণ, ওইসব কবিতা কোনো কাগজে ছাপাতে দেব না, ব্লগে পোস্ট দেব না, এমনকি আজকের কোনো পাঠক তা পড়ূক, আমি তাও চাই না...
কী চাই তবে? কী চাই তুমি জানো না?
কালের খেয়া , ৯ জুলাই ২০১০, সমকাল