somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক ফালি তরমুজ

০৮ ই জুন, ২০১২ সকাল ১১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রশ্ন, তরমুজ কেন বালির ওপরে ফোটে? পিপাসা কেন ছোটে রসের সন্ধানে? পিপাসা ও রস, বিপরীতার্থক। পরিপার্শ্ব পিপাসাময়। এ সময় জানা হয়, হরিণীর নাভি থেকে শীতকাল উড়ে যায় গ্রীষ্মের দিকে। ফলে গ্রীষ্মের অববাহিকার খোলা বারান্দায় বসে দেখতে পাই, পিপাসা আসছে। পিপাসা আসছে বহুদূর থেকে। পিপাসা উড়ে আসছে, পিপাসা ঘুরে ঘুরে আসছে। পিপাসা আসছে রসের খোঁজে। সঙ্গতকারণেই দৃষ্টিগোচর হয়, এক ফালি তরমুজ হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ কবি, ফালি থেকে মাত্র এক কামড় তরমুজ তার মুখে। তার মুখের মধ্যে রস, রসের মধ্যে তার ডুবে যাওয়ার অতল আহ্বান। তরুণ কবি ডুবে যাক, তরুণ কবি দাঁড়িয়ে থাক রাস্তায়, তার হাতে থাক এক ফালি কাটা তরমুজ। তরুণ কবির মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ূক তার মনোজাগতিক বালুচর, তার মনস্তাত্তি্বক নদী। নদীর পাড়েই তরমুজের চাষ, বালির ওপরে। তরুণ কবিই বলুক, হরিণীর নাভি থেকে শীতকাল উড়ে যায় গ্রীষ্মের দিকে। লক্ষ্য করতে পারি, তরুণ কবির গন্তব্য কোথায়? নদীপাড় ছেড়ে, নদী পাড়ের বালিভূমি উত্থাপিত রস-প্রস্তাব ছেড়ে তরুণ কবি আর কোথায় যেতে পারে, এই দুপুর রোদের ঝাঁ-ঝাঁ-য়? কীভাবে আতঙ্ক ছড়ায় গ্রীষ্মের সন্ত্রাস, তরুণ কবির বুকে? কেবল দু-একটি পঙ্ক্তি উড়ে যায়। দু-একটি পঙ্ক্তি হঠাৎ পথ হয়ে যায়। পঙ্ক্তি-পথে হাঁটতে হাঁটতে, রোদে পুড়ে ঘামতে ঘামতে কে আর যায় তরুণ কবির সঙ্গে? গাছ ডেকেছিল তাকে, ছায়া ডেকেছিল তাকে, কাক ডেকেছিল তরুণ কবিকে, সে দাঁড়ায়নি। তার গন্তব্য কোথায়?
রাস্তার মোড়ে ডাব নিয়ে বসে আছে ডাবওলা। একটি ডাব জানে, এ সময় তার কত বেশি রসমূল্য! কত বেশি মহার্ঘ্য তার জলজজীবন। 'দু'হাতের মুঠোয় ধরে একটি কাটা ডাব এক চুমুকেই নিঃশেষ' করে দেওয়ার অভিপ্রায় কি ছিল না তার, তরুণ কবির? তরুণ কবি আজ ডাবের মুখোমুখি হতে চায়। এক জোড়া ডাব তাকে গ্রীষ্ম থেকে গ্রীষ্মান্তরে ঘুরিয়ে মেরেছে, ঘুরিয়ে মারছে। ভুবনমোহন পিপাসা তাকে অতিক্রম করিয়ে চলে, তাকে চরৈবেতি করে তোলে। হঠাৎ ঘোর-বাল্যকাল তাকে তাড়া করে নিয়ে যায় মধুপুরের দুপুরের আমবাগানে, আমের কী বাহার, লিচুর কী বাহার। কত কাল আগের দুপুর, কতকাল আগের আমবাগান, লিচু গাছ, কতকাল আগের পিপাসা_ তবু পিপাসা মরেনি। পিপাসা দিনে দিনে আরও বিস্তৃত, পিপাসা তার ভাবনায়। ভাবনা একটা সন্দেশ। ভাবনা-সন্দেশে চোখ রাখিয়ে বাল্যকাল তরুণ কবিকে ছেড়ে যায়। কত ঋতু চলে যায়। কত রোদ ঝরে মরে কোথায় উধাও! তরুণ কবি উধাও হতে চায়, ঊধর্ে্ব, অতলে। দু-একটি বাক্য তাকে ডেকে নিয়ে যায় ভাঙা রাজবাড়ির পরিত্যক্ত কোঠায়। নির্জনতা, তখন ভাঙা রাজবাড়িতে কত ঐশ্বর্যময়। মাঠান্তরের ঢিলিমিলি রৌদ্ররেখা চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মনে হয় এ রকম রোদরেখাকে ধরে ফেলা যাবে দু-একটি বাক্যে। কিন্তু কিছুতেই আর রোদরেখা ধরা পড়ে না। বাক্য হয়, কিন্তু বাক্যের মধ্যে পর্যাপ্ত রোদ পাওয়া যায় না, বাক্যের মধ্যে ঢিলিমিলি রোদরেখা পাওয়া যায় না। বাক্যের মধ্যে তরমুজ লেখা হয়, ডাব লেখা হয়, আম-লিচু লেখা হয়, কিন্তু বাক্যে সেই রস আর আসে না, যার জন্য গ্রীষ্ম থেকে গ্রীষ্মান্তরে ঘুরে মরে তরুণ কবি, বাক্যে আর পিপাসা মেটে না। পিপাসা ক্রমশ তার সীমানা বাড়িয়ে নেয়, পিপাসা ক্রমশ আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠে। সবুজ পিপাসা নিয়ে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, এক অনিঃশেষ যাত্রায় তরুণ কবি কোথায় পেঁৗছুতে চায়? আমরা হয়তো বুঝেই উঠতে পারি না, জনপদের ভিড়ে তরুণ কবি আসলে কে? কী তার প্রার্থনা? আমরা ধরতেই পারি না, শহরে তরুণ কবি কী এঁকে নির্মাণ করে তার বুকের মধ্যে আরও একটি শহর? তার বুকের মধ্যের সেই শহরের মানচিত্র কেমন? সেখানেও কি নদী আছে, নদীপাড়ের তরমুজ ক্ষেত আছে, রাস্তার মোড়ে ডাবওলা আছে, সেই শহরেও কি হরতাল আছে, গণমাধ্যম আছে, হাসপাতাল-অ্যাম্বুলেন্স আছে? তরুণ কবির বুকের মধ্যে, বুকের মধ্যের শহরে কি গণগ্রন্থাগার আছে? তাকে তাকে তাকানো কবিতার বই আছে? 'বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা' আছে? 'খরাদাহ' আছে? গ্রীষ্মের সন্ত্রাস আছে?
'যখনই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি, তরু, তখনই তুমি পাখি হয়ে যাও। তখন তোমার পাতাগুলোই সব ডানা। তখন তুমি স্থির থেকে সঞ্চরণশীল। তখন তোমার দু-একটি পালক হাওয়ায় উড়ে যায়। উড্ডীন পালকের দিকে লক্ষ্য রেখে, ফের ভাবি, এবার একটি পালক আমি কুড়িয়ে নিতে চাই।... ওহ্ তোমার পালক! তখন তোমার পালককে আমার মনে হয় ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলা ঘুড়ি। কিন্তু উড়ে উড়ে পালক গিয়ে পড়ে নদীর ওপরে। আমি নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবি, নদী, তোকেই ধরে নিয়ে যাব, ঘরে নিয়ে যাব। দু'হাত মেলে নদীকে আঁকড়ে ধরি। কিন্তু নদী কোথায়? এ তো শুধু জল, গড়িয়ে যাওয়া স্রোত, বড়জোর চিত্রকল্পের ঢেউ, ঢেউ কি আর কেউ? কীভাবে তাকে আঁকড়ে ধরা যায়?' একটি স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে আমরা টের পেতে পারি, তরুণ কবির গতিবিধি, দাহিত অভিপ্রায়। গল্প আঁকা চোখে তাকিয়ে থাকা চোখ, কী দ্যাখে? গাছ দ্যাখে? কিন্তু গাছটা তখন পাখি। পাতাগুলো সব ডানা। নদীগুলো সব ঢেউ। কিন্তু ঢেউ কেউ না। তাকে আঁকড়ে ধরে ফল নেই। তবু তাকেই আঁকড়ে ধরার এই যে বাসনা, একে আমরা কী আখ্যা দেব? দেখতেই তো পাচ্ছি, নদীগুলো আর নেই। নদী মরে গেছে। হয়তো মনের মধ্যে একটা নদী আছে। আমরা হাঁটতে বেরুচ্ছি সেই মরা নদী তীরে। ভূমিতে, নদী মরে গেলে আর কী থাকে? মাছ থাকে? নৌকা থাকে? জেলেপল্লী থাকে? সাঁতারগুলো থাকে? সত্যি, বড্ড বদলে যাচ্ছে দিন। বদলে যাচ্ছে গ্রীষ্মের মতিগতি। কত কত গণমাধ্যম, তবু সব মানুষের কাছে তো এখনও পেঁৗছুতে পারেনি। কত কত সাময়িকী, কত কত গল্প-কবিতা, কত গ্রীষ্মাতিগ্রীষ্মের শিল্পকলা_ সেই একই চেনা মানুষের কাছেই তা ঘুরে ফিরে যায়। গ্রামগুলো কত দূরে। গ্রামের পাশে স্কুল, কলেজ, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা কত দূরের। আমাদের কবিতাগুলো, আমাদের স্বপ্নগুলো আজও পেঁৗছুল না। বনভূমি উজাড় হতে চলল। পাখিগুলো হারিয়ে গেল। ঘুড়িগুলো রীতিমতো আজ স্মৃতিসংগ্রহশালার টুকরো অনুভূতিমাত্র। এভাবে তো এগোনো যায় না। এগোতে হয়, সবাইকে নিয়েই এগোতে হয়। সবাইকে এগিয়ে নিলেই এগিয়ে যাওয়া হয়। দেশের মধ্যেই কত রকম দেশ। গ্রামভিত্তিক দেশ। কুঁড়েঘরের দেশ। খড়ের চালের দেশ। টিনের ঘরের দেশ। জেলা-উপজেলার দেশ। বড় শহরের দেশ। এক-এক দেশের একেক অধিবাসী। সবাই আমরা এক ভাষাতে কথা বলি। তবু বাংলা ভাষায় লেখা কবিতাগুলো সেই কিছু মানুষেরই বিষয়। কবিরাও আছে কিছু মানুষকে ঘিরেই। শিল্পীরাও সেই সামান্য ক'জনের শিল্পী। একটা ভীষণ দূরত্ব, ভীষণ বিচ্ছিন্নতার ভেতর দিয়েই চলে যাচ্ছে দিন, মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু। বিদ্যুতায়নের এত সাফল্য, তবু বিদ্যুৎ থেকে কত অংশ মানুষ বঞ্চিত এখনও? তার কোনো হিসাব আছে? নিজেকে মহান ভেবে চলা, বই লিখে ফেলা এই মানব শ্রেণী কতখানি আর মহান তবে?
তরুণ কবির বুক পকেটে মেঘ, ঘন কালো মেঘ। যে কোনো মুহূর্তেই কালবোশেখি নেমে আসতে পারে। তরুণ কবির চোখভর্তি ধুলো, যখন তখন ঘূর্ণিচক্র তৈরি হয়ে যাবে। তরুণ কবির নিঃশ্বাসের ধাক্কায় ধসে পড়তে পারে প্রতিষ্ঠিত মনুমেন্ট। তরুণ কবির দু'হাতে দুটি কাগজের উড়োজাহাজ, রানওয়ে ছাড়াই উড়ে যেতে পারে। তরুণ কবির পাঁজরজুড়ে মাঠ, সেই মাঠে গ্রীষ্মকাল রচনা লিখছে। তরুণ কবির পিঠের ওপর পিরামিড, ইতিহাসের বোঝা। তাকে বয়ে যেতে হবে। তরুণ কবির সর্বাঙ্গে পিপাসা, তাকে জলঢেউয়ের কবিতা লিখতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে, রোদের মধ্যে ঘামতে ঘামতে, অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ, মনে হয়, ঘেমে-নেয়ে একাকার। ঘামসূত্র রচিত হয় তখনই। রচিত হয় নিঃসঙ্গতার-বীভৎসতার চরম ইতিকথা। সেই-ই তার কবিতা। সেই-ই তার স্বপ্ন-শিল্পকলা ছবি। এরই মধ্য দিয়ে একবার ঘুরে আসা হয় চর্যাপদে, একবার সাতটি তারার তিমিরে। একবার মন, তরুণ কবির মন ভেসে যায় জোছনায়, জোছনা পড়ে বালুচরে। এক বিষাদগ্রস্ত ঈগল তখন ওড়াউড়ি করে। ঈগলের ডানায় ঢেকে ঢেকে যায় অর্ধেকটা চাঁদ। ছায়া পড়ে পৃথিবীতে। শুধু রোদ নয়, জোছনায়ও পুড়ে যায় তরুণ কবির মন। যে মনে পিপাসা জমেছে ঢের, আধা বাস্তব, আধা স্বপ্নের। এই স্বপ্নযাত্রায় তার হাঁটাচলা, তার মনের উজালা। ফলে লক্ষ্য করলে টের পাওয়া যেতে পারে, তরুণ কবি আসলে বড্ড অসামাজিক। সমাজ বলতে যা দাঁড়ানো, যা প্রতিষ্ঠিত, তার খাপছাড়া খানাখন্দ মানতে না পারা তরুণ কবি রচনা করে এক মানসিক সংবিধান, মানবিক ধর্ম, মনস্তাত্তি্বক সংস্কৃতি। তাকে আমরা কেউই টের পাব না, ধরতে পারব না বা ধরতে চাব না_ তা তো হয় না।
ভালোবাসা। কেবল, তুমুল ভালোবাসাই হচ্ছে সেই নদী, আঁকাবাঁকা বয়েও চলেছে, তরুণ কবির চোখে। ভালোবাসাই হচ্ছে সেই ধানক্ষেত, যার মধ্য দিয়ে আলপথ চলে গেছে দিগন্তপুরের মাঠ পেরিয়ে স্মরণযোগ্য গ্রামে। ভালোবাসাই হচ্ছে সেই শহর, যা জুড়ে আছে তরুণ কবির পাঁজরভূমিতে। ভালোবাসার জন্য তাই অনেক প্রতিষ্ঠিত রাস্তা তাকে ডেকেও পায়নি। ভালোবাসার জন্য তাকে ঘুমগুলো ঢলেও পায়নি রাতে। ঘুম ফিরে গেছে। দুপুরে, রোদ তাকে পেয়েছে। স্বপ্ন তাকে পেয়েছে। পিপাসা তাকে গ্রাস করেছে। ভালোবাসার পিপাসা, যা তরমুজে মিটবে না, ডাবেও পূরণ হবে না। কিন্তু সেই প্রতি মুহূর্তের বুদ্বুদ্, স্বচ্ছতোয়া ভালোবাসা কোথায়? পুঁজি কি ভেঙে দেয়নি তার স্বপ্নকণার বুদ্বুদ্ ধারণা? পুঁজি কি তাকে ছিটকে ফ্যালেনি সম্পর্কের অনির্ণেয় সুতো থেকে ছিঁড়ে, ছিন্ন করে? তরুণ কবি পুঁজির কাছে অনিচ্ছার দাস_ এটাও আজ মানতেই হয়। পুঁজি তার মুখে রেখা এঁকে দ্যায়। রেখা আরও রেখা এঁকে চলে। তরুণ কবির মুখে দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র ফুটে ওঠে।
তবু, বিশ্বাস ভাঙে না। গ্রীষ্মের একদলীয় শাসনেও বিশ্বাস ভাঙে না তরুণ কবির। রৌদ্রের ফ্যাসিস্ট ভ্রূকুটির মধ্যেও তরুণ কবি দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়, তার হাতে ধরা এক ফালি কাটা তরমুজ। সে তরমুজে একটি কামড় দেয়, তার মুখভর্তি রস। রসময় এই তরমুজ কেন বালির ওপরে ফোটে_ এই প্রশ্ন মাথায় নিয়েই মনে পড়ে, এখনই দেখা হওয়া দরকার। তরুণ কবির সঙ্গে নতুন একটি শব্দের, নতুন একটি বাক্যের, নতুন একটি চিন্তার দেখা হওয়া দরকার। তারপর চিন্তাটাকে ধরে, খাতায় বন্দি করে, কাগজে পাঠিয়ে দিতে হবে। ছাপা হয়ে যাবে তার লোনলিনেস, ছাপা হয়ে যাবে তার স্বপ্ন, ছাপা হবে শব্দ-বাক্যে তার পিপাসার পরিভাষা। ছাপা হয়ে যাবে তার আহত করুণ মুখ। শব্দের পরে শব্দ বসিয়ে বাক্য তৈরি হবে, বাক্য উড়ে যাবে। একটি শব্দ থেকে আরেকটি শব্দে যেতে গিয়ে, মধ্যপাতে যে-টুকু ফাঁকা, সেইখানে লুকিয়ে থাকা অনুভূতির মতো ভালোবাসা নিয়ে যে বসে আছে দূরে, যার সঙ্গে আপাতত কোনো যোগাযোগ নেই, তার কাছে পেঁৗছে যাবে তার অনিদ্রার ফুটনোট, তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের পাদটিকা। তখন স্বপ্নসম্পন্ন একটি মানবিক জনপদ নিশ্চয়ই আমরা পেতে পারি। কেননা, তরুণ কবি তার ভালোবাসার মানুষটিকে যে কবিতাটি নিজে মুখে শোনাতে চায়, তা তো সে লিখবে না, অন্য কেউ পড়ে নেবে, তাও হবে না, কারণ ভালোবাসার জন্য একটুখানি স্বার্থপরও হতে হয়, এটা
আমরা দেখতে পাই, রাস্তার পাশের দোকানে দাঁড়ানো তরুণ কবির হাতে এক ফালি কাটা তরমুজ। মাত্র একটি কামড় দিয়েছে সে। তার মুখভর্তি তরমুজের রস। তার পকেটভর্তি উড়ে যাওয়া দেশান্তরী মেঘ। সেই মেঘ জমে গেলে কালবোশেখি দেখা যাবে। তরুণ কবির নিঃশ্বাসে ভালোবাসার গন্ধ। তরুণ কবি ভালোবাসতে গিয়ে পুঁজির ক্ষমতা দেখতে পায়। তার পুঁজি নেই। তার ক্ষমতা নেই। একটি সদ্য রচিত তরুণ কবিতা কি আর এমন ক্ষমতা রাখে? তরুণ কবি নিজের মৃত্যু চিন্তা লুকিয়ে রাখে তার শব্দে, বাক্যে, তার বর্ণময় বিন্যাসে বিন্যাসে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে যদি একটা ভাঁটফুলও দিতে হয়, টাকা লাগবে। ভাঁটফুল এ শহরে পাওয়া যায় না। যেতে হবে দূর গ্রামে, রেললাইনের ধারে ভাঁটফুলের কাছে। যেতে হবে ধরলার কাছে, তিস্তার কাছে। যেতে হবে সমুদ্রে, পাহাড়ে। ফলে টাকা কিছু লাগবেই। কেন না, টাকা দিয়েই আজ বেঁধে দেওয়া হয়েছে সব প্রজাপতির ডানা, সব দক্ষিণ হাওয়ার গান। টাকার জন্য তরুণ কবি শেষ পর্যন্ত যাবে করপোরেট দুনিয়ার আসমানে? তাকে চাকরি করতে হবে! প্রতিদিন হাজির হয়ে জানাতে হবে, এই যে, আমি এসেছি। এই যে আমি কাজ পারি। এই যে আমার আনুগত্য। এই যে আমার সুসভ্যতা। তাই চাকরির জন্য তরুণ কবি তার বায়োডাটা নিয়ে যায় উঁচু বিল্ডিংয়ের সামনে। বায়োডাটায় লেখা, আমার ভালোবাসার মানুষটার কাছে যাব বলে কিছু টাকা দরকার, তাই চাকরি চাই, তাই হাজিরা দিতে রাজি হয়েছি। বায়োডাটা হাতে নিয়ে তরুণ কবি উঁচু বিল্ডিংয়ের লিফটের মধ্যে উঠে পড়ে। লিফটে আরও লোক, গাদাগাদিগাদা। লিফট সাঁই করে উঠে যায় পাঁচতলায়। লিফট উঠবে ১১তলা পর্যন্ত। ৫তলা পর্যন্ত উঠেই লিফটের মগজ বিগড়ে যায়। লিফট চোখের পলকে ঝাঁকি দিয়ে একটা শব্দ করে, কড়াৎ...কড়। ৫তলা থেকে লিফট মুহূর্তেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়ে ঝাঁকি মেরে পড়ে। লিফটের মধ্যের মানুষের লিফটবিদারী চিৎকার, মরণ চিৎকার, বাবা-মা-স্রষ্টার নাম করে চিৎকার আর হাউমাও শোনা যায়। কে বেঁচে গেল আর কে মরে গেল_ তাৎক্ষণিক বোঝা যায় না। বাইরে থেকে কারা যেন লিফটের দরজা ভেঙে ফ্যালে। তরুণ কবি লিফট থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েই পড়ে যায়। তারপর? কে জানে, কারা তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে গেছে? বায়োডাটা কোথায়? চাকরি কোথায়? টাকা কোথায়? ভালোবাসা কোথায়? পঙ্গু হাসপাতাল কোথায়? তরুণ কবি কোথায়? এক ফালি তরমুজ কোথায়? গ্রীষ্ম কোথায়? রোদ কোথায়? ঢিলিমিলি কোথায়?
পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, হাঁটুতে, বুকে, পিঠে ব্যান্ডেজ বাঁধা_ তরুণ কবি অঘোরে ঘুমুচ্ছে। বাইরে গ্রীষ্মকাল, বাইরে সেই রোদ, গলির মোড়ে সেই তরমুজঅলা, ডাবঅলা বসে আছে...
পঙ্গু হাসপাতলের বিছানায় ঘুমুচ্ছে তরুণ কবি। তার বুকের ভালোবাসা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন এক শব্দ হচ্ছে। তরুণ কবির শিয়রে নার্স, সাদা পোশাকের নারী। নার্স কি তরুণ কবির বুকে হাত দেবে? তার হাত ধরে দেখবে? নার্স কি বুঝবে, এই তরুণের বুকের মধ্যে দগ্ধ গ্রীষ্মকাল, বালিময় নদী, নদীর পাড়ে তরমুজ ক্ষেত, তরমুজে কত রস? জ্ঞান ফিরলে নার্স আমাদের কী জানাবে? বলবে, 'ওকে নিয়ে গিয়ে রেস্টে রাখতে হবে? ভালোবাসা দিতে হবে? ট্যাবলেটের বদলে ঘন ঘন চুমু দিতে হবে ওর ঠোঁটে? প্রেসক্রিপশনে এইসব লেখা থাকবে? কিন্তু নার্স যদি এক সময় এত অপেক্ষার পর মুখ কালো-নিথর করে বলে, 'স্যরি, অনেক চেষ্টা করেও আমরা ওকে বাঁচাতে পারলাম না। আপনারা ওর লাশ নিয়ে যান।' আমরা কি তখন নার্সকে জিগ্যাসাকে করতে পারি না, 'সিস্টার, লিফটের মধ্যে তো আরও ১০ জন ছিল, তারা বেঁচে গেল, আর ওকে বাঁচানো গেল না? কী হয়েছিল ওর? কোথায় আঘাত লেগেছিল?'
'ওর বুকে আঘাত লেগেছে। ভালোবাসা পাহাড় হয়ে ধাক্কা দিয়েছে তরুণ কবির বুকে। কোনো নার্স বা ডাক্তার কি আর ওকে বাঁচাতে পারে?'
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোথাও তরুণ কবিকে কোনো হাসপাতালের নার্স, ডাক্তার বাঁচাতে পারেনি কোনোদিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১২ রাত ১:৫৯
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×