ড. মঞ্জুরে খোদা
গত ২৩ ফেব্রুয়ারী মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাদেক হোসেন খোকার আলোচিত টেলিসংলাপের পর সিপিবি’র পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রদান করা হয়। বিবৃতিতে “নেতৃবৃন্দ মান্না-খোকার টেলিসংলাপকে অগ্রহণযোগ্য, ক্ষতিকর ও নিন্দনীয় বলে উল্লেখ করে বলেন, এসব বক্তব্যের সঙ্গে সিপিবির রাজনৈতিক অবস্থানের কোনো মিল নেই। বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে তা সিপিবির অবস্থানের বিপর্রীতমূখী। এবং মান্নার নেতৃত্বে পরিচালিত নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক জোটে শরিক নেই, এবং অতীতেও কখনো এ ধরনের কোনো জোটে শরিক ছিলো না। সিপিবি ১৫-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে বাসদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে একটি ‘বাম-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিকল্প’ গড়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মান্নার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো ব্যক্তি ও মহল সিপিবিকে জড়িয়ে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিবৃতি।”
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সিপিবিকে এই বিবৃতি প্রদান করতে হলো। তাদের ব্যাখ্যা সংগঠনটিকে ঘিরে ব্যাক্তি ও মহল বিশেষের অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি দূর করতিই এই বিবৃতি। কথা হচ্ছে এই অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির সুযোগ তাঁরা কেন ও কিভাবে পেল? আমার বিবেচনায় সংগঠনটির সদ্য অতীত কর্মকান্ড এই ‘অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকে’ উষ্কে দিতে সাহায্য করেছে। কি বিষয়ক বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার তার কোন পরিষ্কার ইঙ্গিত সেখানে নেই। কিন্তু সম্ভাব্য যারা এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত তার একটা সমীকরণ আমার কাছে এমন মনে হয় ১. সংগঠনের ভিতর-বাইরের যে ধারা গত নির্বাচনে অংশ না নেয়াটাকে সঠিক মনে করে না ২. যে অংশটি আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র বাইরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণতানন্ত্রিক দলগুলোর সাথে জোট ও যুগপৎ আন্দোলনের বিরোধী ৩. আওয়ামী ঘরনার অসাম্প্রদায়িক বলয়ের একটি বড় অংশ যারা দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল ৪. বিশুদ্ধ বাম বিপ্লবী দাবীদার ও ৫. এ্যন্টি পার্টি সেন্টিমেন্ট অংশের ভিতর থেকে প্রধানত এই কথিত বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের বিষয়টি ঘটছে। সামাজিক মাধ্যমের উপর পর্যবেক্ষনে আমার এমন ধারণাই স্পষ্ট হয়েছে। এই ঘটনার মধ্যদিয়ে যে সমালোচনাটি ফের সামনে আনা হয়েছে। তা হলো সিপিবি কেন এই সব পতিত নক্ষত্রের আলোয় বিকল্পের সন্ধান করছে? যারা প্রকারন্তরে ‘সুশীল ও নাগরিক সমাজের’ নাম ভাঙ্গিয়ে অন্ধকারের শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। যাদের প্রধান এজেন্ডা অগনতান্ত্রিক উপায়ে কারো ক্ষমতায় যাবার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। এবং সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তারা হত্যা-লাশ যোগানের বন্দোবস্তে তৎপর। যে বিষয়ের পরিষ্কার ইঙ্গিত মান্না সাহেবের টেলিসংলাপের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনা খুবই গুরুতর ও বিপদজনক! আজকে সিপিবি যদি তাদের এই তৃতীয় বিকল্পের অংশীদার করতো- তাহলে এই সংগঠনটি হতো তাদের বন্দুক রাখার কাঁধ। সেই দুঃখ ও ক্ষোভই হচ্ছে এই কথিত বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের অবকাশ!
বর্তমান দ্বিদলীয় ধারার বাইরে সিপিবি-বাসদের জোটের সম্প্রসারণ-আন্দোলন ও ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন ইস্যুতে গতবছর পার্টির নীচ থেকে উপর পর্যন্ত ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হয়। উভয় বিষয়েই পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিন্ধান্তের কারণে বৃহত্তর জোট গঠনের আকাঙ্খা ও নির্বাচনে যাবার সিন্ধান্ত কার্যকর হতে পারেনি। তর্কের খাতিরে বলি, যদি নেতৃত্বের সেই আকাঙ্খা ‘জোটের সম্প্রসারণ বা যুগপৎ আন্দোলন’ অব্যাহত থাকতো তাহলে আজকের পরিস্থিতি তাদের জন্য অনেক বেশি বিব্রতকর ও প্রশ্নবিদ্ধ হতো। যদিও আমি বিশ্বাস করি সিপিবি’র সেই আকাঙ্খা ছিল সৎ ও আন্তরিক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের সেই রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার বিষয়টি্ও জোড়ালো ভাবে সামনে চলে আসতো এবং সমালোচিত হতো আরেকটি রাজনৈতিক ভুলের কারণে। বিবৃতি অতীতের সেই বিষয়ের কোন উল্লেখ না থাকায় কথিত ‘ব্যক্তি ও মহলকে’ আশাহত করেছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে নানা ইস্যুতে যোগাযোগ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তারমানে এই নয় যে একজনের ভুল ও অন্যায়ের দায় অন্যকে দেয়া। কোন অসতর্কতায় তার সমালোচনা হতে পারে, সেখান থেকে শিক্ষা নেয়ারও বিষয় থাকে। ইতিমধ্যে সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক আলোচনায় মান্না সাহেবের এই অসাধু-অনৈতিক আচরণের কারণে নিজেকে প্রতারিত মনে করছেন বলে মন্তব্য করেন। ভাগ্যিস এই প্রতারণার কাহিনী বেশিদূর আগোতে পারেনি, কিন্তু থেমে নেই..! এই রকম রাজনৈতিক প্রতারণার কাহিনী আমাদের দেশে নতুন নয়, অসংখ্য। হোঁচট খেয়েছে, বাধাগ্রস্থ হয়েছে তবু থেমে থাকেনি গণতন্ত্র ও উন্নত সমাজের সংগ্রাম। একজন ব্যক্তির দায়কে সাধারনীকরণ করার মাধ্যমে বিকল্পের প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করাই হবে সঠিক। এই প্রশ্নের বিভ্রান্তি যতটা না প্রতিপক্ষের ক্ষতি করবে তারচেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি করবে এই ভাবনার পক্ষ্যের বিভিন্ন শক্তিকে।
সিপিবি’র রাজনৈতিক অবস্থান মান্না সাহেব তার টেলিফোন কথোপকথোনেই পরিষ্কার করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, দেশের বর্তমান সংকটে সিপিবি’র অবস্থান একক কারো পক্ষে নয়। কিন্তু কিছু ক্ষুব্ধ বন্ধুর আলোচনা শুনে মনে হচ্ছে কাজটি যেন সিপিবিই করেছে। ন্যায্য দুঃখ-ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু অন্যায় অপবাদ ও অন্যায্য সমালোচনা গ্রহনযোগ্য কি? মূলত যে ক্ষোভের থেকে যাদের দিকে নিশানা করে এই আলোচনা-সমালোচনা করা হচ্ছে সেই সব দল-জোটের শরীক শীর্ষ অনেক নেতা এইসব অপকর্মের অভিজ্ঞ কুশিলব পদ-পদবিতে বহাল তবিয়তে আছেন! কেবল উচ্চাভিলাষী নেতা মান্নার দিকে কেন তীব্র ঘৃণার আঙ্গুল, একটু এদিক-ওদিক করলেই পাওয়া যাবে এই ভয়ঙ্কর অপরাধের অনেক খলনায়ক! তাই তাৎক্ষনিক খন্ডিত সত্যের বিবেচনায় কোন ইতিবাচক প্রচেষ্টার ধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা দায়িত্বশীল কাজ নয়।
কোন বিষয়ের সরল বিশ্লেষন ও মন্তব্য করার মাধ্যমে কৃতিত্ত্ব জাহিরের প্রবণতা আমাদের পুরানো। এই ঘটনায় অনেকের আলোচনা-আচরণ সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। ভুল বা অন্যায় করা/হওয়ার সাথে সাথেই একজন মানুষের জীবনের সমস্ত কর্মের কাটাছেঁড়া শুরু করি। যেন তার জীবনের সমস্ত কৃতকর্মই অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক। তার সবকিছুই পাপে ভরা। এমন কি সম্পর্ক যাই থাক্ তার পরিবারের কোন সদস্যের কর্মের দায়ও তার উপর চলে আসবে এবং মুহুত্ত্বেই তার সমীকরণও হবে সেই ভাবে। বাংলাদেশের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো তাতে একই পরিবারের সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশ্বাস থাকা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু তারমনে এই নয় ভু্ক্তভোগীকে সেই দ্বায় দিতে বা নিতে হবে। ডান-বামদলের শীর্ষনেতার পরিবারের সদস্যদের ভিন্নদল ও বিপরীতমূখী রাজনীতি করার নজীর কি দেশে কম? আমাদের পরিবারেও আছে! বাংলাদেশের প্রায় সব পরিবারেই এই চিত্র পাওয়া যাবে। এই ধরণের কোন বিষয়ে কার্যকরণ সম্পর্ক থাকতে পারে না তা নয়, নাও থাকতে পারে, এটাও তো ঠিক। এই উভয় সম্ভবনা যদি আমি আধাআধি ধরি তাহলে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমান ছাড়া কেবল একটি ‘ইচ্ছা নিরপেক্ষ সম্পর্কের’ বিষয়ে এই ধরণের সিন্ধান্তে আসা কতটা যৌক্তিক। সত্য কেবল ততোটুকু না যতটুকু দেখা যায় বা জানা যায়, জানার বাইরেও জগত আছে!
একজন মানুষ কখনো ভাল তারমানে সবসময় ভাল, একই ভাবে একজন কখনো খারাপ তারমানে সবসময় খারাপ এটা কোন দায়িত্বশীল ও বৈজ্ঞানিক ভাবনা নয়। যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি তার বাইরে অনেক নেতা, ব্যক্তি, বিদ্বান, প্রতিষ্ঠান আছে যাদের অতীত অবস্থান, বক্তব্য ও কর্ম ছিল আজকের বিবেচনায় বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে সেটাকে আপনারা কোন যুক্তিতে ও বিবেচনায় সমর্থন করবেন? আসলে সমস্যাটা তখনই হয় যখন আমরা কোন দল, মতাদর্শ ও আকাঙ্খার অন্ধ সমর্থক হই। যুক্তির চেয়ে আবেগ ও উত্তেজনা তখন কাজ করে অনেক বেশী। জাতি পার করছে আরেকটি সংকটকাল। যড়যন্ত্রের নকশায় যুক্ত হচ্ছে নানা মাত্রা। সেখানে একজন সচেতন নাগরিকের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হতে হবে আরও দায়িত্বশীল ও সতর্ক।
লেখকঃ ড. মঞ্জুরে খোদা, গবেষক ও খন্ডকালীন প্রক্টর, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:৩৯