
'অমুকের পক্ষেও আইনজীবী আছেন', 'তমুকের পক্ষে দাঁড়াবেন না' কিংবা 'জেনে শুনেও অপরাধীর পক্ষে উকিল কেন?' এমন সব কথা আইনজীবীদের নিয়ে সবসময় হয়। এবং বলার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। প্রথমত, আমাদের চারপাশে ন্যাক্কারজনক অসংখ্য ঘটনা পুনঃপুন ঘটা এবং এসব জঘন্য প্রকৃতির অপরাধের শাস্তি হিসেবে ন্যায়বিচার পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা থেকেই বিবেকবান মানুষের এমন আবেদন। স্বভাবতই, সম্মানজনক এই রয়েল পেশায় নিয়োজিত বিজ্ঞ আইনজীবীদের নিকট সবার ভালো কিছু প্রত্যাশা থাকে। দ্বিতীয়ত, ফৌজদারি বিচার-প্রক্রিয়া তথা ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের প্রক্রিয়া বা মানদন্ডের বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকা। কারণ- আমরা সকলেই জানি ফৌজদারি বিচার-প্রক্রিয়ার তিনটি আবশ্যকীয় পক্ষ হলো বিচারক বা জুরি, প্রসিকিউশন (রাষ্ট্র পক্ষ) এবং ডিফেন্স ল'ইয়ার (আসামি পক্ষের আইনজীবী) এর যেকোনো একটি পক্ষের অনুপস্থিতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে না। বিশেষ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ একজন অভিযুক্তকে দিতেই হবে। কারণ- A fundamental principle of natural justice is that no man should be condemned unheard'।
তাহলে বিষয়টি হলো- আসামিকে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনে বাধা দেওয়া বিচার অস্বীকার করার শামিল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়োজনীয় নিশ্চয়তা দিয়ে গণআদালতের বিচারে আইন অনুসারে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অভিযুক্তকে নির্দোষ হিসেবে গণ্য করতে হবে। একই বিধান বিবৃত হয়েছে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত দেওয়ানি ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তিতে। বিষয়টা আমাদের সংবিধান দ্বারাও সুরক্ষিত হয়েছে এভাবে, "গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্রই গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না -অনুচ্ছেদ ৩৩(১)।
শুধু তাই নয়, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪০ ধারামতে একজন আসামি তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের অধিকার রাখেন। যার আসামির পক্ষে কোন আইনজীবী ওকালতি করার ইচ্ছা প্রকাশ না করলেও আসামির স্বপক্ষে কথা বলার জন্য সরকারী খরচে সরকার নিজেই একজন আইনজীবী দেন। এই আইনজীবীকে বলা হয় স্টেইট ডিফেন্স ল ইয়ার। এমনকি গুরুতর অপরাধে পলাতক আসামিদের পক্ষেও সরকারি খরচে স্টেইট ডিফেন্স লইয়ার নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তাকে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক প্রয়োজনীয় নথিপত্র সরবরাহ করা হয়। যেমন- মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের হত্যা মামলায়ও পলাতক আসামিদের পক্ষে সরকারী খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। এসব করা হয় ন্যায়বিচারের স্বার্থেই। কারণ, দশজন আসামি ছাড়া পেলেও একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিও যেন সাজা না পায়, সেটা নিশ্চিত করা বিচারকের পবিত্র দায়িত্ব।
তার মানে আসামি পক্ষে ওকালতি করা অপরাধ নয়, তবে চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর অপরাধের ক্ষেত্রে সচেতন আইনজীবীদের একটু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। ধরুন- বিচারে একজন আসামির ফাঁসির আদেশ হলো। ফাঁসি কার্যকর সময়ের অপেক্ষামাত্র। এরই মধ্যে আসামির ক্যান্সার ধরা পড়লো। যেহেতু ফাঁসির আসামির ক্যান্সার হয়েছে সেহেতু বিষয়টি নিয়ে উদ্গ্রীব না হয়ে বরং ক্যান্সারে সে মারা গেলেই কাহিনী সহজেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু না, এতে আগে আসামির চিকিৎসা করবে জেল কর্তৃপক্ষ। শারীরিক ফিটনেস ফিরে আসলেই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হবে। কারণ- অপরাধীর সাজা কার্যকরের সাথে রাগ-অভিমানের বিষয় জড়িত নয় বরং আইনি প্রক্রিয়াই মুখ্য। কিংবা ধরুন- আসামি জেলে থাকাবস্থায় তার বাড়িতে আগুন ধরেছে। এক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন কি আগুন নেভানোর চেষ্টা করবে না। এখানে চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তার কিংবা ফায়ার সার্ভিসের লোকদের অপরাধ বা দোষ হবে? ন্যায়বিচারের স্বার্থে আসামি পক্ষের নিয়োজিত আইনজীবীর ভূমিকাও ঠিক তেমনি।
- - মোহাম্মদ তরিক উল্যাহ
অ্যাডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
০১৭৩৩৫৯৪২৭০ ( কল করার পূর্বে হোয়াটস্অ্যাপে ম্যাসেজ দিন)
লেখক- আইন বিষয়ক উপন্যাস 'নিরু" এবং 'অসমাপ্ত জবানবন্দী', মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস 'মায়ের মুখে মুক্তিযুদ্ধ' এবং 'একাত্তরের অবুঝ বালক' ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৪:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




