এক সহযোদ্ধার মাধ্যমে মাকে এই চিঠি পাঠান নারায়নগঞ্জের বন্দর উপজেলার ইসহাক খান। তাঁর মা ফযজনের নেসা তখন থাকতেন চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আটোমোরে। ইসহাক খান বর্তমানে কিশোরগঞ্জের ভৈরব খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
১.৮.৭১
মাগো,
তুমি আমায় ডাকছিল? আমার মনে হলো, তুমি আমার শিয়রে বসে কেবলই আমার নাম ধরে ডাকছ, তোমার অশ্রুজলে আমার বক্ষ ভেসে যাচ্ছে, তুমি
এত কাঁদছ? আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না । তাই আমায় ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেলে।
স্বপ্নে একবার তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম, তুমি আমার বড় আবদারের ছেলের আবদার রক্ষা করতে এসেছিল। কিন্তু মা, আমি তোমার সঙ্গে একটি কথাও বললাম না। দু চোখ মেলে কেবল তোমার অশ্রুজলই দেখলাম। তোমার চোখের জল মোছাতে এতটুকু চেষ্টা করলাম না ।
মা, তুমি আমায় ক্ষমা করো তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে গেলাম । তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে। তোমাকে দু:খ দেওয়া আমার ইচ্ছে নয়। আমি স্বদেশ জননীর চোখের জল মুছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ন হবে না। একটিবার তোমাকে দেখে যেতে পারলাম না । সে জন্য আমার হৃদয়কে ভুল বুঝো না তুমি । তোমার কথা আমি এক মুহুর্তের জন্য ভুলিনি, মা। প্রতিনিয়তই তোমার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি ।
আমার অভাব যে তোমাকে পাগল করে তুলেছে, তা আমি জানি । মাগো, আমি শুনেছি, তুমি ঘরের দরজায় এসে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছ - "ওগো, তোমরা সবাই আমার "ইসহাক" - শূন্য রাজ্য দেখে যাও"
তোমার সেই ছবি আমার চোখের ওপর দিনরাত ভাসছে । তোমার এই কথাগুলি আমার হৃদয়ের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কান্নার সুর তোলে । মাগো, তুমি অমন করে আর কেঁদো না । আমি সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি তাতে আনন্দ পাও না?
কী করবো, মা? দেশ যে পরাধীন। দেশবাসী যে বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত। দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনত, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা?
তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে, মা? একটি সন্তানকেও তুমি কি মুক্তির জন্য উত্সর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে? আর কেঁদো না, মা। যাবার আগে আর একবার তুমি আমায় স্বপ্নে দেখা দিয়ো। আমি তোমার কাছে জানু পেতে ক্ষমা চাইব । আমি যে তোমার মনে বড় ব্যথা দিয়ে এসেছি, মা। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসি। তুমি আদর করে আমাকে বুকে টেনে নিতে চাইছ, আমি তোমার হাত ছিনিয়ে চলে এসেছি। খাবারের থালায় নিয়ে আমাকে কত সাধাসাধিই না করেছ।, আমি সেদিন ফিরে চলে এসেছি। না, আর পারছি না। ক্ষমা চাওয়া ভিন্ন আর আমার উপায় নেই । আমি তোমাকে দুদিন ধরে সমানে কাঁদিয়েছি। তোমার কাতর ক্রণ্দন আমাকে এতটুকু টলাতে পারে নি।
কী আশ্চর্য মা? তোমার ইসহাক নিষ্ঠুর হতে পারল কী করে? ক্ষমা করো মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো।
ইতি
ইসহাক
Click This Link
----------------
৭১ এর চিঠির কন্টেন্ট প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১১:১৫