somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হোক শুরু নতুন ভোরের

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেল নীলার। ঘুম ঘুম চোখে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায়। সকাল ৬ টা ৫। শীতের সকালে এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গে না। এমনিতে নীলার বেশ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। একবার চোখ বন্ধ করে ভাবল, আরও কিছুক্ষণ ঘুমাই। কি হবে উঠে। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে ভাবল, নাহ। আজ সকালটা দেখব। অনেক দিন ভোর হতে দেখি না। ভোরের আকাশে মেঘগুলো একটু একটু করে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বহুদিন দেখি না এই আলোছায়ার খেলা। নাহ। আর দেরী না করি। উঠে পড়ি।

আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসল নীলা। এদিকে নীলার পাশে বেঘোরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সামাদ। ৩ বছরের সংসার তাদের। এখনো বাচ্চা কাচ্চা নেয়নি। সামাদ বলে, সবে তো হানিমুন শুরু। আরও কিছুদিন যাক। নীলার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে। একটা বাবু যেন ঘরময় দৌড়াদৌড়ি করে। সারা ঘর মাতিয়ে রাখে। পাশের বাসার ভাবি মাঝে মাঝে উনার পিচ্চিটাকে নিয়ে বাসার আসে। এত মায়া লাগে তখন। ইচ্ছে করে, বাচ্চাটাকে রেখে দেই। আর যেতে না দেই। কিন্তু সামাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলে না নীলা।

প্রেমের বিয়ে নয় নীলার। ফোর্থ ইয়ার ফাইনালের আগে হঠাৎ একদিন ফুপু বাসায় এসে হাজির। নীলার মাকে ডেকে বলে, এই ছেলে হাজারে ১ টা। লন্ডন থেকে এম বি এ করে এসেছে। এখন এন সি সি ব্যাঙ্কের এম টি ও। বাবা রিটায়ার্ড সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকায় বাড়ি আছে। মেয়ে সুখেই থাকবে। কোন চিন্তা নাই। নীলার মা সব শুনে খুব একটা অখুশী হননি। এভাবে করে ফোর্থ ইয়ার ফাইনালের পরে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় নীলার।

বিয়ে নিয়ে নীলার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে যে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। পুরো সময়টাই মনে হয় একটা ঘোরের মাঝে ছিল। বিয়ের আগে সামাদের সাথে খুব বেশি মেলামেশা করার সুযোগ হয়নি। দু একবার দেখা হয়ছিল। কিন্তু সাথে আরেকজন থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর ছিল সবসময়। তাই খুব একটা কথা বলার সুযোগ হয়নি।

বাসর রাতে সামাদ নীলার দিকে প্রথম ৫ মিনিট তাকিয়ে থাকে কিছু না বলে।
নীলা বলে, "কি হল? কিছু বলবেন না।"
সামাদ বলে, "আমি আসলে বিয়ের আগে বুঝতে পারিনি, তুমি এতটা সুন্দর। বুঝতে পারলে তোমাকে বিয়ে করতাম না।"
নীলা খিল খিল করে হেসে ওঠে। "কেন করতেন না? সুন্দর হওয়া কি অপরাধ?"
"না। আসলে ভয় লাগে। যদি হারিয়ে যাও।"
নীলা তখন সামাদের হাত ধরে বলে, "কথা দিলাম, হারিয়ে যাব না। জীবনের ভাব।"
সামাদ তখন হো হো করে হেসে উঠল। নীলা অবাক হয়ে সামাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত সুন্দর করে একজন মানুষ হাসে কিভাবে।
এভাবেই শুরু হয় নীলা আর সামাদের ভালবাসার কাহিনী। গত ৩ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। কিন্তু বদলায়নি দুজনের ভালবাসা।

নীলা ঘুম থেকে উঠে সামাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ইশ বেচারা। একটু ঘুমোক। সারাদিন কত পরিশ্রম করে। নীলা বারান্দায় এসে দাড়াল। বাইরে হালকা কুয়াশা। নিচে এক লোক ভাপাপিঠা বানাচ্ছে। দুইজন রিকশাওয়ালা মনের আনন্দে ভাপাপিঠা খাচ্ছে। নীলার দেখে খুব খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ও আসলে খুব একটা ভাল ভাপাপিঠা বানাতে পারে না। সবকিছুই ঠিকমত দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন জানি ভাপাপিঠা পুরোপুরি শেইপে আসে না। ভেঙ্গে যায়। নীলা গত ৩ বছরে রান্না বান্না বেশ ভালই রপ্ত করেছে। কিন্তু পিঠা এখনো পারে না। মায়ের বাসায় গিয়ে প্রায়ই চেস্টা করে । কিন্তু হয় না।

পাশের বাসা থেকে রিন্টির গানের আওয়াজ আসছে। "আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।" বাহ ! মেয়েটা তো দারুণ গায়। কি চমৎকার গানের গলা। একদিন বাসায় গিয়ে রিন্টির গান শুনতে হবে। নীলা মনে মনে ভাবে, তার ছেলেমেয়েকে সে অবশ্যই গান শেখাবে। সামাদ না করলেও শেখাবে। সামাদ অবশ্য না করার কথা না। ও কখনই নীলার কিছুতে বাধা দেয় না। ওইতো সেদিন। নীলা এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে পদ্মা রিসোর্ট চলে গেল। ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত। সামাদ একটা কথাও বলেনি। শুধু বলেছে, খাবার ঢাকনা দেয়া আছে, খেয়ে নিও। পরদিন সকালে সব ঠিক।

অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠলে একটা সমস্যা। কিছু করার থাকে না। সকালে সামাদ তেমন কিছু খায় না। শুধু টোস্ট আর এক কাপ কফি। মাঝে মাঝে একটা ডিম। আর কিছু না। সামাদের সাথে থাকতে থাকতে নীলারও সেইম অভ্যাস হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে সামাদের সাথে হাল্কা কিছু খায়। নাহলে একেবারে ঘুম থেকে উঠে ব্রাঞ্চ করে ফেলে। নীলার অবশ্য সারাদিন খারাপ যায় না। হাউজ ওয়াইফ থাকাটা তার কাছে মনে হয় বেস্ট। যদিও নীলার একটা মাস্টার্স ডিগ্রী আছে ইকনোমিক্সে। একটা চাকরি পাওয়া খুব কঠিন কিছু না। তারপরেও নীলার ভাল লাগে না এসব চাকরি বাকরি। এর চেয়ে সংসারে সময় দেয়াটা খারাপ কিছু না। বাসার জিনিস গুছানো, রান্না করা, এক এক দিন এক এক আইটেম এক্সপেরিমেন্ট করা। ভালই লাগে। সময় পেলে কিছুক্ষন ফেসবুকে বসে কারো সাথে আড্ডা দেয়া, নাহলে কোন কোন দিন মায়ের বাসায় ঘুরে আসা। আরেকটা জিনিস নীলার খুব ভাল লাগে। সেটা হল, সামাদকে অফিসের মাঝে ফোন করে ডিস্টার্ব করা। সামাদ খুবি রাগ করে। কিন্তু নীলা বেশ মজা পায়।

একটা ফ্রেস গোসল করলে কেমন হয়। অনেকদিন সকাল সকাল গোসল করা হয় না। সময়টাও কাটবে। আর সামাদও কিছুক্ষন পরে ঘুম থেকে উঠে যাবে। আজকে তো আবার হরতাল। সামাদের অফিসের গাড়ি আসবে না। ওকে আজকে বাসে না হয় রিক্সায় যেতে হবে। ইদানিং বেশি হরতাল দিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই হরতাল থাকে। বেচারা সামাদকে খুব কস্ট করে অফিসে আসা যাওয়া করতে হচ্ছে। কি যে হচ্ছে দেশটার, আর কোন দিকে যে যাচ্ছে কিছুই বুঝ আসে না নীলার।

বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিল নীলা। শীতের দিনে গোসল করার সময় প্রথমে গায়ে পানি দিতে বেশ ভয় লাগে। মনে হয় পালিয়ে যাই। কিন্তু একবার দুইবার দিয়ে ফেললে, ভয় কেটে যায়।

গোসল শেষে নীলা বারান্দায় এসে দাড়াল। কুয়াশা কেটে আস্তে আস্তে সূর্যের আলো বারান্দায় আসতে শুরু করেছে। শীতকালের সোনালী রোদ। কি যে দারুণ লাগছে নীলার। কতদিন এমন একটা দৃশ্য দেখে না এই ফালতু ঘুমের জন্য। নীলা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এখন থেকে সকাল সকাল উঠতেই হবে। নীলা তার ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে লাগল।

হঠাৎ করে দুইটা হাত এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল নীলাকে। আর ওর গালে খুব আলতো করে একটা চুমু খেয়ে নিল।
"কেমন আছ রজনীতা?" বলল সামাদ। সামাদ মাঝে মাঝে নীলাকে তার কল্পনার কিছু নামে ডাকে। বেশিরভাগই হাস্যকর। কিন্তু নীলা বেশ মজা পায়।
নীলা মিস্টি করে হেসে বলল, "রজনীতা ভাল আছে। অবশেষে ঘুম ভাঙ্গল আপনার। "
"আমার ঘুম তো প্রতিদিন এই সময়ে ভাঙ্গে । কিন্তু তুমি আজ এই অসময়ে !!"
"ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর এখন থেকে এই সময়েই উঠব। তুমি দেখো।" উত্তর দিল নীলা।
সামাদ হেসে বলল, "দেখা যাবে। কতদিন ওঠ। যাই হোক, আজকে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। একটা মিটিং আছে শার্প ১০ টায়। আজকে আবার হরতাল। কি যে করি। বস মিটিং ডাকারও সময় পায় না।"
"হম। তুমি ফ্রেস হয়ে আস। আমি তোমার জন্য এক কাপ ফ্রেস চা বানাচ্ছি। নীলা স্পেশাল টি।"
সামাদ হেসে ফ্রেস হতে চলে গেল।

এই ফাকে নীলা একটা শাড়ি পড়ে নিল। ফিরোজা কালারের শাড়ী। আর আচলটা ডিপ ব্লু। শাড়িটা সামাদ নিজে পছন্দ করে লাস্ট বার্থডেতে নীলাকে গিফট করেছে। সামাদ সবকিছু একটু নাটকীয়ভাবে দিতে পছন্দ করে। এই শাড়ির উপর একটা ছোট কার্ড। কার্ডে লিখা, "নীলাঞ্জনার জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত কাটুক নীলিমার মাঝে আর সামাদকে ঘিরে। ভালবাসি।"
সামাদ বলে,"দেখেছ, আমার কালার চয়েস। পারফেক্ট ব্লু।"
নীলা বলে," কচু ব্লু। এটাকে ফিরোজা বলে গাধা। এটা নীল না।"
সামাদ অবাক হয়ে বলে,"কি বলছ এসব। এটা তো নীল। তাই না।"
নীলা হাসতে হাসতে বলে, "না গো হাদারাম বাবু। এটা নীল না। নীল আর ফিরোজার মাঝে অনেক পার্থক্য।"
"আমার কাছে নীল যা, ফিরোজাও তা।" এই বলে সামাদ মন খারাপ করে চলে গেল।

শাড়ী পরে নীলা রান্নাঘরে চলে গেল। দুকাপ চা নিয়ে ফিরে এল ডাইনিং এ। সামাদ নীলাকে দেখে চমকে উঠল। "কি ব্যাপার ! আমার ঘরে হুর পরী ঢুকল কেমনে? ঘর বাধাইতে হবে। যেন জীন না ঢুকে।"
নীলা হেসে উঠল। "উফফ। তুমি না। একটা যা তা ! আজকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছি। ভাবলাম, নতুন ভোরের শুরু হোক নতুন কিছু দিয়ে। তাই পরলাম আর কি।"
"খুব ভাল করেছ। এখন থেকে প্রতিদিন নতুন কিছু সেলিব্রেট করবা। তাহলে প্রতিদিন নতুন নতুন নীলাকে দেখব।"
নীলা হেয়ালী করে বলল, "আচ্ছা বাবা। দেখবা। তুমি তাড়াতাড়ি ওঠ তো। অফিসের দেরী হয়ে যাবে। রিকশায় যেতে তো অনেক সময় লাগবে।"
"আহা। হোক না দেরী একটাবার। পরী আসবে না তো বারবার। দেখে নেই নীলাকে শেষবার।" হাসতে হাসতে বলল সামাদ।
"হয়েছে কবি সাহেব। আপনার চা শেষ করেন। আমি আপনার ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে আসছি।"
"এই চার্জারটাও নিয়ে এস। নাহলে আমি ডেড। ল্যাপটপে সব প্রেজেন্টেশন রেডি করা। নাহলে আজকে মিটিং খাল্লাস হয়ে যাবে।"
'আনছি বাবা। অস্থির হইয়ো না।" নীলা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল।

নীলা ফিরে এসে দেখে সামাদ জুতা পরে রেডি। ছেলেটা খুব গুছানো। আর সব কিছু খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে শেষ করে। অন্য ছেলেদের মত অগোছাল না। নীলা সামাদের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলে,"আপনার ব্যাগ নেন। আমাকে উদ্ধার করেন।"
সামাদ একহাতে ব্যাগ নেয় আর এক হাতে নীলার হাত চেপে ধরে বলে, "আপনি মনে হয় কিছু একটা দিতে ভুলে গেছেন।"
"ইশ। শখ কত বুড়ার।" নীলা লজ্জা পেয়ে জবাব দেয়।
"প্লিজ। একটা দাও না। প্লিজ।" সামাদ কাকুতি করে।
"এখন না থাক। রাতে দেব।"
"রাতে দিবে? প্রমিস?" সামাদ কাদ কাদভাবে বলে।
"ওকে সুইটহার্ট। প্রমিস। রাতে আদরে আদরে ভরিয়ে দেব।"
সামাদের মুখ ১০০ ওয়াটের ফিলিপ্স বাতির মত জ্বলে ওঠে। "থ্যাঙ্কস। লাভ ইউ ওয়াইফি।"
"হেইট ইউ হাবি।" এই বলে নীলা হাসতে হাসতে দরজা বন্ধ করে দেয়।

দরজা আটকানোর পরে নিজের মনে মনে খুব হাসে। মাঝে মাঝে নীলার নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়। সামাদের মত একজনের সাথে সে আছে। সামাদ যে তার জীবনে প্রথম ভালবাসার মানুষ, তা কিন্তু না। এর আগে আসিফ নামে এক ক্লাসমেটের সাথে নীলার প্রায় ২ বছর সম্পর্ক ছিল। খুব যে খারাপ ছিল সম্পর্কটা, তা না। কিন্তু সেইম এজের রিলেশানশিপ। বেশিদিন টিকেনি। নীলা অবশ্য প্রথমেই সামাদকে আসিফের ব্যাপারে সব খুলে বলে। সামাদ সব শুনে একটা কথাই বলে, "তোমার মনের ভেতরে একটা জানালাবিহীন ঘর তৈরী কর। সে ঘরে তোমার আর আসিফের সব স্মৃতি ছুড়ে ফেলে দাও। এর পরে, ঘরের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে আমার কাছে ফিরে আস। আমি তোমায় আজীবন বুকের মাঝে আগলে রাখব।" নীলা তাই করেছিল। কিন্তু তারপরেও মাঝে মাঝে আসিফ ফোন করে। ফোন করে অবশ্য কোন পুরানো জিনিস নিয়ে টানাটানি করে না। শুধু কুশলাদি জিজ্ঞেস করেই শেষ। কিন্তু তারপরেও কেন জানি মনের মাঝে শঙ্কা জাগে। যদি কিছু হয়ে যায়। কিন্তু সামাদের মত একজনের সাথে আসলে কাউকে তুলনা করা ঠিক না।

নীলা ভাবল, আজ নতুন কিছু একটা রান্নার চেস্টা করি। সামাদ গরুর মাংস খুব পছন্দ করে। গরুর নতুন কিছু ট্রাই করা যায়। ইদানিং হরতাল থাকাতে নীলা একসাথে বেশি করে বাজার করে রাখে। আর আজকাল হরতাল থাকার কারণে ফ্রেস সব্জীগুলো ও পাওয়া যাচ্ছে না। খুবই সমস্যা।
যাই হোক নীলা ঘরের কাজগুলো কিছু গুছিয়ে নেয়। একজন ছুটা বুয়া আসে দুপুরের দিকে। উনি কাপড় কেচে দেন আর ঘর মুছে দেন। নীলা নিজেই রান্না করতে পছন্দ করে। এজন্য বুয়াকে দিতে কখনো কিছু করায় না।

ল্যাপটপে বসে নীলা ইউটিউবে কিছু রেসিপি দেখে নিচ্ছিল। ইউটিউব থাকার কারনে এখন রান্না অনেক সহজ হয়ে গেছে। সবকিছুই নাগালের মাঝে। যা ইচ্ছে তাই পাওয়া যায়। কিছুক্ষন ফেসবুকিং করতে করতে নীলার চোখ লেগে গেল।

নীলার ঘুম ভাঙ্গল মায়ের ফোনে। "কিরে ! এত বেলা করে ঘুমাস কেন।"
"না মা। অনেক আগেই উঠেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ চোখ লেগে গেল।"
"তোকে নিয়ে আর পারি না। জামাই তো কিচ্ছু বলে না। তাই পড়ে পড়ে ঘুমাস। বুয়া এসেছে?'
নীলা হেসে উত্তর দিল,"আমার জামাই খুব ভাল। আজকে বুয়া আসে নাই মা। ইদানিং হরতালে বুয়ারাও দেখি ছুটি নিচ্ছে।"
"বুয়াদেরকে একদম লাই দিবি না। এরা এভাবে ফাকি দেয়ার চেস্টা করে। আচ্ছা শোন। শীলা আর শীলার জামাই আজকে রাতে আমাদের এখানে খাবে। তুই আর সামাদ চলে আয় রাতে।"
"না মা। আজকে থাক। ওর আজকে ফিরতে দেরী হবে। অফিসে প্রেসার।" নীলা মাকে একটু করে মিথ্যা বলল। কারণ, আজকে রাতটা সামাদকে নিয়ে একান্তে কাটাতে চায় নীলা।
"জামাইকে দেরীতে ফিরতে না করিস। রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ। কখন যে কি হয়, বোঝা তো যায় না।"
"তুমি চিন্তা নিও না মা। সামাদ অনেক সেইফ চলার চেস্টা করে"
"আচ্ছা ঠিক আছে। এই শোন। তরকারী পুড়ে যাচ্ছে। পরে ফোন দেব। এখন রাখলাম।"
"ভাল থেকো মা। রাখি।"

ফোন রেখে নীলা দেখে ঘড়িতে প্রায় দেড়টা বাজে। নিজেকে কিছুক্ষন বকুনি দেয়। ধ্যাত আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। নীলা রান্নাঘরে ঢোকে। আজকে চিলি বিফ টাইপের কিছু একটা বানানোর ট্রাই করবে নীলা। সাথে চিকেন ফ্রাইড রাইস। সামাদ থাই খাবার খুব পছন্দ করে। এজন্য নীলা প্রায়ই এই টাইপের কোন মেনু বানানোর চেস্টা করে। বান্না শেষ করতে প্রায় সাড়ে চারটার মত বাজে। এর মাঝে নীলা একটু চেখে নেয়। নাহ। বেশ ভালই হয়েছে। মনে মনে নিজের প্রশং সা নিজেই করে নীলা।

সামাদের অফিস ছুটি হয় ৫ টায়। এমনিতে বাসায় ফিরতে সাড়ে ছয়টা বা সাতটা বাজে। কিন্তু হরতালের দিনে জ্যাম না থাকায় একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারে। সাধারণত ছয়টার মাঝেই বাসায় চলে আসে। তাই নীলা তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে চুলগুলো আচড়ে নেয়। একটা হালকা পিঙ্ক শাড়ি পরে। আর খুব লাইট একটা মেকআপ নিয়ে নেয়। সবশেষে কপালে একটা টিপ। খুব সুন্দর লাগছে নীলাকে। নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেরই লজ্জা লাগে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের রূপে মোহিত হলে নাকি অমঙ্গল হয়। এসব ভাবতে ভাবতে নীলা উঠে এল। যাক, সামাদ আসার আগেই রেডি। আজকে ওকে চমকে দেব।

রাত ৮ টা বাজে। সামাদ এখনো বাসায় আসেনি। নীলা ৪-৫ বার মোবাইলে চেস্টা করেছে। প্রতিবারই মোবাইল অফ পাচ্ছে। এদিকে অফিসেও ট্রাই করেছে কিন্তু পাচ্ছে না। কেউ ফোন ধরছে না। নীলা বারান্দার এই মাথা থেকে ওই মাথাইয় পায়চারী করছে। কিন্তু সামাদের কোন খোজ নেই।

রাত ১১.১০ বাজে। সামাদের এখনো কোন খোজ পাওয়া যাচ্ছে না। নীলা পাগলের মত সামাদের মোবাইলে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফোন অফ। ওর কলিগ আফসার সাহেবকে একটু আগে ফোন দিয়েছে। ভদ্রলোক বলে,"সামাদ সাহেব তো ৫ টার দিকেই অফিস থেকে বের হয়ে গিয়েছে। হয়তো কোন বন্ধু বান্ধবের বাসায় আড্ডা দিচ্ছে। আর মোবাইলের হয়তো চার্জ শেষ। বুঝেনই তো, ছেলে মানুষের আড্ডা। বউ বাচ্চা কিছুরই খবর থাকে না। হা হা হা। " নীলা কিছু বলল না। কারণ সামাদ এমন ছেলে না। ও কখনো এভাবে সময় কাটায় না। আর কখনো ফ্রেন্ডের বাসায় গেলেও জানিয়ে যায়। নীলা মায়ের বাসায় ফোন দেয়। আর কয়েকজন আত্মীয়কেও কল দেয়। কেউ কোন কিছুই জানে না।

রাত ১২.৪০। নীলার মোবাইলে একটা কল আসে,"আপনি মিসেস সামাদ বলছেন।"
"বলছি।" ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে উত্তর দেয় নীলা।
"আপনার স্বামী একটা এক্সিডেন্ট করেছে। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আছেন। আপনি একটু কস্ট করে এখুনি চলে আসুন।"
নীলা নিঃশব্দে ফোন রেখে দেয়।

ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটের ১৮ নম্বর বেড। সামাদের সারা দেহ ব্যান্ডেজ করা। একটু পর পর সারা দেহ থরথর করে কেপে উঠছে। অবস্থা আশাঙ্কাজনক। আজ অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে কিছু হরতাল সমর্থক আর পুলিশের গন্ডগোলের মাঝে পড়ে যায় সামাদ। এই হরতাল সমর্থকদের ছোড়া কিছু পেট্রোল বোমার একটি লেগে যায় সামাদের শরীরে। এতে পুড়ে যায় সামাদের দেহের প্রায় ৬০ ভাগ।

নীলা সামাদের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাদতে থাকে। সামাদ নীলাকে কাছে ডাকে। কথা বলার চেস্টা করে। কিন্তু তার শ্বাসনালীর কিছু অংশ পুড়ে যায়। এজন্য ঠিকমত কথা বলতে পারছিল না। ফিসফিস করে বলে, "তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।" নীলা কিছু বলে না। হালকা হেসে চোখের পানি মুঝে নেয়। সামাদ বলে, " খুব ইচ্ছে করছে তোমার হাতটা ধরতে। কিন্তু কপাল খারাপ। পুরো হাতে ব্যান্ডেজ। হাত ধরতে পারছি না।" নীলা হাউমাউ করে কেদে ওঠে। আলতো করে হাতটি রাখে সামাদের সেই ব্যান্ডেজ করা হাতের ওপর।

সামাদ নীলার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, "তুমি চিন্তা কর না। আমি সুস্থ হয়ে উঠব। অন্তত আমার নীলার চুমু খাওয়ার জন্য হলেও আমাকে সুস্থ হতে হবে।" নীলা কাদতে কাদতে বলে, "দোহাই তোমার। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠ। আমি তোমাকে ছাড়া বাচতে পারব না।"

রাত ৪ টা ২৫ মিনিটে সামাদ মারা যায়। ডাক্তারদের আপ্রাণ চেস্টা কিংবা নীলার অসীম ভালবাসা ধরে রাখতে পারেনি সামাদকে। সামাদকে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে নাম না জানা দেশে, যার ঠিকানা কেউ জানে না। আর সবই ঘটেছে শুধু কিছু ক্ষমতালোভী মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের জন্য।

আমাদের দেশে প্রতিদিন এমন হাজার নীলার জন্ম হয়, যাদের সব স্বপ্ন এক মুহুর্তের মাঝে মাটিতে লুটিয়ে যায়। অনেক সামাদের জন্ম হয়, যারা তাদের পরিবারের ভালবাসা থেকে চরতরে মুক্তি নিয়ে হারিয়ে যায় অজানার দেশে। একটা ছোট দেশের কিছু নির্বোধ মানুষ আজ নিজেদের সার্থ হাসিলের জন্য হাজার হাজার মানুষের বুক খালি করছে। দিন শেষে আমরা কিছু হায় হুতাশ করি। দিন কয়েক শোক পালন করে সব ভুলে যাই। কিন্তু নীলার চোখের পানি যে কতকাল ধরে ঝরছে, তার কোন খবর রাখি না।

ইতি হোক নোংরা রাজনীতির, হোক শুরু নতুন ভোরের। এই কামনা করি।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×