আমার চাচা ও তার ফুটবল খেলা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আমার ছোট চাচা । ফুটবলের ভীষণ ভক্ত ছিলেন । কিন্তু তিনি ফুটবল খেলতে পারতেননা । কারণ ফুটবল খেলার জন্য যে পরিমাণ শারীরিক সক্ষমতা দরকার তা উনার ছিলনা । তিনি খেলতে গিয়ে বেশিক্ষন দৌড়াতে পারতেননা । আর পারবেনইবা কীভাবে উনি কখন চেষ্টাই করেননি । সর্বোচ্ছ পাঁচ মিনিট খেলতেন । ভুল হয়েছে, খেলতেন না বলে বলি খেলতে পারতেন । তারপর এমন ভাবে হাফাতে থাকতেন মনে হত এই মাত্র তিনি ভুল করে উঠে পড়া এভারেষ্টের চূড়া থেকে নেমে আসলেন । এ নিয়ে চাচার বড়ই আফসোস ছিল ।
তখন আমি ক্লাস এইটে । সময়টা ২০০২ বিশ্বকাপের সময় । চাচা হঠাৎ একদিন স্বপ্ন দেখলেন তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলছেন এবং একের পর গোল করে দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন । আর সব ম্যাচেই নাকি উনি পুরো নব্বই মিনিট খেলেছেন । স্বপ্নটা দেখার পর থেকে চাচা আমার একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন । উনি এখন থেকে নিয়মিত ফুটবল খেলবেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় একদিন জাতীয়দলে খেলবেন । আর উনি নিশ্চিত যে তার এই স্বপ্নটা সত্য হবে । কারণ যে সে সময়েতো উনি এই স্বপ্নটা দেখেননি , দেখেছেন একদম ভোরে । আর কে না জানে ভোরে দেখা স্বপ্ন সত্য হয় ।
এমনিতেই নাচুনী বুড়ি , তার উপর ঢোলের বাড়ি । তাই চাচা একদম কোমর বেধে নেমে পড়লেন । প্রথম কাজ হচ্ছে স্টামিনা আর ফিটনেস বাড়ানো । স্টামিনার জন্য নিয়মিত দুধ , ডিম ও কলা ইত্যাদি উপাদেয় খাবার খাওয়া শুরু করলেন । আর ফিটনিসের জন্য দরকার নিয়মিত ব্যায়াম । তাই তিনি খুব ভোরে উঠে ব্যায়াম করা শুরু করলেন । আর এতেই বাধল বিপত্তি । যেদিন থেকে চাচা ব্যায়াম করতে শুরু করলেন , এর পরদিন থেকেই চাচার একা একা ব্যায়াম করা বিরক্ত লাগতে শুরু করল । আর এটাই আমার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠল । চাচা প্রতিদিন ব্যায়াম করতে যাওয়ার সময় আমাকে ডাকা শুরু করলেন । আমাকেও ভোরে তার সঙ্গে যেতে হবে । আবে , ফুটবল খেলবেন উনি আর আমাকে কিনা যেতে হবে ভোরের সুন্দর ঘুমটা ভেঙ্গে তার সঙ্গে ব্যায়াম করতে । এটা কোন কথা হল ? আমি বাধ সাধলাম । কিন্তু কোন লাভ হলনা । উনি জোর করে আমাকে নিয়ে যেতে লাগলেন । অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে তার ফুটবলময় জীবনের সঙ্গী হতে হল । কয়েকদিন পর থেকেই চাচা পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলা শুরু করলেন এবং প্রথম দিনই উনি উনার প্রভূত উন্নয়ন লক্ষ করলেন । পুরো প্রথমার্ধ খেলেছেন । জায়গাটা জোর জবরদস্তি করে নিলেও উনিযে ভালো ষ্ট্রাইকার তার প্রমাণ স্বরূপ একটি গোলও করেছেন । মোটকথা উনি একজন সত্যিকার ফুটবলার হয়ে উঠছেন । আর বেশি দিন নেই যে দিন উনি বাংলাদেশ দলের হয়ে মাঠ কাঁপাবেন । কথাগুলো তিনি সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন ।
কিন্তু আমার সন্দেহ হতে লাগল চাচা আসলে ফুটবল খেলতেন কিনা ? তবে খেলার মাঠে মিনিট খানেক পরপর মারামারি আর ফাউল করাকে যদি ফুটবলের অংশ হিসেবে ধরা হয় তা হলে বলতে হয় উনি ফুটবলই খেলতেন । প্রথম দিকে সবাই মুখ বুঝে সব সহ্য করলেও আস্তে আস্তে মাঠে খেলোয়াড সংখ্যা কমতে লাগল । এবং একসময় তা একের কোঠায় পৌঁছাল (তখন চাচা মাঠে একাই থাকতেন) । তাতেও তিনি দমলেননা , বরং বলতে লাগলেন বড় হতে গেলে বাধা-বিপত্তি আসবেই । একদিন তিনি যখন জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন , তখন সবাই নিশ্চয় তাদের ভুল বুঝতে পেরে মাফ চাইতে আসবে এবং তার সাথে খেলতে চাইবে । যেহেতু তিনি নরম মনের মানুষ তাই তিনিও তাদের মাফ করে দিবেন ।
এর কিছুদিন পর, পাশের এলাকার একটি ফুটবল ক্লাব গোল্ড কাপ টুর্ণামেন্টের আয়োজন করে । চাচা ঠিক করলেন তিনি টুর্ণামেন্টে খেলবেন । কিন্তু কোন দলই চাচাকে নিতে রাজি হলনা । তাই চাচা ঠিক করলেন নিজেই একটি দল গঠন করে অংশ নিবেন । তিনি এন্ট্রি ফি জমা দিলেন । কিন্তু কেউ তার দলে খেলতে রাজি হলনা । যে কয়েকজন রাজি হল তাদের আবার শর্ত চাচা খেলতে পারবেনা । কিন্তু তা কি হয় ? তাই চাচা বাহির থেকে হায়ার করে খেলোয়াড় নিয়ে এলেন ।
অবশেষে টুর্ণামেন্ট শুরু হল । চাচাদের প্রথম ম্যাচ তারা জিতেও গেল । আফসোসের বিষয় হল সে ম্যাচে চাচাকে লাল কার্ড দেখানো হয় । কিন্তু এর পরের ম্যাচও চাচা খেললেন (কীভাবে খেললেন তা নিশ্চয় বলে বুঝাতে হবেনা ?) এবং আবার লাল কার্ড দেখলেন । এরপরের ম্যাচেও একই অবস্থা । উপরন্ত ঐ ম্যাচে একজনকে আহত করে হাসপাতালে পাঠালেন । পরবর্তী ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত । চাচার বিরুদ্ধে সালিশ বসানো হয় । সালিশে চাচাকে আজীবনের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করা হয় । চাচা আমার সেই থেকে ফুটবল নিয়ে কারো সাথে একটি কথাও বলেননি । তবে আমাকে প্রায়ই বলতেন , অবুঝ কিছু মানুষের জন্য বাংলাদেশ তার অনেক বড় একটা সম্পদ হারালো । আসলেই একটি বড় ফুটবল প্রতিভা জ্বলে উঠার আগেই নিভে গেল , আফসোস !
উৎসর্গঃ জ্বলে উঠার আগেই নিভে যাওয়া অভাগাদের ।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?
মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন
অভিনেতা
বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)
সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন
তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?
আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন