--চোর,তুই চোর!
খালামার দোষারোপ শুনে আমি কাঁদলাম।ভীষণ কাঁদলাম।
আমি যদি খালামার নিজের ছেলে হতাম,তবে কি তিনি এমন করে 'চোর 'বলতে পারতেন?
খালামার নাকের সোনার জলটোপটা হারিয়ে গেছে।কখন থেকে খুঁজছেন আর আমাকে গালাগালি
করছেন।
আমি এ-বাড়ির কাজের ছেলে।হা-ভাত ঘরের।তাই তো পরের বাড়ি কাজ করতে হয়।আমি চুরি না
করলে করল কে?
আমারই বয়সী দি-ভাই।ডাক নাম মউ।কেমন নীল-সাদা ইউনিফর্ম পরে,প্রজাপতির মত বাতাসে
ভাসতে ভাসতে,স্কুল যায়।আমি অবাক হয়ে দেখি।একটুও হিংসে হয় না আমার।মউ যে আমার
বোন।হোক না পাতানো।তবু সে আমার দি-ভাই।
এখন যদি দি-ভাই থাকতো,তা-হলে হয়তো এমন বকাঝকা খেতাম না।
আজ সকালেই দি-ভাই গেল মৌরি,তার ফুপুমণির বাড়ি।ওদের গাড়িতে তুলে দিলাম।গাড়ি
ছাড়ল,দি-ভাই হাত নাড়ল।আমারও নাড়তে ইচ্ছে করছিল।পারলাম না।কে-জানে কেউ
হয়তো বলে বসবে,চাকরের শখ দ্যাখ,বাই-বাই,করছে।
ফিরে এসে শুনি,খালামা জলটোপ খুঁজছেন,পাচ্ছেন না।
হায়-রে সোনার জলটোপ,কোথায় গেলে তুমি?ছিল নাকি চানঘরের তাকে।খালা-মা রেখেছিলেন
সকালে।তারপর দি-ভাইকে রওনা করানোর ব্যস্ততায় ভুলেছেন।এখন খুঁজছেন।তুমি নেই,
জলটোপ।সোনার জলটোপ!
এ-বাড়িতে আমি ছাড়াও কাজের লোক আছে বাবুর্চি খলিল ও তাঁর সহকারী মিশিরজী।তাঁদের সারাটা দিন কাটে রান্নাঘরে।কাজের শেষে রাতের বেলায় একজন কুরআন,অন্যজন তুলসী
দাসের রামায়ণে ডুবে যান।চানঘরে কখনোই যান না তাঁরা।তবু আমি তাঁদের কাছে গেলাম।
বললাম,আপনারা কি ওপরে গেছিলেন।
মিশিরজী হিন্দীতে বললেন--না,বাবুয়া।
--কী হয়েছে বাপ?খলিল চাচার কৌতুহল।
সব বললাম।
দুজনেই প্রায় একই সুরে বললেন--ওপরওলা আছেন,তিনিই সব মুশকিল আসান করবেন।
বাইরে গাড়ির শব্দ।দি-ভাইকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলেন পিটার আংকেল।তিনি এ-বাড়ির
বাগান পরিচর্যা করেন আর প্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে এ-বাড়ির সকলকে অফিস-স্কুল-বাজার
নিয়ে যান।ওপরে ওঠেন না কক্ষনো।
আমার অশ্রুভরা চোখ দেখে তিনি বললেন--এনি প্রবলেম?
বললাম সব।বুকে ক্রশ আঁকলেন তিনি।তারপর বললেন,আজ সানডে,এখনই চার্চে যাব।লর্ড
যিশাসের কাছে প্রেয়ার করব তোমার জন্যে।
জলটোপ,হায় সোনার জলটোপ!
তোমার জন্যে আমি এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।তোমার জন্যেই আমি চোর হয়ে গেছি।এ-বাড়ি
তে আমার আর ঠাঁই নাই।
ফিরে যাব আমাদের সেই ছোট্ট গাঁয়ে।যেখানে আমার বাবা থেকেও নেই।আছে সৎ-মা।যার চোখে
আগুন,মুখে ধোঁয়া।সে আমাকে কারো বাড়িতে রাখাল খাটতে বলবে।নইলে কোন চায়ের দোকানে
লাগিয়ে দেবে।লাথি-ঝাঁটা খেতে-খেতে আমিও একদিন পাল্টা দেব।কোন ওস্তাদ আমাকে তার
দলে ডেকে নেবে।তার হয়ে অ্যাকশন করব।দু-দশটা মারব।তারপর নিজেও একদিন মরে যাব।না,সে
জীবন আমি চাই না।
কিন্তু তাছাড়া কোন উপায় দেখছি না।এ-বাড়িতে এতদিন শুনেছি--বুজলে মউয়ের মা,একা
আর সামলাতে পারছি না।বাবুটাকে আর একটু লেখাপড়া শেখাক মউ,তারপর ওকে আমি
ব্যবসার কাজ শিখিয়ে দেব।পয়সা দিয়ে অত বিশ্বাসী ছেলে পাওয়া যায় না।
কথা গুলো আমার বুকে কাঠবেড়ালীর মত ছোটাছুটি করে।যখনই অবসর পাই ,বই নিয়ে বসি।
আরো শিখতে হবে আমাকে।চাকর নয়,ব্যবসার ম্যানেজার হয়ে বাঁচব আমি ।বড় হবো।
কিছুই হবে না সে-সব।হবে,আবার অন্যকোন বাড়ির কাজের ছেলে।তাই-বা কি করে হবে।
এ-বাড়িতে চুরির অপবাদ পেয়েছি শুনলে,কেউ আমাকে চাকরও রাখবে না। আমার শেষগতি
সেই বাঘের মত বাঁচতে চেয়ে কুকুরের মত মরা।না,না,তা হয় না,হতে পারে না।
বাক্স-বিছানা বাঁধা হয়ে গেছে।ভাড়ার টাকা হাতে পেয়ে গেছি।মাইনে নাকি বাবা আসবে
তবেই দেবে।মৌয়ের বাবা এখন আর আমার খালুজান নন,এ-বাড়ির মালিক,যিনি আমাকে
ইচ্ছে করলে পুলিশে দিতে পারতেন,দেননি,দয়া করেছেন।
গেটের কাছাকাছি চলে এসেছি,ঠিক তখনই দি-ভাইকে নিয়ে গাড়ি ঢুকল।অবাক দি-ভাই
বলল--কোথায় যাচ্ছো?
বলতে গেলাম কিছু একটা,অশ্রু হয়ে বেরিয়ে এল তা।
গাড়ি থেকে নামল দি-ভাই।আমার হাত ধরল।বলল--চলো তো ভেতরে।
দি-ভাইকে অমান্য করার মত বুকের পাটা আমার নেই।
--মা,ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছো কেন?খালামার চোখে-চোখ রেখে প্রশ্ন করল দি-ভাই।
--ও তোর মায়ের জলটোপ চুরি করেছে।মউয়ের মা নয়,বাবা বললেন।
--মায়ের জলটোপ!দি-ভাইয়ের মুখের পাপড়ি ঝরা হাসি বন্ধ হলো।একঝলক দেখে নিলো
আমার অপরাধী মুখ।বলল--সেটা কি চানঘরের তাকে ছিল?
--হ্যঁ,তাই-তো রেখেছিলাম।উদ্বেগ-ভরা কন্ঠে বললেন খালামা।
--ওটা তো আমি যাওয়ার আগে তুলে রেখেছিলাম আমার শো-কেসে।তখন ভেবেছিলাম তুমি
যা ভুলোমনের লোক,আমাকে একবার শুধাবে নিশ্চয়,এখন দেখছি অনেক-কান্ড ঘটে গেছে।
একটু থামল দি-ভাই,সকলকে দেখে নিলো একঝলক।তারপর বলল--আব্বু তুমি তো সবকিছুতেই
আমাকে ফোন কর,শুধু চোর ছেলেটাকে তাড়ানোর সময় ভুলে গেলে।
মউয়ের বাবা মাথা চুলকে বললেন--বড্ড ভুল হয়ে গেল-রে মা।
--মা,মামণি আমার,তুমি মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখলে না কেন?বলে খালা-মা'কে জড়িয়ে
ধরে কাঁদতে শুরু করল দি-ভাই।
তার অশ্রু আমার চোখে সোনার চেয়ে উজ্জ্বল মনে হলো