somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প:বিস্মৃতি(৩৫০ তম পোস্ট)

২৮ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৭:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


@ তুষার আহাসান
--বড় বৌমা, বড় বৌমা, তোমার বাপের বাড়িটা কোথায় যেন?
শ্বশুরকে রান্নাশালের দিকে আসতে দেখে মাথার আঁচল ঠিক করল জোহরা।
তারপর মৃদু হেসে বলল—কুসুমপুর। এরই মধ্যে ভুলে গেলেন আব্বা! এই তো
গতমাসে বেড়িয়ে এলেন কুসুমপুর থেকে।
জোহরার কথায় মাথা চুলকান ওসমান। জ্বিভ কেটে বলেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে
পড়েছে, এই তো সেদিন নৌকা চড়ে তোমার বাপের বাড়ি বেড়িয়ে এলাম।
-- নৌকা কোথায় গো, আমাদের গাঁয়ের দশ মাইল সীমানায় নদীই
নাই, আপনি ট্রেনে গেছিলেন।
-- ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, ট্রেনটা নৌকার মত দুলছিল, নদীর মত বাতাস
জানালা কেটে ঢুকছিল। ট্রেনের ব্যবসা করে তোমার আব্বার লাভ হয় খুব বলো?
--আমার আব্বা ট্রেনে ঝালমুড়ি বেচেন না, আব্বা। উনি প্রাইমারীতে
মাস্টারী করতেন, তাঁর ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানেই গেছিলেন আপনি।
-- ফেয়ারওয়েল! ভুরু কুঁচকে যায় ওসমানের। তারপর বিড়বিড় করেন,
আমার তো মনে হচ্ছে কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। চুলে কলপ করতে গিয়ে
তোমার আব্বার গেঞ্জী লাল হয়ে গেল।
জোহরা জ্বিভ কামড়ে হাসি সামলায়, কোনরকমে বলে, হবে হয়তো, আমার
আব্বার বিয়ের কথা আপনার মনে পড়ছে।
বৃদ্ধ সেই কথা শুনতে পেলেন কিনা বোঝা গেল না। রান্নাশাল থেকে তিনি পা
বাড়ালেন বারান্দার দিকে।তখনও তিনি বিড়বিড় করছেন, তবে কি মেজ
বেয়ায়ের মাথায় টাঁক ছিল? কিন্তু কাকে যেন আমি কলপ করতে দেখেছি!
সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ওসমান হাঁক ছাড়লেন, মেজ বৌমা, একবার নিচে এসো
তো মা।
মেজ বৌমা কুলসুম পালঙ্কে শুয়ে টিভি দেখছিল। আজ তার রান্নার পালা নয়।
স্বামী মটোরবাইক হাঁকিয়ে গেছে ব্যবসার কাজে। ছেলে ভাই ও বন্ধুদের সাথে
ক্রিকেট খেলছে। দেওর আয়াজ ছিল দূরন্ত টাইপের। তাকে শান্ত করার জন্য
কলেজে পড়তে পড়তে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বউ নাদিরা কিশোরী,
দেখনধারী সুন্দরী। সে খুব একটা বশ মানাতে পারেনি স্বামীকে।অবাধ্য
সেই ছেলে অবশ্য কুলসুমকে খুব সমীহ করত। তার কলেজের সুখ-দু:খের
কথা বলত। এই ঘরে বসে টিভিতে খেলা দেখত। মেজ ভাবীর হাতের চা তার
খুব প্রিয় ছিল। খেলা দেখতে-দেখতে বলত, তোমার হাতের খেল দেখাও
ভাবী।
বেশ কিছুদিন আগে এক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। তাই এই বিকেলে কুলসুমের
কাছে আব্দার করার কেউ নেই। বিমর্ষ কুলসুম এই সময়টাই টিভি দেখে।
তার স্বামী ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। ছেলেও ফিরবে বাপের হাত ধরে।
তারা দুজনেই চা খায়না। এ বাড়িতে চা-খোর একজনই ছিল। তার মৃত্যুতে
কুলসুমের একটি বৈকালিক কাজ কমে গেছে। চায়ের প্রশংসা করার কেউ
নাই। কুলসুম এখন কাল গভীর রাতে প্রচারিত সিরিয়ালটির পুন:প্রচার
দেখতে দেখতে ওসমানের ডাক শুনল। বিরক্ত হলেও রাগল না সে । হন্তদন্ত
হয়ে নেমে এল নিচে। বলল, জ্বী আব্বা,বলেন?
-- কি আর বলবো, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, মেজ বৌমা, তোমার আব্বারই তো
সেদিন ফুটবল খেলতে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে?
মুরুব্বির সামনে হাসা বেয়াদবী হয়ে যাবে তাই মুখে আঁচল চাপা দিল কুলসুম।
তার আব্বা প্রায় বছর খানেক ধরে পক্ষাঘাতে পঙ্গু, তিনি ছোটবেলায় ফুটবল
খেলেছেন কিনা তাও জানা যায় না। তবে স্বামীর আব্দার রাখতে কুলসুমকে
রাত জেগে এবারের ইউরো কাপের খেলা দেখতে হয়েছে। খেলাটির বিষয়ে
অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে তার। তাই সে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল,
রোনাল্ডোর সাথে হেড মারতে গিয়ে ঢুঁ লেগে গেছিল।
ওসমান তা শুনতে পেলেন না। তবে মেজ বৌমার ঘাড় নাড়া দেখে তিনি নিশ্চিত
হলেন যে, কুলসুম হ্যাঁ বলছে। তাঁর চোখেমুখে খুশির আলো খেলে গেল।
বললেন, দ্যাখো মা জননীরা, আমার ঠিক মনে পড়ে গেছে। তবু তোমাদের
শাশুড়ি বলে কিনা, আমার নাকি কথা মনে থাকে না। লোকজনের সামনে
কত লজ্জা লাগে শুনতে!
বারান্দার একপাশে গ্রামের গরীবঘরের মেয়েদের আমপারা পড়া শেখাচ্ছিল নাদিরা।
ওসমানের কথা শুনে তার চোখ ছলছল করে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল জোহরা
ও কুলসুম। তাদের শাশুড়ি-মা ইন্তেকাল করেছেন তিন বছর আগে। ওসমান তা
ভুলে যান। বৌমারা ভুলতে পারে না, স্বামী অন্ত:প্রাণ মানুষটি একটি দিনের জন্য
কাউকে তুচ্ছ করে কথা বলেন নি। তাঁর মৃত্যুর দিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল।
গ্রামের ছোট-বড় সকলের চোখেই তা ভিড় করছিল যেন। ঝড়ে গাছপালা
ভাঙছিল। মেঘের গর্জনও যেন আর্তনাদ করছিল, আপনি এই মহিলাকে
জান্নাতবাসী করুন মওলা।
ওসমানের মনে থাকে না পত্নীবিয়োগের কথা। ভাতের থালা সামনে
নিয়ে বসে থাকেনচুপচাপ। বৌমারা কেউ অনুযোগ করলে বলেন,
তোমাদের শাশুড়ি নামাজ পড়ে আসুক।
পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন ছুটে আসতে হয় নাদিরাকে। সে হাসতে হাসতে
বলে,সরে যান ভাবী, আপনি সরে যান। সেদিন সিঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে আব্বার
হাতে ব্যথা হয়েছে, কেউ খাইয়ে না দিলে উনি খাবেন কি করে?
ছোট বাচ্চাকে মা যেমন গ্রাস তুলে খাওয়ায়, নাদিরা তেমনই গ্রাস তুলে ধরে
ওসমানের মুখের সামনে। সুবোধ শিশুর মত বৃদ্ধ খান নিরবে।
আজ ওসমানের আবার মনে গেল স্ত্রীর কথা। বললেন, তোমাদের শাশুড়ি সেই
কখন গোসলখানায় ঢুকেছে, এখনও বেরোনোর নাম নাই। ও বোধহয় ভুলে
গেছে, আমাকে এখন গোসল করে জোহরের জামাত ধরতে হবে।
বড় বউ, মেজ বউ উদাস চোখে রান্নাঘরে চালে বসে থাকা শালিক পাখি দুটি
দেখে। কখনও দেখে আঙিনার মাঝে বড় হতে থাকা পেঁপে গাছটিকে । কেউ
কোন যত্ন করে না চারাটির। তবু সে কিশোর হয়ে উঠেছে নিজস্ব
প্রাণশক্তিতে। তার নধর সবুজ পাতায় হয়ত বার্তা ছড়ানো থাকে,যারা এই
পৃথিবীর যোগ্য তারাই টিকে থাকে। পৃথিবীতে প্রতিটি মুহূর্তে অর্জন করে
নিতে হয় প্রাণের যোগ্যতা।
পড়ানো থামিয়ে ছুটে আসে নাদিরা। ওসমানের হাতে তসবীহ দিয়ে বলে,
এখনই তো আপনি আসরের নামাজ পড়ে বাড়ি ঢুকলেন আব্বা।
ছোট শিশুর মত বিনা বাক্য ব্যয়ে তসবীহ হাতে নেন ওসমান।
তারপর বিড়বিড় করেন, ওহ হ্যাঁ, এখনই তো আমি আসরের নামাজ পড়ে বাড়ি
ফিরলাম, আমার কিছুই মনে থাকে না কেন? তবে কি আমি নামাজও ভুল পড়ি?
তসবীহ হাতে নিয়ে খামার বাড়ির দিকে হাঁটলেন ওসমান। সেখানে তার পৌত্ররা
বন্ধুদেরসাথে ক্রিকেট খেলছে। ওসমানকে দেখে তারা হাঁ-হাঁ করে উঠল,
আসেন, আসেন দাদাজান, আম্পায়ারের অভাবে আমাদের খেলায় শুধু
গন্ডোগোল লেগে যাচ্ছে।
অন্যদিন আম্পায়ারিং করতে আপত্তি করেন না ওসমান। তাঁর অনেক ভুল
সিদ্ধান্তে পৌত্ররা হেসে কুটিকুটি হয়। খেলার আনন্দের চেয়ে সেটিই যেন বেশী
মজার। তাই প্রতিটি বিকেলে তারা অপেক্ষা করে আসরের নামাজ শেষে
ওসমান কখন এই স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন।
পৌত্র ও তাদের বন্ধুদের মুখগুলি চেনা ওসমানের। নাম-টাম অবশ্য
ঠিকঠাক মনে পড়েনা। তাতে অবশ্য অসুবিধা নাই। সবাই তার ছোট ভাই,
বন্ধুর মত।
আজ তিনি মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু আজ আমি তোমাদের সাথে খেলব।
--এই বয়সে আপনি খেলতে পারবেন?
--পারব না মানে, আলবৎ পারব, এই তো সেদিন আমি ইডেনে খেলা দেখে এলাম।
--খেলা দেখা আর নিজে খেলা এক নয় দাদাজান।
--এক নাকি দুই এখনই দেখাচ্ছি, আমার বোলিংয়ের সামনে কে ব্যাট করতে পারো
দেখি। ওয়াশিম আক্রামের মত ফাস্ট বল করব আমি।
হাতের তসবীহ গলায় ঝুলিয়ে বোলিং ক্রিজে দাঁড়ালেন ওসমান। উইকেট-কিপার
ছেলেটি বলল, লুঙ্গি সামলান দাদাজান, লুঙ্গি পরে ক্রিকেট হয় না।
--হয় না হয়, এক্ষুণি দেখিয়ে দিচ্ছি, লুঙ্গি পরে নামাজ হলে লুঙ্গি ক্রিকেট হবে না
কেন! ব্যাটসম্যান, রেডি?
একটু পরে কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরলেন ওসমান। তাঁর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে।
কপালের একপাশ কেটে গেছে।বাচ্চা ছেলের মত তিনি বলছেন, মা,মাগো, ওরা
আমাকে মারল।
নিজের নিজের কাজ ফেলে ছুটে এল জোহরা,কুলসুম ও নাদিরা। অপরাধীর মত
মুখ করে ওসমানের সহ-খেলোয়াড়রাও পাশে দাঁড়িয়েছে।
জোহরা চোখ পাকিয়ে তার বড় ছেলেকে বলল, তোরা আব্বাকে মেরেছিস। ক্লাস
ফাইভে পড়া তারিফ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল, কেউ মারেনি, দাদাজান লুঙিতে
ঝটাপটি লেগে মাটিতে পড়ে গেছে।
অন্যরা তাতে সায় দিল। ওসমানও প্রতিবাদ করলেন না। তাঁর কান্না থেমে গেছে।
তিনি বললেন, ওরা তো আমার সাথে খেলছিল, আমার মনে হয় তোমাদের
শাশুড়ি আমাকে ধাক্কা মেরে পেছন থেকে ফেলে দিয়েছে।
বৌমারা পরস্পরের প্রতি চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। জোহরা একটা কাঠের
চেয়ার নিয়ে এসে ওসমানকে তাতে বসাল। কুলসুম পানি আনল। নাদিরা আনল
ফার্স্ট-এড বাক্স। তিন জন মিলে প্রাথমিক চিকিৎসা করল। তারপর ধরাধরি
করে বৃদ্ধকে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল বিছানায়।
তিন জনে পরামর্শ করল, ডাক্তার ডাকা দরকার।
ওসমানের সহ-খেলোয়াড়রা ছুটল প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের দিকে।
বিছানায় শুয়ে আছেন ওসমান। তাঁর চোখে কখনও ঘুমের ঘোর, কখনও স্মৃতির
পিছুটান। ছেলেবেলায় জ্বরজ্বালা হলে মা তাঁর শিউরে বসে থাকতেন। মাথার
চুলে হাত বুলিয়ে দিতেন। এখন তাঁর শিউরে বসে আছে মায়ের মত চেহারার
এক নারী। সেও তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার পরনে অবশ্য মায়ের
মত রঙিন শাড়ি নয়,শিউলি ফুলের মত সাদা কাপড়। স্নেহের পরশ যেন
অবিকল এক।
ক্রিকেটার আজহারউদ্দিনের ছেলে যেদিন মারা যায়, সেদিন এই ছোট্ট গ্রামের
এক অখ্যাত মানুষের ছোট ছেলেটিও মটোরবাইক দূর্ঘটনায় মারা গেছিল।
আজহারের ছেলে আয়াজের মত এই আয়াজও সেদিন নতুন বাইক
কিনে আকাশে উড়তে চেয়েছিল। শেষমেষ বাইকটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে
পারেনি। প্রচন্ড গতিতে ধাক্কা মেরেছিল একটা আমগাছে। উড়ে গেছিল
তাঁর আত্মা হয়ত সরাসরি আজরাইলের ডানায়!ভেঙে গেছে নাদিরার
হাতের চুড়ি। কাফন রঙের শাড়ি হয়ে গেছে নাদিরার ভবিষ্য-লিখন।
ডাক্তারের সাথে হৈ-হৈ করে ঘরে ঢুকল ওসমানের সহ খেলোয়াড়রা। জোহরা ও
কুলসুমের ধমক খেয়ে তারা চুপচাপ ঘরের বাইরে দাঁড়াল। আমপারা পড়া মেয়ে
গুলি অবশ্য বইপত্র গুটিয়ে যেন অপেক্ষা করছিল এই ধমকের। তারা ছুটে
পালাল নিজের নিজের বাড়ির দিকে।
পালঙ্কের একপাশে ডাক্তারির ব্যাগ রেখে ওসমানের সামনে দাঁড়াল তরুণ ডাক্তার
ওয়াশিম। সবেমাত্র আজই এসেছে সে হাসপাতালে। হাত-মুখ ধুতে-ধুতে সে
কম্পাউন্ডারের কাছে হাসপাতালের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছিল, এমন সময় হাজির
কচিকাঁচার দলটি। এখনই ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে যাবে তারা।
ওয়াশিম তাদের যতই বোঝানোর চেষ্টা করে পুরনো ডাক্তারবাবু বদলী হয়ে চলে
গেছেন। সে এখনই অনেক –অনেক দূর থেকে এসেছে। কাল জয়েন করবে।
তারপর নেবে এলাকার মানুষের সেবার ভার। কে শোনে কার কথা। কচিকাঁচারা
নাছোড়বান্দা। তাদের দাদাজান মরণাপন্ন সুতরাং যেতে হবে।
ঘরে ঢুকে রোগীকে দেখে তেমন কিছু প্রতিক্রিয়া হয়নি ওয়াশিমের। কিন্তু তাঁর
শিওরে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে তার হৃদ-স্পন্দন বেড়ে গেল। সে কোন
রকমে বলল,এই যে আমাকে একটু পানি দিতে বলুন না, আসলে আমি
সকাল থেকে কিছু খাইনি।
নাদিরা এমন ভাবে বসে আছে যে ডাক্তারকে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে
যাওয়ার উপায় নাই। তাই জোহরা বলল, আপনি চিকিৎসা শুরু করুন,
আমি পানি আনছি।
কুলসুমও তাকে অনুসরণ করল। তার আগে কচিকাঁচাদের ভিড়টিকে ধমক
মারল,এই তোরা খেলগে যা, ভিড়ে তোদের দাদাজানের অসুখ বেড়ে যাবে।
হৈ-হৈ করে খামারের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ফিরে গেল কচিকাঁচারা। নতুন
উদ্যমে শুরু করল পুরনো খেলা। তাদের ব্যাট-বলের দাপটে খামারের
একপাশে ওসমানের শখের বাগান তছনছ হয়, কারো সেদিকে খেয়াল নেই।
ওসমান এতক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন। তিনি ডাক্তারের হাতে ইনজেকশনের
সিরিঞ্জ দেখে বললেন, তুমি কি ভাবছো ডাক্তার, এই বুড়োটা খুব অসুস্থ,
ভুল, একেবারে ভুল, বিশ্বাস না হয় আমার সাথে পাঞ্জা লড়ে দেখো।
একি তোমার হাত কাঁপছে কেন?
তড়াক করে বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন ওসমান। পালঙ্ক থেকে নেমে
চেয়ারে বসাডাক্তারকে পাঁজাকোলা করে তুলে শুইয়ে দিলেন বিছানায়।
বললেন, মনে হচ্ছে আমার চেয়ে তুমিই বেশী অসুস্থ ।
ডাক্তারের হাতের সিরিঞ্জ কেড়ে নিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে এটা তোমারই বেশী
দরকার।
ওয়াশিম তখন হতভম্ব হয়ে চিঁ-চিঁ করে বলে চলেছে, বিশ্বাস করুন,
আজ সারাদিন আমি কিছু খাইনি,আজ সারাদিন আমার ট্রেনে বাসে কেটেছে।
ডাক্তারকে ইনজেকশন দেওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করেছেন ওসমান। নাদিরা
এতক্ষণ শুধু চুপিসাড়ে বলছিল, ছি: আব্বা আপনি এ-কি করছেন।
এখন সে ডাক্তারের, আমাকে বাঁচান,আর্তনাদ শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারল
না।
নাদিরা প্রথমে চেষ্টা করল ওসমানের হাত থেকে সিরিঞ্জটা কেড়ে নেওয়ার।
কিন্তু বৃদ্ধ ওসমানের হাতে যেন একশো হাতির বল। ওদিকে আতঙ্কিত
ডাক্তার তখনও কাতর স্বরে বলে চলেছে, কে আছো আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও,
প্লিজ।
নাদিরার মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। একটি মানুষ বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে
হয়ত ওভাবেই আর্তনাদ করেছিল, নাদিরা কাছে ছিল না।
আজ সেই আর্তনাদ বুঝি ধ্বণিত হচ্ছে এই অসহায় তরুণের মুখে। হিতাহিত
ভুলে সে উপুড় হয়ে পড়ল ডাক্তারের উপর। ক্রমাগত বলে চলল,না,
তোমাকে আমি মরতে দেব না। কিছুতেই মরতে দেব না!
নাস্তাপানির ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকছিল জোহরা। এই অদ্ভু্ত দৃশ্য দেখে তার হাত থেকে
ট্রে খসে পড়ল মেঝেয়। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল চিনামাটির পেয়ালা, তস্তরী,
গেলাস। সেই শব্দেও সম্বিত ফিরল না নাদিরার। সে ডাক্তারটিকে জড়িয়ে ধরে
তখনও সে বলে চলেছে, না, তোমাকে আমি মরতে দেব না, কোনমতেই
মরতে দেব না।
ভাঙা জিনিষপত্র কুড়ানোর কোন চেষ্টা করল না জোহরা। সে টেবিলে পড়ে থাকা
মোবাইলটা নিয়ে নম্বার টিপল। তার স্বামী ওপ্রান্ত থেকে হ্যালো বলার আগেই
সে বলল, এক্ষুণি একবার বাড়ি এসো, একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে।
কুলসুমও বড় জাকে অনুকরণ করে স্বামীকে একই খবর দিল মোবাইলে। নাদিরা
তখনও প্রলাপের মত বলে চলেছে কথা গুলি। তার মাথার ওড়না খসে গেছে,
আলুথালু হয়ে গেছে বিশাল চুলের রাশি। শাড়ির আঁচল যেন ঝটপট করছে
জবাই করা সাদা মুরগির মত।
সাইক্লোনের মত মটোর বাইকে ছুটে এল দুই ভাই। পুলিশের মত বুটের
আওয়াজ তুলে ঘরে ঢুকল দুজনে। বড় ভাই চুলের মুঠি ধরে নাদিরাকে আছড়ে
ফেলল মেঝেয়। মেজজন চুলের মুঠি ধরল ডাক্তারের। প্রাণভয়ে ভীত তরুণ
ডাক্তারটি ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল। সে হাতজোড় করে বলছে, আমি কোন
দোষ করিনি, আমাকে বাঁচতে দিন।
আহত বাঘিনীর মত মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে নাদিরা। সে ডাক্তারের ব্যাগ
থেকে অপারেশনের ছুরি হাতে তুলে নিয়েছে। অশ্রুভরা কন্ঠে সে বলল, ছাড়ুন
ওকে, নইলে আপনাকে আমি ছুরি মারব।
বৃদ্ধ ওসমানের হাত থেকে পড়ে গেছে সিরিঞ্জ। তিনি মেজছেলের গালে এক চড়
মেরে বললেন, দূর হ হতভাগা, কে তোকে এখানে দাদাগিরি করতে ডেকেছে?
বড় ছেলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তাকেও একটা চড় কষালেন ওসমান।
বললেন, পাগল হলেও এই সংসারের কর্তা এখনও আমি। যা কিছু বিচার করার
আমিই করব।
প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডবের পরে প্রকৃতি যেমন স্থির হয়ে যায় ঘরটির অবস্থাও
এখন তাই। ওসমান বললেন, লা হাওলা ওয়ালা কুয়ালা ইল্লা বিল হিল
আলিয়্যেল আজিম, মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া এই পৃথিবীর কিচ্ছু হয় না।
আজ এখানে যা ঘটল তা পাড়াগাঁয়ে তো দূরের কথা,সিনেমাতেও হয় না।
তার জন্য দায়ী আমি। আয়াজের মৃত্যুর পর থেকে আমার মাথা আর কাজ
করে না। অথচ এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে। ডাক্তার,
তোমার বাড়িতে আর কে আছে?
ডাক্তার কাঁপতে-কাঁপতে বলল, জ্বী হুজুর, দুনিয়ায় আমার মা ছাড়া আর কেউ
নাই। তার স্বপ্ন পুরণ করতে কত কষ্ট করে ডাক্তার হলাম। কতদিন অপেক্ষা
করার পর যদিওবা এই চাকরীটা জুটল, তাও ছাড়তে রাজী আছি, আপনি শুধু
আমাকে প্রাণে মারবেন না।
--বেশ মারব না, তার বিনিময়ে তোমাকে আমার এই বিধবা মেয়েটির প্রাণ
ফিরিয়ে দিতে হবে। আজই নিকাহ করতে হবে ওকে।
--আপনি যা হুকুম করবেন তাই হবে, সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে
থাকব আমি।
--না, গোলাম হতে হবে না, তুমি এ-বাড়ির জামাই হয়ে থাকবে।বলে দুই ছেলের
মুখের দিকে তাকালেন ওসমান। বললেন,আমার জমি-সম্পত্তি ব্যবসা সবই তো
তোদের দিয়েছি বাপধনরা। কোনদিন কিছু চায়নি,আজ চায়ছি ওই দু:খী
মেয়েটির সুস্থ জীবন, তাও কি তোরা দিবি না?
--আপনার কোন হুকুমটা আমরা তালিম করি না, আব্বা।
--আপনি যা বলবেন তাই হবে।
দুই ছেলে যেন এক স্বরে বলে উঠল।
--বেশ তাহলে একজন গিয়ে মৌলভী ডেকে আন। কই গো বৌমারা, তোমরা
এখন আমার হবু জামাইটিকে কিছু খেতে দাও। তারপর ওদের দুজনকে গোসল
করিয়ে আনো।মগরবের পরেই ওদের নিকা দেব আমি। বলেই তিনি চোখ
ফেরালেন নাদিরার দিকে।
হাত থেকে ছুরি খসে পড়েছে মেয়ের। লাজুকলতার মত দাঁড়িয়ে আছে সে,
যেমনটি তিনি প্রথমবার দেখেছিলেন।
*





৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×