বাংলাদেশের বিয়েতে যৌতুক বা পণ প্রথা বহু প্রাচীণ। শার্লি লিন্ডেনবম পরিচালিত এক গবেষণা অনুসারে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক ছিল আর তাই বিবাহযোগ্য পাত্রের আয়ের উৎস সচ্ছল ছিল না, অপরদিকে বিবাহযোগ্যা ফর্সা গুণবতী পাত্রী পাওযা যেত হাতেগোণা। তাই সেসময় পাত্রপক্ষ পাত্রীপক্ষকে যৌতুক দিত। এই যৌতুক নগদ অর্থ কিংবা অলংকার কিংবা আসববাবপত্র যেকোনো রকম হতো। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কৃষিভিত্তিক মানুষ শহরমুখী হওয়া শুরু করে এবং পাত্ররা শহুরে হয়ে পড়ে কর্মক্ষেত্রে সচ্ছলতা অর্জন করতে শুরু করে। অপরদিকে পাত্রীরা আগের অবস্থানে থাকে, গ্রামেই থাকে। তাই পাত্রের কদর বেড়ে যাওয়ায় সেসময় থেকে পাত্রীপক্ষ পাত্রপক্ষকে পণ বা যৌতুক দেয়া শুরু হয়। কিন্তু একসময় শহরমুখী বিপুল জনগণের সবাই চাকরি পেলো না এবং মুষ্টিমেয় চাকরিপ্রাপ্ত পাত্রের দাম আরো বেড়ে গেলে যৌতুক প্রথা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হযে পড়লো।
প্রথমদিকে যখন কনেপক্ষকে যৌতুক দেয়া হতো, তখন শীতল পাটির বয়ন জানা পাইটা কুমারীরা যে যত প্রকারের বুনন শৈলী জানত, সে তত কুড়ি টাকা পণ পেত তার বিয়ের সময়। মণিপুরিসম্প্রদায়ে বিয়ের যৌতুক হিসেবে কনেপক্ষের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে তাঁত, ববিন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বয়নসামগ্রী যৌতুক হিসেবে দেয়া হয়ে থাকে, কেননা বংশানুক্রমে কোমরতাঁতের তাতী হচ্ছেন মেয়েরা।
পরবর্তিতে অবশ্য বাংলাদেশে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে যৌতুক দেওয়া-নেওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।যৌতুক প্রায় সর্বত্র যৌতুক বা পণ নামে পরিচিত হলেও রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলে যৌতুককে নাচারি বলা হয়।
ইন্টারনেটের বদৌলতে যৌতুক সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এতটুকুই। এবার আসি বাস্তবে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন থাকলেও সেটা শুধুই কাগজে আর কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই নিষিদ্ধ প্রথা থেকে মুসলিমেরা মোটামুটি কথায় বেরিয়ে আসতে পারলেও একেবারেই বেরিয়ে আসতে পারেনি হিন্দু সমাজ। কিছু শিক্ষিতের কথা বাদ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটু লোকাল এলাকার দিকে গেলে বোঝা যাবে এর প্রকোপটা কতখানি!!! পুরোপুরি জেঁকে বসে আছে বৈকি।
প্রথমত নিজের পরিবার থেকেই আসি। আমার নিজের কোন বোন না থাকায় বলা যায় একরকম বেঁচেই গেছেন আমার বাবা। তো আমার মামাতো বোনদের বিয়েতে নেওয়া অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলি। বিয়ে পুরো ঠিকঠাক, বাকি শুধু দেনাপাওনা। আর এই দেনাপাওনাগুলো ঠিকঠাক করার জন্য সাধারণত থাকেন উভয়পক্ষের মুরুব্বিরা, সেখানে আমাদের ঢোকা আইনত অপরাধ ও বেয়াদপি। তো উভয়পক্ষের মধ্যে চলে দরকষাকষি। ছেলেপক্ষের কথা থাকে ঠিক এইরকম যে, “আপনাদের মেয়ে আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই দেবেন। আমাদের শুধু নগদ ২ লক্ষ টাকা দিলেই হবে বিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। আর আপনাদের মেয়েকে আপনারা যা পারেন স্বর্ণ দিয়ে গুছিয়ে দিবেন। আপনাদের মেয়ে সিরিয়াল দেখবে একটা টেলিভিশন, গরমের দিন ঠাণ্ডা পানি খাবে একটা ফ্রিজ আর সংসার গোছাতে যা যা লাগে আর কি। সবই আপনাদের মেয়ের জন্যই। আমাদের আলাদা করে চাওয়ার কিছু নেই”।
এই কথাগুলো অনেকটা কৌতুক মনে হলেও বিশ্বাস করুন, এটাই হল আসল অবস্থা। এই দেনাপাওনাতে বনিবনা না হলে বিয়ে ভেঙ্গে পর্যন্ত যাওয়া দেখেছি আমি। মেয়ের বাবাও মুখ বুজে সহ্য করে নেন। কিই বা করবে?? কই দিন আইনের ভয় দেখিয়ে মেয়ের বিয়ে ঠেকিয়ে রাখবে?? বিভিন্ন সংগঠনগুলো কই দিনই বা পাশে থাকবে?? এই কথাগুলো আপনি আমি বুঝলেও মেয়ের বাবাকে বোঝাতে পারবেন না এতটুকু সিওর। কেননা তারা চাই যে কোন মুল্যে বিয়েটা হয়ে গেলেই হল। মামার দুই মেয়েকেই শুধু নই, এইরকম আমি বহু দেখেছি। শুধু এখানেই শেষ নই, বিয়ের পরই শুরু হয় আরও চাওয়া পাওয়া। এভাবে চলতেই থাকে...... আপনাদের মেয়ে থেকে আপনাদের নাতিনাতনি পর্যন্ত।
অনেকেই হয়তবা অনেক জ্ঞানের কথা বলে থাকবেন এখন। এইযুগে এইসব হয় নাকি??? এত খারাপ অবস্থা আছে নাকি??? আরে ভাই শুধু আছে বললে ভুল হবে এই নেক্কারজনক ঘটনা অহরহ ঘটছে প্রতিনিয়ত। আজ শিক্ষিত হয়েও এগুলো মুখবুজে সহ্য করে নিতে হয় পাছে যদি আমার বোনের বিয়েটাই ভেঙ্গে যায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



