মৃত্যু দোরগোড়ায় রেখে বার্ধক্য বেশ জাঁকালো ভর করেছে আমার উপর। বলা যায়, বয়সের ছাপটা স্বভাবস্বভাবতই হার মেনেছে বার্ধক্যের কাছে। বয়স ৬৪ বছর। ভার্সিটি লাইফ থেকে টেনে আসা নিকোটিনের সাথে বেশ তাল মিলিয়েই চলছে ফুসফুসটা। তবে ইদানিং মাঝে মাঝে খুক খুক করে কাশির উদ্রেক ঘটায় আর কি। শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। বাম পায়ের উরুর মাংসপেশিতে টান ধরেছে, যার ফলে হাঁটতে কষ্টই হচ্ছে একটু। শরীরের সাথে লেগে থাকা চামড়াগুলো রক্তের অভাবে ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করেছে। এত কিছুর পরে নিঃসঙ্গতা শেষদিনগুলোতেও বিন্দুমাত্র পিছু ছাড়েনি।
বিমান বন্দর স্টেশন। দুপুর ১২টা। পরিবর্তনের জোয়ারে সব ভেসে গেলেও ভাসেনি আমাদের দেশের ট্রেনের সময়সূচী। আমার একমাত্র মেয়ে টুম্পা আসবে টাঙ্গাইল থেকে, তাই নিতে এসেছি। কিন্তু ট্রেনের সময়সূচীর যে আকাল অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে আরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হলো। কিন্তু প্রতি মাসে নিয়ম করে বাবাকে একবার দেখতে আসা চাইই তার। প্রচণ্ড রূপবতী-গুণবতী মেয়েটাকে জন্মের পর থেকেই মা বলে ডাকি। একূলে ওর থেকে আপন যে আমার আর কেউ নেই। আমার মায়ের বেশ কিছু গুণ মেয়েটার ভিতর সমুজ্জ্বল। এর মধ্যে অন্যতম হলো রান্না এবং সহনশীলতা। বছর দুয়েক হলো ওর একটা ছেলে হয়েছে, নাম রেখেছে সজীব।
স্টেশনের এমাথা ওমাথা পায়চারী করছি। এটাই সময় কাটানোর একমাত্র ভরসা এখন আমার। হটাৎ পেছন থেকে বহুদিনের পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমার নাম ধরে ডাকছে। পিছনে ফিরে চশমাটা পাঞ্জাবীর এককোণা দিয়ে পরিষ্কার করে যাকে দেখলাম, তাকে এখানে এইভাবে দেখব কখনোই আশা করিনি।
অর্চিঃ কেমন আছো? শরীরের একি হাল করেছ তুমি? চেনায় যাচ্ছে না একদম।
আমিঃ আছি ভালোই। তুমি এখানে? অনেকদিন পর দেখা।
অর্চিঃ তুমি তো মনে হয় জানো, ওর(অর্চির স্বামী) দেশের বাড়ি চট্টগ্রামে। বছর চারেক হলো আমরা ওখানে শিফট করেছি। ঢাকায় একটা জরুরি কাজে এসেছিলাম।
আমিঃ ভালো। একেবারেই বদলাউনি তুমি। আগের মতোই আছো। চুলগুলো পেকেছে এই যা।
অর্চিঃ হু। ঠিকই বলেছ।
আমিঃ আচ্ছা অর্চি। তুমি মনে হয় এখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারনি, তাই না?
অর্চিঃ প্লিজ ওই দুঃসহ দিনগুলোর কথা আমাকে আর মনে করিয়ে দিও না। তোমার তো সুখেই থাকার কথা, তাই না!! যা চেয়েছিলে সবই পেয়েছ অর্থ, যশ, খ্যাতি সব। শুধু আমারই প্রয়োজন ছিল না তোমার।
আমিঃ এভাবে বলো না প্লিজ। কিছু গৎবাঁধা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আটকা পড়েছিলাম আমি ওই সময়টাতে। তবে ভুল করেছি এতটুকু বুঝি। যদি পারো, তাহলে ক্ষমা করে দিও আমাকে।
অর্চি বারবারই শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে চলেছে, কিন্তু আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে চোখে কিছু একটা পরেছে। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে উঠে গেল। মিনিট পাঁচেক পর ফিরল চোখ মুখ লাল করে। সব বুঝেও আজ না বোঝার অভিনয়টা ঠিকঠাক ভাবেই চালিয়ে গেলাম। ও এসে আমার থেকে এক হাত দূরত্ব নিয়ে বসলো, অথচ একসময় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসার জন্য কত্ত রকম সুযোগ খুঁজেছি। যার সবটাই এখন ধুলোমাখা স্মৃতি হিসেবে ঠাই করে নিয়েছে অতীতের পাতায়। স্টেশনের মানুষগুলো নিজের অজান্তেই দেখছে জীবনের পরীক্ষাতে অকৃতকার্য হওয়া দুইজন বেজাই খারাপ পরীক্ষার্থীকে। এক হাত দূরত্বটা আজ হাজার হাজার মাইলের সমতুল্য মনে হয়। আজ বহুদিন পর অর্চির হাতটা একটু স্পর্শ করতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু............
স্টেশনের মাইক থেকে ভেসে আসছে বিদায়ী সুর “ আসস্লামুয়ালাইকুম। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামি আন্তঃনগর ট্রেনটি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবে। আপনার মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। বাংলাদেশ রেলওয়েতে ভ্রমণের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার যাত্রা শুভ হোক।”
ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসলো। সবার শেষে ট্রেনে উঠলো অর্চি। দরজায় দাড়িয়ে আছে ঠাই। চোখের জল শাড়ির আঁচলে বাঁধ মানছে না। অপলক তাকিয়ে আছি। আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। ট্রেন আমার চোখের সীমানা অতিক্রম করেছে আগেই। না করলেই বা কি!!! ঝাপসা চোখে কিছুই দেখতে পারছি না। আমি তো কাঁদতে পারিনা না নাকি। কি জানি এটাকে কান্না বলে কিনা??? কি একটা অজানা অসঙ্গায়িত কষ্ট আমাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। এসে বসে পরলাম স্টেশনের বেঞ্চে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম অনেকক্ষণ ধরে। চশমাটা খুলে পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখটা মোছার চেষ্টা করলাম টুম্পাকে কিছু বুঝতে না দেওয়ার জন্য। কেননা কিছুক্ষণের মধ্যেই টুম্পা চলে আসবে। বেঞ্চের উপর বসে আছি রাজ্যের কষ্ট বুকে ধারণ করে। খুব একা লাগছে নিজেকে। কানে ভেসে আসছে স্টেশনের এক মধ্যবয়সী বাদাম বিক্রেতার নোংরা পকেটে চায়না মোবাইল থেকে বেজে ওঠা বহু পুরানো একটা গান—
“............এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি, শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরব না।”

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



