১.
রুট নং-১৩ (মোহাম্মদপুর টু ধূপখোলা)
১৩ নং বাসের হেল্পার মফিজ। বয়স ১৭ কি ১৮ এর মত হবে। বাবা দুইটা বিয়ে করায় মা তাকে নিয়ে পাড়ি জমায় এই ইট-পাথরের শক্ত যান্ত্রিক ঢাকা শহরে। মা মেসে ভাত রান্না করেন। আর ছেলে হেল্পারি। চলে যায় দিন, না চলার মতো করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বয়সটাকে পরিবর্তন করে এই ভাবে বলা যায়- ‘সতের-আঠারো বছরের মতো এমন বালাই এই পৃথিবীতে আর নায়’।
‘ওই জিগাতলা, নিউমার্কেট, আজিমপুর, পল্টন, গুলিস্থান, ধূপখোলা’-প্যাসেঞ্জার তুলতে তুলতে সূর্য কখন মাথার উপর দিয়ে হেলে পড়ে রাতের আঁধারে নিভে যায় হিসেব থাকে না মফিজের। তপ্ত রাজপথ হার মেনে যায় মফিজের চলতে থাকা অনবরত মুখের কাছে- ‘ ওস্তাদ, ডানে প্লাস্টিক, বাঁয়ে মোড়। বরাবর, বরাবর। ওই সিএনজি ব্যাটা বাঁয়ে চাপ হালার পুত’।
প্রচণ্ড খাটনির মধ্যেও কিছু আত্মিক সুখ খুঁজে নিতে বিবেকে বাধে না মফিজের। সুন্দরী মেয়েদেরকে বাসে তোলার সময় আলতোভাবে পিঠে হাত দেওয়া কিংবা নামানোর সময় ‘ ওস্তাদ মহিলা নামার আছে, আস্তে ব্রেকে’ বলতে বলতে হাত ধরে নামিয়ে দেওয়া। এছাড়া কিই বা আর করবে!!! এত সুন্দরী মেয়েকে পাওয়ার আশা তো একজন হেল্পারের করা সাজে না। ঠিক এভাবেই অকথ্য গালিগালাজ, মাঝে মাঝে মারামারি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলা, ড্রাইভার-সুপারভাইজারের চোখ ফাকি দিয়ে কিছু ভাড়া মেরে দেওয়া আর নিজের বিবেককে পদদলিত করে চলতে থাকে ১৩ নং বাস, চলতে থাকে মফিজ্জ্যা। পল্টন, গুলিস্থান, মতিঝিল, ধূপখোলা......
২.
সারাদিনের ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে মালিককে টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার সময়ও থাকতে হয়। অতঃপর ড্রাইভার পকেট ঘেঁটে কিছু টাকা পাইলেই হইছে, কোন রকম কথাবার্তা ছাড়াই ঠাডিয়ে দুই-তিনটা চড় তো আছেই। মা-বাপ নিয়ে গালি শোনাটা তো অতি স্বাভাবিক একটা ব্যাপার মফিজ্জ্যাদের কাছে। সারাদিনের উপার্জন ১৫০-২০০ টাকার মতন। থাকার জায়গা না থাকায় বাসের দুইটা সিট লাগিয়ে দিব্যি রাত পার করে দিতে পারে মফিজ্জ্যা। একদিন মধ্য রাতে ঘুম ভাঙ্গে আর এক হেল্পার বন্ধুর ডাকে।
-ওই মফিজ্জ্যা ওঠ। এত ঘুম কিসের?? জেগে থেকে স্বপ্ন দেখবি নাকিরে, হালার পুত??
-ক্যামনে?
-আইচ্চা, এক কাম কর তাইলে। এইহান থ্যাইক্কা সোজা বাঁশবাড়ি বস্তির সামনে দিয়া র্যাব অফিসের পাশের গলিত যাইয়া দুইডা চক্কর দিবি। তহন যদি কেউ জিগায় কিছু লাগব কিনা?? তুই ২০ টাকা হাতে ধরাইয়া দিয়া যা দিবে ওইডা নিয়া আইয়া পরবি। যা যা।
প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্বেও যায় মফিজ। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে সিমেন্টের কাগজে মোড়ানো একটা পুঁটলি নিয়ে। হেল্পার বন্ধুর কাছে বুঝিয়ে দেয় সে। এবং অবাক হয়ে দেখতে থাকে তার বন্ধুর অসাধারণ কারুকার্য। পুঁটলি থেকে কিছু শুকনা গাছের পাতা বের করে ছোট ছোট বীজপাতা এবং ডালগুলো আলাদা করে হাতের তালুতে নিয়ে ডলা দিয়ে মিহি করল। তারপর সিগারেটের তামাক মিশিয়ে বাকি তামাক ফেলে খালি করল সিগারেট। অতঃপর হাতের তালুতে থাকা মিহি জিনিষগুলো সুন্দরভাবে সিগারেটের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর মফিজকে ধরাতে বলল। সিগারেট মাঝে মাঝে যদিও খায় মফিজ্জ্যা। কিন্তু এই জিনিষটার সাথে পরিচয় ঘটেনি আগে কখনোই।
-কি এটা??
-সিগারেট। আবার কি !!!
-তাইলে কি মিশাইলি এইগুলান??
-আরে ধুর শালা, এইগুলান হইল উন্নতমানের তামাক। নূতন আইছে বাজারে। কথা কম কইয়া টান দে তো হারামজাদা। রাত অনেক হইছে।
মফিজ আর কথা বাড়ায় না। দুই বন্ধু মিলে টানতে থাকে ইচ্ছামতো। টেনে শুয়ে পড়ে বাসের সিটের উপর। অনুভব করতে থাকে তামাকটা আসলেই কাজের। সমস্ত কষ্ট, সমস্ত পরিশ্রম, সমস্ত অপমান ভুলিয়ে দিয়ে মফিজকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে। ক্রমশ নিচের দিকে। একদম পৃথিবীর কেন্দ্রে। প্রচণ্ড সুখ অনুভব করতে থাকে মফিজ্জ্যা। প্রচণ্ড সুখ। মোহাচ্ছন্ন হয়ে পরে মফিজ্জ্যা। মাথার মধ্যে বাজতে থাকে আস্তে আস্তে- ‘ওস্তাদ, ডানে প্লাস্টিক, বাঁয়ে মোড়। বরাবর, বরাবর......’।
এভাবেই কেটে যাচ্ছে হাজারো মফিজ্জ্যার জীবন। এভাবেই হয়ত কেটে যাবে। এই যান্ত্রিক অমানবিক শহরটাতে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। পৃথিবীর কেন্দ্রে। প্রতিনিয়ত।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



