কে কে পড়া শিখিস নাই? সব দাঁড়া, বেঞ্চের উপরে কান ধরে দাঁড়া।
লীলা আপার কঠিন হুংকারে একে একে সবাই দাঁড়াতে থাকে। ক্লাস সিক্সের ক্লাস রুমটা বেশ ছোটই। দু পাশে দুটা করে মোট চারটা জানালা। এর ভেতর শুধু এক পাশের দুটো জানলার ভেতর দিয়ে আলো ঢুকে ক্লাসরুমের হাড় জিরজিরে লাইট বাল্বগুলোকে একটু স্বস্তি দেয়। লীলা আপার ক্লাস মানেই তাই ঘোর আষাড়ের দিন ! শুধু হাতেগোনা কয়েকটা আঁতেল বাদে বেঞ্চের উপরে ক্লাসের সবকটা দাঁড়ানো। জানালা গুলোও ঢাকা পড়ে যায় সে সময়, আলোর যাতায়াত ও তাই বন্ধ ! একা একা ম্যাটম্যাটে বাল্বগুলো আর কত আলোই বা দিতে পারে?
অবশ্য কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ঐ লাইটের কথা ভেবেই আমাদের মুখগুলো একদম একশো ওয়াটে জ্বলজ্বল করত ! ক্লাসের সবার সামনে একজনকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলে লজ্জার সীমা থাকেনা, কিন্তু সবাই যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে আর লজ্জা কি !
লীলা আপা তাই ক্লাসে আসা মাত্রই আমরা বেঞ্চে উঠে পড়ার সূক্ষ তাগিদ অনুভব করতাম ! পড়া শিখলেও রিস্ক নিতাম না, আর সবার সঙ্গে সদ্য নেমে আসা আষাড় মাস উপভোগ করতে করতে, লীলা আপার তীব্র বাক্যবাণ হজম করতে করতেই ঘন্টা পড়ে যেত। লীলা আপাও চোখমুখ লাল করে আরো কিছুক্ষন ঝাড়ি বর্ষন করতে করতে ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতেন।
একদিন কি যেন মনে হল লীলা আপার ক্লাসে দাঁড়ালাম না। চুপচাপ ঘামটি মেরে বসে আছি, পাশের সবাই দাঁড়ানো, তাই যথাসম্ভব লুকিয়ে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছি। ক্লাস ক্যাপ্টেন জংগলের সারি সারি গাছের ভেতর থেকে বান্দরগুলোকে খুঁজে বের করে আপাকে খুশি করার আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে। যেই না কাউকে দেখে বসে থাকতে, অমনি "পালাবি কোথায়" মনোভাব নিয়ে বাজখাই গলায় বলে " আপা এইযে আরেকজন"।
আমিও ধরা পড়ে গেলাম। আমাকে কয়েদির মত দারোগার সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করা হল। যা পড়া দিয়েছিলো সব জানা জিনিস, কিন্তু সমস্যা হল গলা দিয়ে তো কোন শব্দই বের হয়না। এদিকে লীলা আপার চোখ সন্দেহে ছেয়ে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই পড়া না শিখে বসে ছিলাম। আপার চোখের ভাব কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। এদিকে আমার গলার ভাব মিনমিনে থেকে নাই তে পরিনত হচ্ছে !
কড়া গলায় অনেকটা ধমকের সুরে বলল " প্রেজেন্ট পারফেক্ট টেনস কাকে বলে বল"। আমি ঢোক গিলি আর গলার স্বর পুনোরুদ্ধারের চেষ্টা চালাই। আপা আবারো বলে "কি পড়া শিখিস নাই না?"
নাহ এবার তো আর চুপ করে থাকা যায়না। মুখ দিয়ে কেমন কেমনে করে যেন বের হয়ে গেল-- যেই কাজ কিছু আগে শেষ হইয়া গিয়াছে কিন্তু ফলাফল এখনো বিদ্যমান উহাকে প্রেজেন্ট পারফেক্ট টেনস বলা হইয়া থাকে। এরপর আবারো জিগেস করল "ডু" এর প্রেজেন্ট পারফেক্ট টেনস বল। মাথার ভিতর তখন ডু ডু ডু ঘোরা শুরু করছে। এরপর গলা পিছলে বের হয়ে গেল "ডান আপা ডান" !
লীলা আপা তখন বললেন "যাহ"।
আমিও তখন গাছে ফিরে গেলাম। আহ কি শান্তি, প্রেজেন্ট পারফেক্ট টেনসের মত শান্তি ! লীলা আপার সামনে পড়া দেবার মত কঠিন কাজ সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু তার ফলাফল বিদ্যমান-- আমি এখন আষাড়ের দিনে গাছের গুঁড়িতে পরম আনন্দে বসে আছি !