আমাদের ক্লাসে লিখিনা নামে এক মেয়ে ছিলো । দাদু স্যার বলেছিলেন , আমি তোর বাবা হলে নাম পাল্টে শিখিনা করে দিতাম । তুইতো শিখিসই না । লিখবি কি করে ? স্কুলে এসেই বা কি করবি !
দাদু স্যারের হাসিমুখের গালিগালি শুনতেই লিখিনা প্রতিদিন সবার আগে ফার্স্ট বেঞ্চে এসে বসে থাকতো । লিখিনাকে আমরা এখনো শিখিনা বলেই ডাকি ।
দাদু স্যার মারা গেছেন প্রায় দশ বছর আর লিখিনা এখন পুরোদস্তুর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট । রাস্তাঘাটে লিখিনার সাথে দেখা হলে লিখিনার গাড়ির ড্রাইভার আমাদের লম্বা করে পা ঠুকে সালাম দেয় আর আমরা এখনো সেই কতদিনের পুরোনো স্মৃতি নিয়েই হাসাহাসি করি । কিন্তু শেষটায় এসে দাদুু স্যারের জন্য কষ্ট হয় । অতি বৃদ্ধ একজন মানুষ আমাদের জন্য কি না করে গেছেন !
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্পশিক্ষিত হয়েও দাদুস্যার আমাদের ভেতরে যে আনন্দে থাকার শিক্ষা দিয়ে গেছেন তার কিঞ্চিত নিয়েই লিখিনা এখন হাসিমুখে রাষ্ট্র চালায় , সংসার চালায় ।
একটু বড় হয়ে হায়ার প্রাইমারিতে ছিলো জাফর দেওয়ান । শহীদ স্যার তাকে নাম দিলেন , জাফর নেওয়ান । বললেন , তুই কাউকে জীবনে কিছু দিয়েছিস প্রমান করতে পারলে তোর নাম দেওয়ান থাকবে । নইলে আজ থেকে তুই নেওয়ান । জাফর নেওয়ান ।
জাফর এখন বিশাল ব্যাবসায়ী । শহরে শহরে মোটর পার্টসের বিজনেস ওর । নিতে নিতে ওর অনেক বেশিই হয়ে গিয়েছে । সম্প্রতি এলাকায় একটা মসজিদ করে দিয়েছে । নিজের নামের স্বার্থকতা তৈরী করেছে । শহীদ স্যার বেচে থাকলে খুশি হতেন ।
আমরা প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুগুলো সবাই যার যার মতো যার যার জায়গায় ভালোভাবেই বেচে আছি শুধু অপমৃত্যু ঘটেছে ছোটবেলার সেই অল্পশিক্ষিত প্রাইমারি শিক্ষকদের । প্রাইমারি ডিঙ্গানোর কিছুদিন পরেই তাদের বদলে আসলেন রাশভারি ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষকেরা । হাইস্কুলের শিক্ষিত জ্ঞানী শিক্ষকদের পাল্লায় পড়ে স্কুলে যাওয়াই প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো আমাদের । দেওয়ান ব্যাবসায় চলে গেলো । আর আমি খাবি খেতে থাকলাম ।
এর প্রায় চারবছর পরে একবার অভিভাবক সমাবেশে আমার মা সারা জিলাস্কুলের শিক্ষকদের সামনে বললেন , আমার ছেলে বিগত দশটি বছর দশটি স্কুলে একদিন স্কুল ফাকি দেয়নি । সেই ছেলে আজ কিভাবে টানা দুমাস ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে ? কার দোষ ? আমার না আমার ছেলের ?
ফলশ্রুতিতে ক্লাসটিচারের বকুনি শুনতে শুনতে ওই ক্লাস পার করতে হলো আমাকে ।
কলেজ জীবনে এসে আর ক্লাসের বালাই নেই । শিক্ষকদের নামও জানতাম না । বাংলা ক্লাস করেছিলাম দুইটা । প্রথম ক্লাসে অরিয়েন্টেশন ছিলো । ক্লাসের মাঝখানে ঢুকেই দেখি সুন্দরি মতো এক ম্যাডাম সবাইকে ফুল দিচ্ছেন । আর দ্বিতীয় দিন একটু দেরি করে ক্লাসে ঢুকায় সবার সামনে দাড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন , নাম কি ? নাম বলার পর জিজ্ঞেস করলেন , ইন্টারের বইয়ের নাম জানো ? আমতা আমতা করে বললাম , উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা । সবাই হো হো করে হেসে উঠলো । আমি লজ্জিত হয়ে এক কোনায় বসে পড়লাম । পরে শুনলাম , ক্লাসটা ইংলিশের ছিলো ।
বলাই বাহুল্য , ওই ক্লাসে তৃতীয় দিনের জন্য আমার আর ঢোকা হয়নি । আর বাংলা ক্লাস ! আমি জীবনেও করিনি ।
মেডিকেলে এসে ক্লাস এটেনডেন্সের ভয় দেখিয়ে সকাল সাতটায় ক্লাস করানোর ক্ষেত্রে কলেজ কর্তৃপক্ষ কিঞ্চিত সফল হলেন । টানা পাঁচবছর সমৃদ্ধ ঝাকুনি খেলাম । কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদায়ক্ষনে এসে একটা আফসোসই থেকে গেলো জীবনে । গ্রাজুয়েশনের বাংলাদেশে কোথায় সেই দাদু স্যার , কোথায় সেই শহীদ স্যার !!
দেওয়ান ব্যাবসায় জড়িয়ে পড়ায় তাকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা রাখতে হয়নি । আর লিখিনা আর্মিতে যাওয়ার কারনে তাকেও আর গ্রাজুয়েশন করতে হয়নি । লিখিনা আর দেওয়ান এই ঢাকা শহরে গ্রাজুয়েশন করতে আসলে অধিকাংশই তো দেওয়ান আর লিখিনার আসল নামটাও জানতে পারতেন না !!!
ভাগগিস , ওরা আসেনি ! বাংলাদেশের শিক্ষকদের ওরা দাদু স্যার আর শহীদ স্যার বলেই জানুক ।