রক্তিম আকাশটাকে সাক্ষী রেখে দুহাতের আঙুল চেপে ধরা পথগুলো শেষ না হতেই একদিন মৃত্তিকা বলেছিলো , এটাই কি তোমার মৌনপাহাড় !
আমি হেসে ফেলেছিলাম , আরে না ! এটা কি পাহাড় নাকি ! এটা ট্যাংকি টিলা । এখানে নৈঃশব্দ নেই । এখানে মৌনতা নেই । মৌনপাহাড়ের নিঃসঙ্গতা বুঝতে গেলে তোমাকে পাহাড়ে নয় , সমুদ্রে যেতে হবে ।
আজ অনেকদিন ধরে মৃত্তিকার সাথে কোন যোগাযোগ নেই । মৃত্তিকা নিশ্চুপ হয়ে গেছে । মৃত্তিকা হারিয়ে গেছে । আমার জীবনে মৃত্তিকাও আজ এক মৌনপাহাড় ।
আজও গভীর রাতে মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে উঠি । ভো ভো শব্দে লঞ্চের হর্নগুলো ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে চলে যায় । পাশের বিশাল লেকটার জলের শব্দ একেবারে কানের উপর এসে আছড়ে পড়ে । একবার ঘুম ভেঙে গেলে আজকাল আমার আর চোখ বন্ধ হতে চায় না । নিঃশব্দে জেগে থাকি আর নিঃসঙ্গতাকে কামড় দিয়ে ধরি ।
অনেকদিন আগে মংলায় গিয়েছিলাম এক পিকনিকে । স্কুলের বন্ধুদের সাথে । এই বিষন্ন শব্দটার সাথে পরিচয়টা আমার সেদিন থেকেই । গভীর সমুদ্রের মাঝখানে জাহাজগুলোর একেকটা চিৎকার যেনো নিঃসঙ্গ মানুষের হাহাকারের চেয়েও গাঢ় ।
এরও প্রায় চার বছর পরে খুলনা জিলা স্কুল থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে গিয়ে সিট পড়েছিলো উদয়ন স্কুলে । পরীক্ষার হল থেকেই শোনা যেতো জেলখানা ঘাটের অসংখ্য লঞ্চ আর ভীড় করে থাকা কুলিদের চিৎকার । খুব টানতো । কি জানি , হয়তো অগোছালো জীবনের টান আমাকে সারাটাজীবনই এভাবে টানবে ।
হলের জীবনের বয়সটা আজ পার হয়ে গেলো প্রায় পাঁচটি বছর । এখনো বাসা থেকে এসে বাবা জিজ্ঞেস করেন , আগের অভ্যাসটা এখনো গেলো না । মশারি টাঙ্গাওনা কেনো ?
আমাকে জবাব দিতে হয় , আমার মশারি নাইতো বাবা ।
বাবা আর কোনো কথা বলেননা । ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে আরেকবার আশাহত হন ।
রুমে আমার জন্যে বরাদ্দ সম্পূর্ন জায়গাটা জুড়েই যেনো অবিশ্বাস্য এক অভদ্রতার বসবাস । সারাটা বিছানা ছড়িয়ে আর জড়িয়ে উথালপাথাল বইপত্র আর কাপড়চোপড়ের ছড়াছড়ি । আর সোজা উপর দিকে তাকালে দেখা যাবে মাকড়সার জালের মহোৎসব । সেই তুলনায় টেবিলটা বরং একটু ভদ্র । ওখানে ধুলোর আস্তর ছাড়া বিশেষ কোন বাহুল্য নাই ।
পাচঁ বছর আগে নিজের বাসায় থাকার সময় কিন্তু পরিস্থিতি আরেকটু অন্যরকম ছিলো । রুমে কোন বিছানাই ছিলো না । এখন তো তাও সেটা হয়েছে । মেঝের উপর জাস্ট একটা মাদুর বিছিয়ে কাটানো বছরগুলো থেকে আমি একটুখানি সরেই এসেছি । তখন চারপাশে ছড়ানো থাকতো বিবিধ রকমের বস্তু । একটা টেবিল ফ্যান ঘুরতে থাকতো একেবারে মাথার পাশেই । আর থাকতো একটা রেডিও । মোবাইল ফোনের কোন বালাই ছিলো না । পড়ার বই বাদে হাজার রকমের বইয়ের স্তুপ জমে গিয়েছিলো পুরো ঘরে । হাটার জায়গার বড্ড অভাব দেখা দিয়েছিলো ।
কিছুদিন পরে আত্মীয়স্বজনের নানারূপ কটুক্তির কারনে রুমে তাদের প্রবেশটাই নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দিয়েছিলাম । আর মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ হবার সাথে সাথে আলো বাতাস চলাচলও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিলো । একটা মাত্র ভেন্টিলেটরই ছিলো আমার আস্তানায় আলো ঢুকবার একমাত্র রাস্তা ।
মা প্রতিবেলায় দরজার সামনে এসে একবার নক করে বলতেন , ভাত নাও । একটু ফাঁকা করে ভেতরে ভাতটা নিয়েই আবারো দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতো । এভাবে অনেকগুলো বছর আর অনেকগুলো শহরের মায়া মাড়িয়ে নিলাম । কিন্তু কেনো যেনো সেই পুরোনো জাহাজের ডাকটা আজও উপেক্ষা করে যেতে পারলাম না ।
প্রথমবার যখন ঢাকায় এসে সলিমুল্লাহ মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলাম , আবার সেই ভো ভো শব্দটার সাথে সখ্যতাটা নতুন করে জোড়া লেগে গেলো । ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে কাটিয়ে দিতাম সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে । এতো চিৎকার আর চেচামেচিতে , এতো গন্ধ আর নোংরা পরিবেশেও কিছুই মনে হতো না । শুধু লঞ্চের ভো ভো শব্দটা মাথার ভেতরে গেথে যেতো । এতো শব্দের কোলাহলেও কেমন যেনো একটা নির্জনতার উপলব্ধি হতো ।
এইসব অদ্ভুত আয়োজন আর কবিতার টান ছয় মাসের মাথায় আমাকে পুরোন ঢাকার মায়া ছেড়ে রাস্তার মানুষ হয়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলো । কিছুদিন ঢাকার রাস্তায় এদিকওদিক ঘুরেফিরে শেষপর্যন্ত বাড়িতেই ফিরে গিয়েছিলাম । আবার একটা নতুন অধ্যায়ের শুরু হলো । কিন্তু কেনো যেনো সেদিনের সেই ব্যর্থতা আমাকে পরবর্তী জীবনে কখনো সামান্যও কাদাঁয়নি । আবার পরের সফলতাগুলোও আমাকে কেনো যেনো পুরোপুরি হাসাতে পারেনি । কারনটা আজ বুঝি । প্রতিটা রাত নিঝুম হলেই আমাকে আমার পুরাতন সেই নিঃসঙ্গতারা এসে হাতছানি দিয়েই গেছে । আর আজও যায় ।
বাড়িতে ফিরে এসে মেরিন একাডেমিতে যাওয়ার পাগলামি শুরু হলো । কোচিংও শুরু করলাম । সারা দেশের আত্মীয়স্বজন এসে আমার কানের কাছে এসে বসে পড়লো । কি হলো , কেনো হলো , ভালোইতো ছিলি । আবার কেনো পাগলামি !
সবাই মিলে পুরাই উড়াধুড়া রকমের বিরক্ত শুরু করে দিলো । মেরিন কোচিংয়ের মাসুম ভাই পর্যন্ত বললেন , তোমার মেরিনে ঢোকা সম্ভব না । চশমা দেখেই বাদ দিয়ে দিবে । বেটার তুমি ফিরে যাও । হতাশ হয়ে পড়লাম । আর কোথাও ফিরবার জায়গাও তো রাখি নাই । হয়তো জায়গা ছিলো কিন্তু ইচ্ছা হলো না । যে পথ রেখে এসেছি সেখানে আবার তাকানোটা অহেতুক পড়ে থাকা পায়ের চিহ্ন খুটে আনবার মতো ।
মানুষের বিরক্তিতেই পরেরবার আবার ফিরলাম । এবার ঢাকা মেডিকেলে । তবুও প্রথমদিকে সদরঘাট খুব টানতো । মাঝে মাঝে যেতামও । কিছুদিন যেতেই নিজেকে ধমকে দিলাম । খুব শক্তভাবে আটকে গেলো সদরঘাটের রাস্তাটা । বহু দিনের পুরাতন বন্ধু ফয়সাল কামাল রিপনের সাথে যোগাযোগটাও কমে গেলো । নিজেকে বুঝালাম কিছু পেতে গেলে কিছু ঝেড়ে ফেলো ।
এরপর অনেকগুলো দিন মাঝখানে চলে গেলো । ঢাকা মেডিকেলের জীবন প্রায় শেষ হবার পথে । আর রাঙ্গামাটিতে বাবার বদলি হবার মাধ্যমে আবার সেই বিশাল জলের রাশি , আবার সেই জাহাজের ভেপুর সাথে সাক্ষাত । বিশাল লেকের ধারে হাটতে হাটতে কখন যে নখের ভেতর কাদা আটকে যায় , আজকাল কেমন যেনো আর টের পাই না । আমার সমস্ত চোখের ভেতর এখন যেনো দিগন্তের হাতছানি , মাথার ভেতর নাচতে থাকে উড়বার নেশা ।
মাঝে মাঝে শুধু অনেক দুর থেকে আসা বড়ো বড়ো মাছ ধরা জলযানের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর লঞ্চগুলোর চিৎকার শুনে মনে হতে থাকে , অনেকতো হলো এবার বের হবার সময় এসেছে । নিঃসঙ্গতাকে আজীবনের সঙ্গী করবার সময় এসেছে । আর অগোছালো মানুষটার আরো অগোছালো হয়ে যাবার সময় চলে এসেছে ।