আজকের বিচিত্র পেশার নায়কের নাম মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ডাকনাম মিজান। বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। প্রায় বিশ বছর আগে তিনি ছাত্রাবস্থায় পরিবারের দারিদ্রার কারনে এবং পড়াশুনা ভাল না লাগার কারনে এই শহরে চলে আসেন এবং পরিচিত চাচার মেসে উঠেন। চাচা পেশায় একজন মুড়ি বিক্রেতা ছিলেন এবং তার সাথে বেশ কয়েকদিন এটা দেখে তিনি নিজেই একদিন চাচাকে বলেন, তিনি নিজেও এই ব্যবসা করবেন, খুব সামান্য পুঁজিতে এই ঝালমুড়ি বানানো দিয়ে জীবনের প্রথম কাজ শুরু করেন।
প্রথম দিনের ব্যবসার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেজগাঁও পলিটেকনিকের সামনে প্রথম দিনের কথা এখনো চোখে ভাসে, কত টাকা বিক্রি হয়েছিল তা মনে নেই তবে বেশ ভাল বিক্রি হয়েছিল। ব্যস, সেই থেকে শুরু।

ঝালমুড়ি বিক্রি করে তিনি ভাল আছেন বলে জানালেন তবে বিক্রি আগের মত নেই বলে কিছুটা আক্ষেপ আছে। সকাল এগারটা থেকে একটা পর্যন্ত কাজ করে বেগুনবাড়ির মেসে ফিরে খেয়ে দেয়ে কিছু সময় ঘুমিয়ে পড়েন আবার বিকেল পাঁচটা থেকে শহরের অন্য কোথায়ও দোকান সাজিয়ে বসেন। চলে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। বিশেষ করে বিকেলে মগবাজার এলাকার কোথায়ও বসতে পছন্দ করেন। রাতে বাসায় ফিরে সব কিছু ঘুচিয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে শুরু করেন নিজের কাজ। প্রথমে বাজারে যান, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে বাসায় ফিরে আসেন এবং সেগুলো ধুয়ে বা যা যা কাটার তা কেটে সাজিয়ে তোলেন। মুড়ি, টমেটো, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, লেবু, বিট লবন এবং এক প্রকারের বিশেষ মশলা! সব কাজ নিজে করে থাকেন। তবে সকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার মেসের একজন বুয়া করে দেন এবং ব্যবসার রান্নার একটা বিশেষ কাজ তিনি নিজে করেন। হ্যাঁ, ঝালমুড়ির বিশেষ মশলার রান্না।
মিজান আমাকে জানালেন, এই বিশেষ মশলা মিক্সে প্রায় ১৬ ধরনের মশলা দিয়ে রান্না করা হয়, সাথে থাকে সরিষার তেল, পানি দেন না। আগে এই মশলা তেরী হত পানি দিয়ে এখন আর পানির দেন না, ফলে এই মশলার স্বাদ ও ঘ্রান অনেকদিন অটুট থাকে, একদিন বানালে অনেকদিন ব্যবহার করা যায়। চাচা থেকে যে মশলা বানানো শিখে ছিলেন সেটা এখন আর বানাতে চান না কারন তিনি তার কাষ্টমারদের রুচি বুঝতে পারেন। কাষ্টমাররা এখন এই মশলার ঘ্রান ভাল পান।
ব্যক্তি জীবনে মিজান বিবাহিত এবং দুই ছেলের পিতা, স্ত্রী ও সন্তানরা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। এই ব্যবসার মাঝেই এক সময়ে বিবাহ করেন, পাত্রী পূর্বের পরিচিত, পাশাপাশি গ্রামের। ইচ্ছা করেই অভিজ্ঞতার কারনে জানতে চাইলাম, তিনি যে এই ঢাকা ঝালমুড়ির ব্যবসা করেন সেটা তার স্ত্রী ও ছেলেরা জানেন কি না! মিজান হেসে জানালেন, না, বিয়ের সময় এই পেশার কথা বলা হয় নাই, তবে বিবাহের প্রায় মাস খানেক পর স্ত্রী বুঝতে পারছিলেন, তিনি এমন একটা কাজ করেন। তবে এখন আর এই ব্যবসার কথা বলতে লজ্জা পান না, কারন এই ব্যবসার কারনে তিনি স্বাভলম্বী এবং বেশ আরামে দিন কাটছে, ছেলেদের লেখা পড়া শিখাতে পারছেন, বলতে গেলে এখন আর অভাব নেই।
প্রতিদিন কমের পক্ষে পাচশত টাকা লাভ থাকে, কখনো এর বেশি লাভ হয়। ব্যবসায় তেমন পুঁজি লাগে না, এখন মুড়িও কাওরান বাজার থেকে বাকীতে নিয়ে আসতে পারেন, পরের দিন দাম দিলেও চলে। আর চলাচলে তো স্বাধীনতা আছেই, মন চাইলে বাড়ী ফিরে যেতে পারেন যে কোন সময়ে। তবে প্রতি মাসেই একবার বাড়ি যান, কখনো দিন পনর থেকে ফিরে আসেন। হাতে টাকা জমলেই হল!
প্রাসঙ্গিক ভাবে অনেক কথা হল, তিনি বেগুনবাড়ির যে মেসে থাকেন সেই রুমে আরো তিনজন থাকেন। তারা কি করেন জানতে চাইলে বলেন, একজন বাদাম বিক্রি করেন, একজন সিজন্যাল নানান প্রকার রস বিক্রি করেন (কখনো খেজুরের রস, কখনো তালের রস), একজন কি করেন সেটা তিনি জানেন না! আমি হেসে বললাম, রস বিক্রেতাই আমার আসল বিচিত্র পেশার মানুষ, যাকে আমি খুঁজে বেড়াই প্রতিদিন।
মিজান ভাইয়ের সাফল্য কামনা করি। আমাদের স্ট্রীট ফুডে ঝালমুড়ি বিশেষ স্থান দখল করে আছে, আমরা সেই ছোট বেলা থেকেই এই ঢাকা শহরে দেখে আসছি। আমাদের ছোটবেলায় স্কুলের সামনে এই ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের দেখতাম এবং তখন আমরা খেতামও। মিজান ভাই জানালেন, মাত্র ৫০ পয়সা বা এক টাকায় আগে অনেক ঝাল মুড়ি দেয়া যেত এখন সেটা কল্পনাও করা যায় না, পাঁচ টাকার চাইলেও বিরক্ত লাগে! ১০টাকা থেকে এখন শুরু হলেই ভাল!
যাই হোক, স্বাভাবিক প্রশ্ন, ভবিষ্যতে কি করবেন? হেসে মিজান ভাই জানালেন, না তেমন কিছু চিন্তায় নাই। ছবি তোলায় অনুমতি চাইলে হেসে বলেন কোথায় লিখবেন? আমি জানালাম, নেটে টুকটাক লিখে থাকি। তিনি বললেন, যা লিখেন তা যদি দেখান তবে খুশি হব। এই সময় তার প্রান খোলা হাসি দেখে আমি আরো কিছু কথা বাড়াই। কি মোবাইল ব্যবহার করেন, দেখতে চাইলে দেখালেন। এন্ড্রয়েড ফোন, সিম্পনি। নেট কানেকশন আছে কি না জানতে চাইলে বললেন, হ্যাঁ মাঝে মাঝে ছেলে দেখে। আমি বললাম, বড় ছেলে এবার কোন ক্লাসে পড়ে? তিনি জানালেন, সে এবার এইটে পড়ছে তবে বেশ লম্বা হয়ে গেছে, মটর সাইকেল চালায়। ছেলের মটর সাইকেল চালানোর কথা শুনে আমি কিছুটা তাজ্জব। পরে জানলাম, গ্রামের বাড়িতে মিজান ভাইয়ের নিজের মটর সাইকেল আছে, তিনি নিজে কিনেছেন। নিজে বাড়ি গেলে নিজেও মটর সাইকেল চালান, বাড়িতে না থাকলে বড় ছেলে চালায়, স্কুল বাজারে যায়!
বিচিত্র এই দুনিয়া, বিচিত্র আমরা এই মানুষেরা!
বিচিত্র পেশাঃ ১৪ (কমলা কাহিনী!)
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



