দেশের দুইজন বিশিষ্ট চিন্তাশীল ব্যক্তির বেশ কিছু কথা অনলাইনে ভেসে বেড়াচ্ছে, জীবনের এই সময়ে এসে তারা সত্য কথাই বলছেন এবং তাদের মিথ্যা বলার কোন যুক্তি দেখি না, কারন তারা কখনো রাষ্ট্র থেকে কোন সুবিধা নেন নাই এবং নিবেন বলেও মনে হয় না। বর্তমানে যাদের বয়স ৬০ পার হয়েছে, তাদের জিজ্ঞেস করলেই এই দুইজনের কথা কতদুর সত্য তা বুঝতে পারবেন।
আমি আমার কথা বলি, আমি সেই সময়ে ছোট ছিলাম, আমার জন্ম শ্রীমঙ্গলে, আমার এখনো মনে আছে শ্রীমঙ্গলের ডাকবাংলা পুকুরের পাশে একটা বড় গাছ ছিলো, তার ডালে দেখতাম, ৭২/৭৩ সালে হতে পারে, মানুষজনকে পা বেঁধে উল্টা করে ঝুলিয়ে পেটানো হত, তাদের চিৎকারে আমাদের ঘর থেকে বের হতে দেয়া হত না, যদিও আমরা পুকুরের এই পারে থেকে দেখতাম, নুতন বাজারে আমাদের বাসা ছিলো। এদের কি কারনে এমন পেটানো হত তা সেই সময়ে না বুঝলেও এখন মনে হয় এই কাজ রক্ষীবাহিনী করত। এর পরে একটা দৃশ্য আমার এখনো মনে পড়ে আমি একবার দেখেছিলাম, একজন মৃত (সম্ভবত সদ্য মৃত্য)কে হাত পা বেঁধে মাঝে বাঁশ দিয়ে ঝুলিয়ে দুইজন কাঁধে করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিলো এবং তার শরীর থেকে রক্ত পড়ছিলো, মাথা ঝুলে ছিল, জানি না তাদের কি অপরাধ ছিলো।

আমার দাদা মারা যান ১৭ আগষ্ট ১৯৭৫ইং, ফেনীতে। তখন আমরা বাড়িতে ছিলাম, এই সময় থেকে অনেক কিছুই মনে করতে পারি এবং পরিস্কার ভাবেই। দাদা অসুস্থ্য হবার পরে (উনার সম্ভবত ক্যান্সার বা এমন কিছু হয়েছিল, মুখ দিয়ে রক্ত বমি করছিলেন, তখন অনেক রোগের কথা অনেকেই জানত না) উনাকে হাস্পাতালে ডাক্তারের কাছে নেয়ার আয়োজন করছিলেন আমার চাচারা, কিন্তু ১৫ আগস্টের ঘটনায় উনাকে নেয়া যায় নাই। ১৫ আগষ্টে ফেনীতে মানুষ আনন্দ মিছিল করছিলো, মিষ্টি খেয়েছিল, লোকমুখে অনেক আনন্দ স্লোগান এখনো আমার মনে আছে। মানুষ কেন এত খুশি হয়েছিল, তা এখন বুঝি, তার অপশাসনে মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল।

এর আগে গ্রামে মানুষ কেমন অভাবে ছিলো তাও আমার মনে আছে, গ্রামের মানুষ মুলত সেই সময়ে কচুর পাতা, আগা ডগা খেতে শুরু করছিলো, নানান লতাপাতা রান্না হত, আমি নিজেও মনে করতে পারি, ভাতের মাড় নেয়ার জন্য পাশের বাড়ি থেকে লোক আসত, যেন ফেলে দেয়া না হয়। আমাদেরও অভাব ছিলো, আমার দাদী, মা, চাচাদের ও ফুফুদের দুইবেলা খেতে দেখেছি, তাও পরিমানে কম, পুকুরে জিয়ল মাছ ছিলো বলে রক্ষা, স্কুল কলেজে যাবার আগে আমার দুইচাচা সেই ছোট পকুরে নেমে কৈই টাকি বাইম শিং মাছ ধরত, তাই রান্না হত, তরকারীতে লবন হত না মানে দেয়া হত না কারন লবন নাকি অনেক দাম ছিলো, মশলাপাতি ধনীরা ছাড়া কেহ কিনতে পারত না। এমন অনেক কথা এখনো মনে পড়ে, এবং এখন বুঝি কি দুঃসময় মানুষ কাটিয়েছিল সেই সময়ে।
৭৫ (এর আগেও ছিলো) পরবর্তি বছর গুলোতেও চুরি ডাকাতি তো নিত্য রাতের ব্যাপার ছিলো, প্রায় প্রতিরাতে বাড়িতে চোর ডাকাত পড়ত (হয়ত মানুষ অভাবেই এই কাজ করত), দাদী আমাদের রাতে জোরে জোরে উচুস্বরে কোরান পড়তে বলতেন, আমাদের দাদাদাদী পুরাতন বাড়ি ছেড়ে নুতন বাড়িতে (সামনেই) এসেছিলেন, ফলে আমাদের রাত গুলো বেশী ভয়ংকর ছিলো। প্রতিদিন বাড়িতে চোর আসত, হিং কেটে প্রবেশের চেষ্টা করত, দুই একবার সফল হয়েছিল। তবে একবার আমাদের বাড়িতে ডাকাত প্রবেশ করে, সেই রাতে আমাদের প্রায় সব কিছু নিয়ে যায়, আমি এখনো একজন ডাকাতের মুখ কল্পনা করতে পারি, কারন ডাকাতেরা আমার আম্মাকে জিম্মি করে নানান অশ্লীল কথা বলেই যাচ্ছিলো (কথা গুলো এখনো ভুলতে পারি না), উনাকে হাতপা বেঁধে বাড়ির বাইরে নেয়ার কথা বলছিলো, যাতে কোথায় কি আছে তিনি যেন সব বলে দেন। যে ডাকাতের চেহারা আমার চোখে এখনো ভাসে, তার মুখে বসন্তের ছোট ছোট দাগ ছিলো, লুঙ্গি ভাঁজ করে হাটুর উপরে পট্টি দেয়া ছিলো, হাতে ছোট ছোরা (তখন এটাকে ড্যাগার বলা হত বলে মনে পড়ছে) এবং একটা টচ লাইট ছিলো, যা এখনো চোখে ভাসে।
যাই হোক, এর পরে বাবা আমাদের ঢাকা নিয়ে আসেন, আমি যতদুর দেখেছি বা এখন বুঝি, আমার মায়ের পরার মত তিন্টে কাপড় ছিলো, যার দুইটা নিত্য ব্যবহারের এবং একটা কোথায় বেড়াতে গেলে, ডাকাতেরা আমাদের দাদী, মা, চাচীদের সব কাপড়ও নিয়ে গিয়েছিলো। সেই এক কাপড় পরেই আমাদের মায়ের ঢাকা যাত্রা ছিলো।
আর একটা ঘটনা ভুলে যাচ্ছিলাম, সাল মনে নেই, ৭৩/৭৪ হতে পারে, গ্রামের পর গ্রাম 'কলেরা'য় উজাড় হয়ে যাচ্ছিলো, অনেক নারী পুরুষ আমাদের গ্রামেও অনেকে মারা যান, অনেকটা 'করোনা' টাইপের মহামারী ছিলো। আলিঝালি মনে আছে, এই রোগ কারো হলে বার বার পাতলা পায়খানা হত এবং এভাবেই প্রাণ চলে যেত, যা হয়ত এখন ডায়রিয়া নামে পরিচিত, অনেকে এই রোগকে চেয়াচ্চে মনে করত, যে বাড়িতে হত সেই বাড়িতে কাউকে যেতে দেয়া হত না। আমাদের গ্রামের শেষের দিকে অনেকে মারা পড়েন, আমাদের বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হত না, এবং রাত হলেই দোয়া কলমা উচুস্বরে পড়ানো হত, যাতে এই রোগ আমাদের বাড়িতে না আসতে পারে। এই মহামারীর কি যেন একটা আলাদা নাম ছিলো, যা এখন মনে করতে পারছি না।
যাই বলেন বা এই প্রজন্ম হয়ত এমন সব ঘটনা না দেখার কারনে বা বই পত্রে না থাকার কারনে, জানে না বা বুঝে না। জাতি হিসাবে আমাদের গড় স্মৃতি শক্তিও তেমন ভাল নয়, গতকালের ঘটনাই আমরা মনে রাখি না! কিছু ময়মুরুব্বী আবার সত্য বলতে চান না, কারন তারা হয়ত কোন সময়ে কোন দল বা রাষ্ট্র থেকে লাভবান হয়েছেন বা এই সব প্রকাশে লজ্জা পান। মোদ্দাকথা সত্য সত্যই, শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢেকে রাখা যায় না, রান্নার পরে মাছ উঁকি মেরেই ফেলে। আমাদের প্রজন্ম অনেক কিছুর সাক্ষী (যাদের বয়স এখন ৬০ এর কোঠায়), অনেকে বলি বলি করেও পরপারে চলে যাচ্ছেন, আমি না হয় আজ কিছু বলেই দিলাম।
রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য শাসক দরকার, অন্তত যেন কিছুটা হলেও জনগনকে বুঝতে পারেন, মানুষ সকলেই মিথ্যাবাদী নয় বা মিথ্যা শুনে শুনে খামোশ থাকলেও এক সময়ে রাস্তায় নেমেই পড়েন (এরশাদের পতনও দেখেছি) কিংবা বিধাতা যে কোন একটা পথ বের করেই দেন। শেখ হাসিনার পরিনতিও তেমন, তিনি কখনোই যোগ্য দেশ প্রধান ছিলেন না, তার অপশাসনের কথা হয়ত কেহ না কেহ প্রকাশ করবেই। আমার ধারনা শেখ হাসিনার মত নিন্মজ্ঞান নিয়ে হয়ত সামনে আর কেহ দেশ পরিচালনা করার সুযোগই পাবে না, যদিও কোন জাতির কপালে কি লেখা তাও বিধাতাই জানেন!
নয়াপল্টন থেকে, ব্লগের জন্য লেখা, ১৭ আগষ্ট ২০২৫ইং।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৪:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


