সকাল থেকে আকাশটা মুখভার করে আছে হয়ত আমাকে বর্ষার আগমনী জানান দিতেই।চলমান শত ব্যস্ততার ফাক গলে এই বর্ষা আমাকে নিয়ত টেনে নিয়ে যায় পিছন পানে।যেখানে পড়ে আছে আমার নাড়ীছেড়া স্মৃতিরা।সেইসব টুকরো টুকরো বহমান ঘটনারা যেন সেলুলয়েডের পাতায় ধারণ করা চিত্র, একটার পর একটা অবলীলাক্রমে বয়ে যেতে থাকে আমার সম্মুখপটে।যেন তারা আজও জীবন্ত আর সেখানে রয়েছে আমার সতত উপস্থিতি।
বর্ষা এলে চারিদিকে থৈ থৈ পানির মাঝে দ্বীপের মত দাড়িয়ে থাকত আমার নানাবারড়ির পাড়াখানি।যতদূর চোখ যেত শীতল বাতাসে ঢেউ খেলানো পানিতে ধান গাছের বিস্তীর্ণ সবুজ আর মাথার উপর সাদা মেঘপরীদের মেলা ।ঘাটে ঘাটে গাছে গাছে নৌকা বাধা।গোয়ালের গরুগুলি কি মনে করে যেন খাবারে মুখ দিতে ভুলে দূর পানে থাকত চেয়ে।পাড়ার ব্যস্ততম মানুষগুলি হঠাত করেই হয়ে পড়ত কর্মহীন।এখানে সেখানে বসে কাটাত অলস সময়।বাচ্চারা দিনের বেশিরভাগ সময় পানিতে তাদের গাত্রোধানে ব্যস্ত সময় কাটাত।হাসেরা যেন তখন পৃথিবীর অন্যতম সুখী প্রাণী সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মনের আনন্দে পানি কেটে বেড়াত।।
এইত সেদিনের কথা।ক্লাস থ্রীতে পড়ি।এমনি এক বর্ষারদিনে বড়মামার হাত ধরে নানুবাড়ি এসেছি।(আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতিরা এই এখানে জন্ম নিয়েছে,লালিত পালিত হয়েছে,একটু একটু করে কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পদার্পিত হয়েছে কারণ আমি এবাড়ির প্রথম ও সবচেয়ে আদুরে নাতনী))।মা সাথে নেই বলে যখন তখন সবার চোখ ফাকি দিয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে পানিতে নেমে যাচ্ছি।তখনো সাতার জানিনা।নৌকার গলুই ধরে,পাড়ে হেলে পড়া গাছের ডাল ধরে সাতারের ভান করি।আর অবাক হয়ে দেখি আমার চেয়ে পিচ্চিরা কিভাবে সাতরিয়ে দূর দূর চলে যাচ্ছে!!ওপাড়ার মালতী বুদ্ধি দিল ,"একটা কলস নিয়ে এলে তুইও ঠিক সাতার পারবি।"
যেমন বুদ্ধি তেমন কাজ।আমিও যথারীতি একটা কলস চুপি চুপি নিয়ে এলাম।মালতী দেখিয়ে দিল কি করে বাতাস ভর্তি কলস চট করে পানিতে উল্টিয়ে নিয়ে তাই দিয়ে নিশ্চিন্তে সাতার কাটা যায়।
বাহ!! সাতার কাটা তো ভারী সহজ !!আমিও কলস উল্টিয়ে তাতে ভর দিয়ে ভেসে চললাম।যখন মধ্য পুকুরের কাছাকাছি চলে এসেছি হঠাত কি করে যেন কলসটা কাত হয়ে তার কিছুটা বাতাস বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল।আর বিপত্তিটুকুও ঠিক তখনি ঘটে বসল।হাতের কলস ক্রমশ ভারী হয়ে নীচের দিকে নেমে যেতে লাগল সেই সাথে সে আমাকে টেনে নিতে চাইল জলের গভীরে।অসহায় আমি হাসপাশ করতে করতে হারিয়ে যাচ্ছি।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।শরীরের সমস্ত রক্ত যেন চোখ দিয়ে বেড়িয়ে বন্যার পানিতে ভেসে যেতে চাইছে।আমি বাচার জন্যে ছটফট ছটফট করছি।আমি মারা যাচ্ছি।অথচ আমাকে দেখছেনা।কারও কোন খবর নেই।আমার চারিপাশের বন্ধুবান্ধব সবাই তখন ঝাপুড়ি খেলায় ব্যস্ত।কেন যেন মাকেই খুব বেশি মনে পড়তে লাগল।
ঠিক তক্ষুনি কে যেন আমার হাত ধরে টেনে তোলে।আমার সমস্ত শরীর হাল্কা হয়ে ্পানির উপর ভেসে উঠল।মধ্য দুপুরের সূর্যের সোনালী আলো আমার বন্ধ চোখের উপর চিক চিক করে উঠল। হঠাত করেই জ্ঞান হারালাম।যখন হুশ হল দখি আমি বিছানায় শোয়া আমার চারিপাশে আমার নানু,মামা,খালা,আমার সকল ছোট্ট ছোট্ট বন্ধুবান্ধবেরা জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি নতুন জীবনের স্বাদ পেলাম।নানুর চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।পরে শুনেছিলাম বড়মামা সেই সময় পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।তিনিই হঠাত খেয়াল করেন আমি ডুবে যাচ্ছি।এবং কলসসহ তিনিই আমায় উদ্ধার করেন এই মামাই আমাকে হাত ধরে সাতার কাটা শিখিয়ে দেন।
তারপর কতদিন পানিতে গা ভিজিয়েছি,মধ্যপুকুরে ঝাপুড়ি খেলেছি,গাছের মগডালে চড়ে পানিতে ঝাপিয়ে পড়েছি,ডুবসাতারে পুকুরের এপার থেকে ওপার ছুয়েছি, জোতস্ন্যা রাতে নৌকা ছেড়ে দূরে হারিয়ে গেছি,শাপলা শালুক কুড়িয়ে আচল ভরেছি।
আজ কতটা বছর পেরিয়ে গেছে।পড়ালেখা শিখে পুরাদস্তুর শহুরে বনে গেছি।কতদিন গ্রামের বাড়ি যাইনা।আমাকে পাগল করা সেই বর্ষার প্লাবন ছুয়ে দেখিনা।নানু আজও আমাকে দেখার জন্যে ছটফট করে।প্রায়ই তার কাপা কাপা গলায় ফোনে বলে,"বু-রে বাড়ি আয়।কতদিন তোর মুখটা দেখিনা"।
আমিও প্রতিবার কথা দেই,এইত এবার ছুটি পেলে ঠিক তোমাকে দেখে যাব।প্রতিবার ছুটি আসে আবার ফুরিয়েও যায়।কিন্তু এই আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনা।।
আজকের এই ভোরেও নানু আমায় নিমন্ত্রণ জানিয়েছে তাকে দেখবার জন্যে।আমি কথা দিয়েছি এবারে বাড়ির কাছে বন্যার পানি এলেই ঠিক ছুট লাগাবো তোমায় দেখার জন্যে।হিসেব করে দেখেছি রোযার বন্ধে চারিদিকে থৈ থৈ পানি থাকবে।আমি ঠিক তখন বাড়ি যাব।কিন্তু ততদিন আমার হারিয়ে যাওয়া সকল শিকড়ের মাঝে একমাত্র শিকড় আমার আদি রক্তের বাহক এই বুড়ো মানুষটা আমায় ঠিক বরণ করে নেবেতো??
নানু তুমি সুস্থ থেকো।আমি কথা দিলাম,এবারের বন্যায় আমি ঠিক তোমায় দেখতে আসব।।
আলোচিত ব্লগ
ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট
আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন
ল অব অ্যাট্রাকশন
জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
চরফ্যাশন
নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।
প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
কর কাজ নাহি লাজ
রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।
হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?
নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন
নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?
১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন