গল্প: ১
সাইফুর রহমান গেলেন বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হেড অফিস যে কত বড় তা আপনারা যারা ওখানে এখনো যাননি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না। তো হাঁটতে হাঁটতে তিনি একটা রুমের ভেতরে ঢুকলেন। সুবিশাল মনোরম পরিবেশের রুমটি দেখে তিনি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন এ রুমটি কার অধিনে? একজন ভদ্রলোক বললেন স্যার এটাতে আমি বসি। সাইফুর রহমান আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস তোমার কাজ কি? ভদ্রলোক বললেন স্যার আমি একজন ডাইরেক্টর (অথবা এ টাইপের কোন পোস্ট)।
সাইফুর রহমান ক্ষেপে গেলেন। রাগত স্বরে সবাইকে বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডাইরেক্টর কি এমন কাজ করেন যে তার রুম প্রধানমন্ত্রীর রুমের চেয়েও বড়। তার রুমে ক্যানো বড় বড় ৪টা এসি থাকবে? এই সুবিশাল, মনোরম, ব্যায়বহুল রুম তো তার প্রয়োজন নেই। রাস্ট্রের টাকা পয়সা এমন অপরিমিতভাবে খরচ করার অধিকার কারো নেই।
সবাইকে বললেন আমরা যদি রাস্ট্রের খরচ কমিয়ে না আনি তাহলে কে করবে??
গল্প: ২
সাইফুর রহমান সাহেবকে সিলেটে একটা সম্বর্ধনা দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। তিনি তো যাবেন না। শত অনুরোধের পরে তিনি গেলেন সেখানে। প্রধান অথিতির বক্তব্যে তিনি ডায়াসে দাঁড়িয়ে বললেন। "আমি সাধারনত সম্বর্ধনা টম্বর্ধনা নেই না। কারন এ ধরনের অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো যাকে সম্বর্ধনা দেয়া হয় তার স্তুতি গাওয়া হয়। তার নামে অতিরিক্ত প্রসংশা করা হয় এবং সবশেষে কিছু দাবী দাওয়া উত্থাপন করা হয়। তারপর প্রশংসিত ব্যাক্তিকে সেইসব দাবী দাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিতে হয় তা তার সাধ্যের ভেতরে থাকুক বা না থাকুক।
সবাই কেমন জানি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কথা এক বিন্দুও মিথ্যা নয়। তারপর সবাইকে বললেন দাবী দাওয়া আপনারা আপনাদের জনপ্রতিনিী হিসেবে অবশ্য আমার কাছে উত্থাপন করবেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু সজন্য আমাকে সম্বর্ধনা দিতে হবে না।
সাইফুর রহমানের শুদ্ধভাষা বিড়ম্বনা
সাইফুর রহমান অত্যন্ত অনন্য উপায়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। এমনরূপ শুদ্ধ বাংলাদেশে সম্ভবত আর কেউ বলেন না। সাধু ও চলিত ভাষার এক অপূর্ব মিশ্রন। আপনার যতোই মন খারাপ থাকুক না ক্যানো তার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শুনলে আপনি হাসতে বাধ্য হবেন। আমাদের কাছে এটা ছিলো যাদুকরী ভাষা। সাইফুর রহমান জানতেন তার ভাষা দূর্বলতার বিষয়ে। কিন্তু খুব গুরুত্ব দিতেন না, কারন তার হাতে হাজারো কাজ। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সাস্টেইনেবল করার জন্য এ মানুষটি নিরন্তর কাজ করে গেছেন। তাই দেখা যায় বিএনপি যখনি বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে তখনি বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ব, বেড়েছে রপ্তানী আয়, শেয়ার বাজার হয়েছে মুখর, মানুষের আয় বেড়েছে, গরীব দুঃখী মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে এবং সর্বোপরি সরকারেও ছিলো তৃপ্তি।
আমরা সাইফুর রহমানের বক্তব্য টিভিতে কিংবা সরাসরি দেখার সুযোগ মিস করতাম না কখনোই। টিভিতে সাইফুর রহমানকে দেখালে, মেসের সবাইকে ডাকা হতো। তারপর উনার মুখে আমদিগকে, তোমাদিগকে ইত্যাদি সাধু-চলিতের মিশ্রনে কথা শুনে মজাপেতাম। তারপর মেসে সাধু চলিতের মিশ্রনে কথা বলার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়ে গেলো।
জন্মভূমির প্রতি অনন্য ভালোবাসা
বাংলাদেশের এতো বড় মাপের একজন ব্যাক্তি এতো নিরহংকারী ছিলেন তা ভাবতেই অবাক হয়ে যাই। সাইফুর রহমান ছিলেন নিরহংকারী এক মাটির মানুষ। মাটির মানুষ বলতে আসলেই যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন। সত্য বলতে কখনো লজ্জা পেতেননা। সত্য যতই তিতা হোক না কেনো তিনি তা অবলীলায় বলতে পারতেন। আমি এই মানুষটাকে যখন প্রথম সরাসরি দেখি তখন তার মুখে একটা অমলিন হাসি ছিলো। সেই অমলিন হাসির মানুষটাকে আমি কোনদিনও ভুলতে পারিনি, ভুলবোনা।
বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার। সিলেটের মাটি ও মানুষের নেতা। আপামর জনগনের হৃদয়ের মনি সাইফুর রহমান শেষ জিবনে মৃত্যুর কথা খুবই স্মরণ করতেন। মৃত্যুর ঠিক পূর্ব দিনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন " আমার জীবনে চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। সবই পেয়েছি, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, সম্মান পেয়েছি, রাস্ট্রের গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পেয়েছি, দেশ বিদেশে যশ-খ্যাতি পেয়েছি। একজন মানুষের জিবনে এর চেয়ে বেশী কি আর চওয়া পাওয়ার থাকতে পারে? এখন শুধু মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে একটাই চাওয়া বাবা শাহজালালের দেশ সিলেটে জন্মেছি এই সুরমা নদীর তীরে সিলেটের পূন্যভূমিতেই যেন মরন হয়।"
আমি অবাক হয়ে যাই একজন মানুষ তার জন্মভূমির ব্যাপারে কতটা অবসেসড হলে এমন প্রার্থনা করতে পারে! কতটা ভালোবাসা থাকলে এমন করে বলতে পারে "এ মাটিতেই যেনো মরতে চাই।" সাদামাটা মহৎ হৃদয় এম সাইফুর রহমানের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে স্মরন করছি এই নিরহংকারী মানুষটাকে। আজ মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে দোআ করি আল্লাহ যেন আপনাকে কবুল করে নেন। জান্নাতুল ফেরদাউসে যেন আপনাকে জায়গা করেন। আমিন।
[অফ টপিক: লিখতে লিখতে শেষে কেন জানি চোখটা ভিজে গেলো জানিনা। সব মানুষকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। সাইফুর রহমানের মতো আমিও প্রার্থনা করি শাহজালালের পূন্য ভুমিতেই যেন আমার শহীদি মরন হয়।]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৫৪