ব্যাংকাররা সমাজে হিংসার পাত্র, কারণ তারা মোটা অঙ্কের বেতন পান। কিন্তু ব্যাংকারদের পেইনগুলো যদি সাধারণ মানুষ জানতো, তাহলে একটু হলেও সহানুভূতি প্রকাশ হয়তো করতো।
আসুন একটা লিস্টি করি পেইনগুলোর:
১. সপ্তাহে ৫দিন সকাল ৯:৩০ এ উপস্থিত হতে হবে। ট্রাফিক জ্যাম, ভিআইপি জ্যাম, রোদ বৃষ্টি, গাড়ি নষ্ট, অসু্স্থতা, বাচ্চার অসুস্থতা, ব্যক্তিগত কাজ, যাই থাক না কেন, এক মিনিট লেট করার জো নাই। যদি কোন কারণে দু’এক মিনিট লেট হয়ে যায় তাহলে লাল কালি। তিন দিন লাল কালি পড়লে এক দিনের বেতন কাটা।
২. কোন কোন অভাগার ক্ষেত্রে সপ্তাহে ৬দিন, এমনকি ৭দিনও অফিস। এই অধমই মাসে ৩০দিন অফিস করেছে একাধিকবার।
৩. অফিসে কেতাদুরস্ত হয়ে থাকতে হবে। আপনার মানসিক আর শারীরিক অবস্থা যাই হোক না কেন, হাসিমুখে গ্রাহকের সাথে কথা বলতে হবে।
৪. বিজনেস পারফরম্যান্স দেখাতে হবে। কাসা(কারেন্ট-সেভিংস) গ্রাহক যোগাড় করতে হবে। ক্রেডিট কার্ড আর ডেবিট কার্ড এর গ্রাহক যোগাড় করতে হবে।উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডিপোজিট আনতে হবে। ইদানিং আবার নতুন ত্যানা প্যাচানো হয়েছে, এনপিএল রিকভারি করতে হবে।
৫. অফিসে নিজের কাজ তো করতেই হবে, অন্যের কাজের প্রতিও সন্দিহান দৃষ্টি রাখতে হবে। ‘লাভ অল, ট্রাস্ট নান’-এই নীতি মেনে চলতে হবে।
৬. ব্যাংকিং ডিপ্লোমা নামক যুক্তিহীন পরীক্ষা পাস করতে হবে। কারো ক্ষেত্রে এমবিএ করতে হবে, যেগুলোর ক্লাস পরীক্ষা সাধারণত: রাতে হয়। ৯-১০ ঘন্টা অফিস করে আবার ৩ঘন্টা ক্লাস, বুঝুন অবস্থা।
৭. যারা একটু উচ্চাভিলাষী, তাদের প্রফেশনাল ডিগ্রী নিতে হবে। সিএফএ, আইসিএমএ, সিমা, এসিসিএ, সিডিসিএস, সিএসডিজি, সিআইটিএফ, নানা ধরনের ট্রেনিং...এই লিস্টিটা আরো লম্বা হতে পারে। এগুলো কোনটাই সহজলভ্য নয়।
৮. এত কিছু করতে গিয়ে পরিবারকে সময় দেয়া দুরুহ হয়ে পড়ে। নানাবিধ সম্পর্কের টানাপোড়েন জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
৯. আছে ট্রান্সফার নামক বিভীষিকা। ৩বছর পরপর ট্রান্সফার। নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষের সাথে এ্যাডজাস্ট করার চ্যালেঞ্জ।
১০. এরপর আছে ’উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’র যন্ত্রণা। একজন কোন একটা অন্যায় করেছে, তার ভার এসে পড়ে সব সহকর্মীর ওপর। সেই সহকর্মীকে বিশ্বাস করে হয়তো একটা কাজ করেছেন আপনি, এখন উনি চুরি করেছেন, ৩বছর আগে করা সেই কাজের কৈফিয়ত তলব করবে ব্যাংক। ততদিনে হয়তো আপনার কর্মস্থল, দায়িত্ব সবই পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাতে কি, দায় এড়াতে পারবেন না আপনি।
১১. ম্যানেজারদের তো শাঁখের করাত ফেইস করতে হয়। ব্যবসা বাড়াতে হবে, সেটা আবার নিয়মের মধ্যে থেকে। অতি উৎসাহ দেখিয়ে ব্যাংকের ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন অনেক ম্যানেজার। ভাল ব্যবসা, ভাল সম্পত্তি দেখে লোন দিয়েছেন অনেক ম্যানেজার, গ্রাহকের অদক্ষতার কারণে ব্যবসা নষ্ট হয়েছে, লোন খারাপ হয়ে গিয়েছে, দায় কার? কার আবার...ম্যানেজারের।
১২. আর আছে প্রত্যাশার বোঝা। পরিবারের প্রত্যাশা, সমাজের প্রত্যাশা, ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট এর প্রত্যাশা। মাঝে মাঝে বোঝাটা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
১৩. আরেক জ্বালা হলো আইন। প্রতিদিন শত আইন পরিবর্তন হচ্ছে। শত শত সার্কুলার হচ্ছে, ব্যাংকারকে সব আইন জানতে হবে, সব পরিবর্তন কমপ্লাই করতে হবে। আইন না জানা অপরাধ সব নাগরিকের জন্য, মহা অপরাধ ব্যাংকারের জন্য।
১৪. উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের (বিবি, এনবিআর, প্রশাসন, সরকারী সংস্থা, মাস্তান, মালিক)নানাবিধ অনৈতিক চাপের কথা আমরা সবাই জানি। সেই চাপের কাছে মাথা নতও করি। কিন্তু নীরবে সেগুলো সয়ে যাই। সে কথা না যায় বলা, সে জ্বালা না যায় সহা।
১৫. অডিট এর কথা বলি। ইন্টারনাল অডিট, বোর্ড অডিট, বাংলাদেশ ব্যাংক অডিট, এনবিআর ইন্সপেকশন, স্পেশাল অডিট...সারাবছর লেগেই থাকে অডিট।
১৬. আর থাকলো রিপোর্টিং। রিপোর্টিং এর লিস্টি করতে হলে দু’দিন লেগে যাবে। মান্থলি রিটার্ন, সিআইবি, আইএসএস, বাংলাদেশ ব্যাংক ড্যাশবোর্ড, নানাবিধ ম্যানেজমেন্ট রিপোর্ট, শতশত হেড অফিস রিপোর্ট, আরও কত কি। দিন যায়, রিপোর্ট এর সংখ্যা বাড়ে, কমেনা। রিপোর্ট করতে করতে ক্লান্ত হবার জো নাই, নতুন রিপোর্ট ঘাড়ে চাপে।
২০১৬ এর শুরুতে ১৬টা পয়েন্ট লিখলাম। ব্যাংকার বন্ধুরা নিশ্চিত ভাবেই আরো যোগ করবেন। যারা অব্যাংকার তারা একটু হলেও বুঝবেন নিশ্চয়ই, হ্যান্ডসাম স্যালারী নামক প্রদীপের নিচের অন্ধকার। যেসব চাকরিপ্রার্থী এই লেখাটা পড়বেন, তারা নিশ্চয়ই ব্যাংকার হতে চাইবেন না। আর কেউ যদি ‘জেনেশুনে বিষ পান’ করতে চান, তাহলে বলার নেই কিছুই।