এসেছে ভাষার মাস।
দুয়ারে কড়া নাড়ছে ২১ শে ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে আমাদের আহলাদের সীমা নেই।
ভাষা নিয়ে আমাদের নানা বাগাড়ম্বর...আমরা একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, সংগ্রাম করে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করেছে, আমাদের ভাষা সুন্দর, আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ, আরো কত কি!
আমরা আমাদের হাবে-ভাবে, কথাবার্তায় এমন নিবেদন প্রকাশ করি আমাদের ভাষার প্রতি, যেন আমরা হাসিমুখে জীবন দিয়ে দেবো ভাষার জন্য।
সত্যিই কি তাই? মোটেও নয়। এমন ভন্ডামি আমি আর দেখিনি।
এতটুকু পড়ে আমাকে বকতে শুরু করেছেন নিশ্চয়ই...।
আসুন, বাস্তবতার নিরিখে ভেবে দেখি, যে মমতা আমরা আমাদের কথায় আমাদের ভাষার প্রতি দেখাই, কাজে তার কতটুকু বাস্তবায়ন করি...।
প্রিয় বন্ধু, প্রিয় বান্ধবী, প্রিয় ভাইজান, প্রিয় আপুনি, প্রিয় মুরব্বী, প্রিয় স্নেহাস্পদ, নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন:
ইংরেজী বর্ণমালায় কয়টি বর্ণ, জানেন? কয়টি স্বরবর্ণ, কয়টি ব্যঞ্জনবর্ণ? এক নি:শ্বাসে বলতে পারবেন সবগুলো বর্ণ? তেইশতম বর্ণটি কি, জানেন? হেসে ফেললেন? মনে মনে ভাবছেন, কি সব ছেলেমানুষী প্রশ্ন করছি, তাই না?
এবার আসুন...বাংলা বর্ণমালায় কয়টি বর্ণ, জানেন? কয়টি স্বরবর্ণ, কয়টি ব্যঞ্জনবর্ণ? এক নি:শ্বাসে বলতে পারবেন সবগুলো বর্ণ? তেইশতম বর্ণটি কি, জানেন? তেত্রিশতমটি? হাসি আসছে এবারও?
ইংরেজিতে টাইপ করতে আপনি সিদ্ধহস্ত, বাংলায় টাইপিং পারেন? অভ্র নয়, বিজয়, মুনির কিংবা বিজয় বায়ান্ন?
আপনার প্রতিষ্ঠানে কোন ভাষা ব্যবহৃত হয়, বাংলা না ইংরেজি?
আপনার সন্তান কি বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়ে, না ইংলিশ মিডিয়াম?
আপনার বাসার টিভিতে কি বাংলা চ্যানেল চলে, না স্টার প্লাস?
সর্বশেষ কোন বাংলা সিনেমা দেখেছেন আপনি, কোন লেটেস্ট ইংলিশ মুভি, হিন্দি?
সবশেষে, আপনি ফেসবুকে মনের কথা প্রকাশ করেন কোন ভাষায়? বাংলায়, ইংরেজিতে নাকি ইংরেজি বর্ণে বাংলায়?
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নাম দেখুন: আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি...একটাও বাংলায় নয়। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদানের মাধ্যম ইংরেজী, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর নাম পুলিশ, এমনকি আমাদের ভাষার যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তারও নাম বাংলা একাডেমী...বুঝুন অবস্থা...।
আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য, আমরা সর্বশক্তিমানের কাছে করুণা যাচি, সেটাও অন্যের ভাষায়।
শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারীতে প্রভাতফেরীতে গেলে, একবেলা শহীদ মিনারে ফুল দিলে, বড় বাগাড়ম্বর করলে ভাষাকে ভালোবাসা হয়না...।
ভাষাকে সঠিক মর্যাদা দিতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
এই দেশে নানা আন্দোলন হয়, আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাঙালীর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু কই, “বাংলাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হোক”-এই দাবি তো শোনা যায়না...এটা নিয়ে তো আন্দোলন হয়না, কেন, কেন, কেন???
জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষা: আরবী, চায়না ম্যান্ডারিন, ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান আর স্প্যানিশ। ভাষাভাষীর সংখ্যা বিচারে বাংলা ভাষার অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। কই, কেউ তো দাবী তোলেনা, “বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হোক”...। কেন?
আমি অবশ্য আপনাকে খুব বেশী কিছু করতে বলছিনা, ছোট্ট একটা অনুরোধ: বাংলা ভাষাকে প্রাপ্য সম্মানটা দিন। জীবনের প্রতিক্ষেত্রে আরো বেশী বাংলা ভাষা ব্যবহার করুন, জেনে বুঝে অন্য ভাষাকে নিজের মায়ের ভাষার ওপর প্রাধান্য দেবেন না।
তাই বলে আমি বলছি না, অন্যের ভাষা শেখার দরকার নেই, নিজেরটা ভালো করে শিখুন, তারপর অন্যেরটা। পরিপূর্ণ ভাবে নিজের ভাষা না শিখলে অন্যের ভাষা শেখার কোন অর্থ হয়না। কাক ময়ূরের পেখম লাগাতে পারে, ময়ূর হতে পারেনা।
সবাইকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগাম শুভেচ্ছা।