somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"স্বর্গ হবে মোল্লা পাদরী আচার্যদের “দাড়ী-স্থান”?"---ওমর খৈয়াম ও রুবাইয়াৎ

০১ লা মে, ২০১৬ দুপুর ২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আবার যখন মিলবে হেথায় শরাব সাকির আঞ্জামে,
হে বন্ধুদল, একটি ফোটা অশ্রু ফেলো মোর নামে।
চক্রাকারে পাত্র ঘুরে আসবে যখন সাকীর পাশ,
পেয়ালা একটি উল্টে দিয়ো স্মরণ করে খৈয়ামে।

কিছুকিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে লেখার জন্য হাত খুদবুদ করে, মন চঞ্চল হয়। মনে হয় কিছু একটা করা উচিৎ, জানানো উচিৎ সব্বাইকে- যা ভাবছি আমি, করছি যা অনুভব। তা যে সমকালীন বিষয় নয়, সেটা বলাটা বাতুলতা। সমকালীন বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে, দেশ আর সমাজ নিয়ে বলতে হলে, কয়েকটা বই লেখা যায় অনায়াসে [মিছে কথা!]। “বর্তমান সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বাঁচতে হলে এই এই করতে হবে” বললেই হয়ে যায়। কিন্তু যে বিষয় নিয়ে মন হয় উচাটন, অকারণ, তা তো এতো সহজ নয়! পড়তে হয় বিস্তর- অন্তত যেটা নিয়ে বলতে চাচ্ছি সেটা, বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী কী বলেছেন- তাদের মূল্যায়নটা কেমন, আমি যা ভাবছি সেটা কতোটা সঠিক- ইত্যাদি মেলা ফ্যাঁকড়া এসে যায়। কিন্তু এতো ধৈর্য আমার কোথায়? কোথায় এতো প্রজ্ঞা? খুব জোর বাতাসে সিগারেট ধরালে যেমন সে সিগারেটের আয়ু অর্ধেক হয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় নিমেষেই; আমার আগ্রহও তেমন, হালকা কোন ধাক্কাতেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না, হারিয়ে যায়।
কোথায় যেন পড়েছি, রবি ঠাকুর ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনা করতেন ঘণ্টা দুয়েক, তারপর পড়া! (আপনি এই ফাঁকে ভেবে নিন, ছাত্র জীবন শেষ হওয়ার পর, কতদিন পড়েছেন নিয়মিত। চাকরির জন্য গাইড মুখস্তের কথা হচ্ছে না) একদম স্কুল ছাত্রের মতো ছটা থেকে দশটা, তারপর জলখাবারের বিরতি কয়েক মিনিট। আবার পড়াশুনা বারোটা পর্যন্ত। তারপর কাজ। দুপুরে ভাতঘুম দিয়েছেন তিনি কোনোদিন, একথা রবীন্দ্রবিরোধী কবিকুল তো দূরের কথা, তার কট্টর সমালোচক আহমদ শরীফও বলতে পারবেন না। সন্ধ্যায় গান শেখাতেন ছেলেপেলেদের, শান্তিনিকেতনের। তারপর আবার পড়া, মাঝেমাঝে গুনগুন করে গান গাওয়া, লেখা আর সুর করা-রাত এগারোটা পর্যন্ত! মাঝেমাঝে ভাবি, তিনি বাইজীবাড়ি যাননি, মদ্য পান করেননি সারারাত, মাস্তি করেননি কারও সাথে, তবুও কেন লিখেছেন, “কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে!”
আমাদের স্যারেরা কি আর সাধে বলে যে লেখাপড়ার বিকল্প নেই! লেখাপড়া করলে রবি ঠাকুরও হওয়া যায়, চাই কি বগলদাবা করে নোবেলটাও নিয়ে এসে সাজিয়ে রাখা যায় ঘরে!
যাই হোক, এসব কথার সারকথা হচ্ছে এই যে, আমি পরিশ্রমী কেউ নই, মোটেও। আমিও আপনাদের মতো পড়ি খুব কম। তাই পরিশ্রমহীন এই লেখা পড়াটাও পণ্ডশ্রম! তাহলে লিখছি কেন? ঐ যে বললাম- হাত খুদবুদ করে!

সুন্দরীদের তনুর তীর্থে এই যে ভ্রমণ, শরাব পান
ভণ্ডদের ঐ বুজ্‌রুকি কি হয় কখনো তার সমান?
প্রেমিক এবং পান-পিয়াসী এরাই যদি যায় নরক
স্বর্গ হবে মোল্লা পাদরী আচার্যদের “দাড়ী-স্থান”!

আমরা যারা আধুনিক কবিতা পড়ি, শাব্দিক অর্থের চেয়ে যারা ভাবার্থকেই গুরুত্ব দেই বেশি কবিতায় কিংবা যারা কবিতাকে রাখতে চাই সমাজ, রাজনীতি থেকে দূরে, অন্তরালে- তাদের কাছে উপরের কয়েকটি লাইন একটু বেখাপ্পা লাগতে পারে। মনে হতে পারে ব্যাকডেটেড, পুরনো ধাঁচের। হ্যাঁ পুরনোই তো বটেই- আসলে এটা কয়েকশো বছর আগে রচিত ওমর খৈয়ামের দ্বারা আর এটার অনুবাদক হুমায়ূন আজাদের ভাষায় “মধ্যমানের কবি”(? এবং !) কাজী নজরুল। মধ্যযুগের কবিতা, অথচ এখনো কতোটা প্রযোজ্য আমাদের সমাজের জন্য! ব্যাকডেটেড, কিন্তু এক্সপেয়ার ডেট পার হয়নি এখনো- অন্তত আমাদের সমাজে, আমাদের দেশে!
হ্যাঁ, বলতে চাইছি রুবাঈ নিয়েই। রুবাঈ শব্দটার সাথে পরিচিত না হলে বলি, রুবাঈ হলো চার লাইনের কবিতা, যার প্রথম দুই লাইন ও চতুর্থ লাইনের মধ্যে অন্ত্যমিল থাকে, কিন্তু তৃতীয় লাইন অন্ত্যমিল ছাড়া। যেমন-
দেখতে পাবে যেথায় তুমি গোলাপ লাল ফুলের ভিড়
জেনো, সেথায় ঝরেছিল কোনো শাহানশা’র রুধির।
নার্গিস আর গুল-বনোসা’র দেখবে যেথায় সুনীল দল,
ঘুমিয়ে আছে সেথায়- গালে তিল ছিল যে সুন্দরীর।

এখানে লক্ষ্য করা যায় ককগক। মানে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে অন্ত্যমিল। একারণেই নিচের কবিতাটি একটি সুন্দর কবিতা চার লাইনের, কিন্তু রুবাঈ নয়-
কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই বলে ডাকো যদি, দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা;
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা।। (রবীন্দ্রনাথ)
কিন্তু অনুবাদের সময় অনেক অনুবাদকই এই স্ট্রাকচার মানেননি। বিশেষত বাংলা অনুবাদের সময়। খৈয়ামের একটি বিখ্যাত রুবাঈয়ের অনুবাদ কান্তি ঘোষ করেছিলেন এভাবে-
সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে, ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর-
সেই তো সখি স্বপ্ন আমার, সেই বনানী স্বর্গপূর।

একই রুবাঈয়েরে আরেকটি ভার্সন এমন-
এইখানে এই তরুতলে, তুমি আমি কৌতহলে
এ জীবনের আর কটাদিন, কাটিয়ে দিব প্রিয়ে
সংগে রবে সুরার পাত্র, একটু খানি আহার মাত্র,
আর একখানি ছন্দমধুর কাব্য হাতে নিযে।

এই একই রুবাঈয়ের অনুবাদ নজরুল করেছেন এভাবে-
এক সোরাহি সূরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর
প্রিয়া সাকী, তাহার সনে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ,
এই যদি পাই চাইবো নাকো তখৎ আমি শাহানশার!

অনুবাদের সময় নজরুল রুবাঈয়াতের সকল ধর্ম মেনে নিয়েই তর্জমা করেছেন, যেটা অন্যান্য অনুবাদকের কাছে পাওয়া যায় না। উপরের কান্তি ঘোষের অনুবাদটা সুপাঠ্য, সুন্দর এবং কিউট! কিন্তু ওমর খৈয়ামের ভেতরের যে তেজ, যে আগুন, খৈয়ামের যে নিয়ম না মানার প্রবণতা, সেগুলো একমাত্র কাজীর অনুবাদের পাওয়া যায়। হাজার হলেও দুজনই এক গোয়ালের! তিনি নিজেই বলেছেন- “ওমরের রুবাঈয়াতের সবচেয়ে বড় জিনিস তার প্রকাশ ভঙ্গি বা ঢং। ওমর আগাগোড়া মাতালের ‘পোজ’ নিয়ে তাঁর রুবাঈ লিখে গেছেন-মাতালের মতোই ভাষা, ভাব, ভঙ্গি, শ্লেষ, রসিকতা, হাসি কান্না-সব। .........আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি- ওমরের সেই ঢংটির মর্যাদা রাখতে, তাঁর প্রকাশ প্রকাশভঙ্গির যতটা পারি কায়দায় আনতে। কতদূর সফল হয়েছি তা ফার্সি-নিবিশেরাই বলবেন”।
এজন্যই সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন-
“ওমরই ওমরের সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লিনাথ, কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।”
অবশ্যি কান্তি ঘোষের অনুবাদের খুব প্রশংসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছিলেন কান্তি ঘোষকে-
“কবিতা লাজুক বঁধুর মতো এক এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আনতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙ্গেচ, তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে”।
কিন্তু আমার রুবাঈয়াতকে ঠিক লাজুক বঁধু মনে হয় না। কবিতার জগতে ওমরের রুবাইয়াৎ যেন ছেড়ে দেয়া ভগবানের পাঁঠা। সে তেজী, গোঁয়ার, অবাধ্য- তাকে আটকে রাখা যায় না। কিন্তু কান্তি ঘোষ বাংলায় অনুবাদ করে সেই পাঁঠাকে খাসি করে দিয়েছেন! মদ খেয়ে যদি বাওয়ালই না করলাম তবে আর মদ খাওয়া কেন?
আর রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা সম্পর্কে বলতে বলা যায়, তিনি সবার পিঠ চাপড়ে দিতেন চোখ বন্ধ করে। মাঝমাঝে মনে হয়, কেউ যদি “তোমার বুকের মধ্যে ফুল/ তোমার কি সুন্দর চুল/ তোমার কানে একটা দুল/ আমি পুরাই মশগুল” টাইপ কবিতাও সমালোচনার জন্য পাঠাতেন তার কাছে, তিনি হয়তো লিখে দিতেন –“তোমার কাব্যখানা পড়লুম। পড়ে সে রস পেলুম তা বাংলা কাব্যের ভাড়ারে একেবারে নতুন। নবীন এর স্বাদ, অপরিচিত এই সুর, আনকোরা এর ভাষা। বাংলা কাব্যের জগতকে যদি একখানা স্বচ্ছ জলের পুষ্করিণীর সাথে তুলনা করা যায়, তবে তোমার এই কাব্যখানা সেই পুষ্করিণীর কোলা ব্যাঙ। ইকোলজি জানা লোকমাত্রই জানেন, পুষ্করিণীর বাস্তুসংস্থানের জন্য মাছের চেয়ে কোলা ব্যাঙের গুরুত্ব কম নয়!”
তারমানে বলছি না, কান্তি ঘোষের অনুবাদ খারাপ।

নজরুল কতটুকু আরবিফার্সি জানতেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে অনেক। শৈশবে দারিদ্র্যের সাথে লড়েছেন, তাই, সুযোগ পাননি পড়ার। তবে সেসময় বাঙালি মুসলিম পরিবারে আরবিফার্সি শেখার রেয়াজ ছিল। কিন্তু তিনি খুব ভালো মানের আঁতেল ছাত্র ছিলেন, এমন কথাও শোনা যায় না। যে ছাত্র স্কুল না গিয়ে মাঠের মাঝে, বটের তলে বসে বাঁশি বাজিয়েছে, অন্যের বাড়িতে দুবেলা খাওয়ার বিনিময়ে অনেকটা কাজের লোকের মতোই খেটেছে, পরীক্ষার খাতা প্রশ্ন কমন না পড়ায় বোঝাই করে রেখে এসেছে স্বরচিত কবিতায়, সে যে খুব মনোযোগ দিয়ে ফার্সি কাব্য পড়েছে ছেলেবেলায়, তা বলা যায় না। তাই তার ফার্সিআরবি জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের। প্লানচেটে তার সাথে কথা বলার উপায় কোনভাবে কেউ করে দিলে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতুম ব্যাপারটা! তবে এটা মেনে নিতেই হবে যে, তিনি হয়তো পণ্ডিতদের মতো আরবি জানতেন না, জানতেন না ফার্সি গবেষকদের মতো, কিন্তু অন্তর দিয়ে আয়ত্ত করেছিলেন সে ভাষা দুটো, তাদের চেয়ে অনেক বেশি। আর তার কবিতায় তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে এসব ভাষার শব্দ।
নজরুল খৈয়ামের অনুবাদ কেন করেছিলেন, যেখানে তার আগেই কান্তি ঘোষ প্রমুখ করেছেন? তিনি কি তাদের অনুবাদে খুশী ছিলেন না? নাকি নিজের প্রয়োজনেই করেছেন?
নজরুলকে নারীঘেঁষা কবিতার জন্য (নারীঘেঁষা শব্দটি দিয়ে আমি লুল বোঝাতে চাইনি) সে সময়ের মুসলমানেরা কাফের বলে আখ্যায়িত করেছিল। আর ‘যবন’ বলে মেনে নিতে পারেনি তখনকার হিন্দু সমাজ। তবে হিন্দুরা শিক্ষাগত দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল বলে, তাকে সাদরে নিজের করে নেয়ায় বেলায় তারা দেরী করেনি। কিন্তু মডারেট মুসলিম তাকে মেনে নেয়নি কখনোই। তাই তিনি হয়তো এমন কাউকে খুঁজেছিলেন, যার সাথে নিজের অবস্থার মিল আছে। যাকে তার মতোই ক্রসফায়ারে পড়তে হয়েছে। আর এক্ষেত্রে ওমর খৈয়াম তার অগ্রজ।
এক হাতে মোর তসবী খোদার, আর হাতে মোর লাল গেলাস,
অর্ধেক মোর পুণ্য-স্নাত, আধেক পাপে করল গ্রাস।
পুরোপুরি কাফের নহি, নহি খাঁটি মুসলিমও-
করুণ চোখে হেরে আমায় তাই ফিরোজা নীল আকাশ। (ওমর খৈয়াম
)
ঠিক এমন কথাই বলেন নজরুল তার ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায়-
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর মোল-লারা কন হাত নেড়ে,
‘দেব-দেবীর নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
(...) হিন্দুরা ভাবে, পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পাত-নেড়ে!
(...)গোরা-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কনফুসি!
স্বরাজিরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অংকুশি!

এমন উভয় সংকটে পড়েই হয়তো কবি নজরুল অনুবাদ করেছেন এসব রুবাঈ। তবে এটা আমার অনুমান মাত্র। কোন নজরুল গবেষক এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন।

বঙ্কিম চ্যাটার্জি মীর মশাররফের রচনা পাঠ করে ঠোঁট উল্টে মন্তব্য করেছিলেন, “এই লেখকের রচনায় পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ বেশি পাওয়া যায় না”। এটাকেই তখনকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ মেনে নিয়েছিল স্বীকৃতি হিসেবে। বাংলা ভাষার যে সুললিত গদ্য বঙ্কিম সৃষ্টি করেছিলেন, তা তার নিজের অবদান অবশ্যই। কিন্তু তিনি যে স্টাইলে লিখেছেন, তা তৈরি করা, আরোপিত। ফোর্ড উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত পণ্ডিতেরা সংস্কৃত থেকে প্রচুর পরিমাণে ধারদেনা করে বাংলা লেখ্য ভাষার একটা কঙ্কাল দাঁড় করিয়েছিলেন। সে কঙ্কালে মাংস লেপে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র। কিন্তু কথ্য ভাষার সাথে তার তফাৎ ছিল আকাশ পাতাল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই তফাৎ দূর করেছিলেন প্রহসন রচনা করে। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ আর ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ তে দেখিয়ে দিয়েছেন সবার চোখে আঙুল দিয়ে যে কথ্য বাংলাও সাহিত্যের ভাষা হতে পারে।
কিন্তু মুসলিম সমাজে মাইকেল মধুসূদন তো দূরের কথা বঙ্কিমের মতো প্রতিভাধরও কেউ জন্ম নেয়নি, জন্মানো সম্ভবও ছিল না। তাই মুসলিম সমাজের মুখের ভাষাটা সাহিত্যে স্থান পেতে সময় লেগেছিল অনেক। সে সময়ে উচ্চমুসলিম পরিবারে ফার্সিতেই কথা বলা হতো, আর সাধারণ মুসলিমের ভাষায় বাংলার সাথে আরবিফার্সির মিশেল থাকতো বেশুমার। আর সেটা হতো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই, তাই এটাকে মেকি হাইব্রিড ভাষা বলা অন্যায় হবে। কিন্তু সেই ভাষা মুসলিম সাহিত্যিকেরা সাহিতের বাহন করতে পারেনি। তারা সেই ফোর্ড উইলিয়ামের ভাষাতেই রচনা করেছিলেন। এটা তাদের অক্ষমতা ধরলেও ধরা যায় আবার যদি বলা হয় সে সময়ের কট্টর হিন্দু সমাজ সেই ভাষারীতি মেনে নেবে না বলেই তারা আর সে পথে যায়নি, তাও ভুল বলা হবে না।
কিন্তু নজরুল তার পূর্ববর্তী সাহিত্যিকদের মতো মিইয়ে ছিলেন না। তিনি মুসলিম সমাজের মুখের ভাষাটাকে তার কবিতায় স্থান দিয়ে, কথ্য ভাষাকে জায়গা করে দিয়েছিলেন সাহিত্যে। প্রথম দিকে তৎকালীন হিন্দু সমাজ তার কবিতায় বঙ্গিমের মতো ‘পেয়াজ-রসুনের’ গন্ধ পেলেও শেষতক মেনে নিয়েছিল, বলা যায় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলো। হ্যাঁ, এটা তার কবিতাকে কতোটা উন্নত করেছে, তার সাহিত্য এতে হয়েছে কতোটা চিরকালীন, সমৃদ্ধশালী- সেটা অন্য বিচার।
নজরুলের এই ওমর খৈয়াম অনুবাদ- তার এই ধারাকে, আরবিফার্সি মিশেল কাব্যের ধারাটাকে- করেছে আরও শক্তিশালী, আরও মজবুত, নিঃসন্দেহে। নজরুলের আগমত যেমন বাংলায় একটি অসাধারণ ঘটনা, তেমনই এই রুবাঈইয়াতও অনন্য সাধারণ। কান্তি ঘোষের অনুবাদে সে স্বাদ বাঙালি পায়নি, সে মজা পায়নি সত্তেন দত্তের তর্জমায়, সেই টেস্ট পাওয়া গিয়েছিলো নজরুলের রান্না করা কাব্যে।

নাস্তিক আর কাফের বলো তোমরা লয়ে আমার নাম
কুৎসা গ্লানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম।
অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই,
কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা যাবে স্বর্গধাম? (ওমর খৈয়াম)

ওমর খৈয়াম মূলত ছিলেন গণিতবিদ। এছাড়া জ্যোতির্বিদ্যাতেও তার অবদান আছে। জ্যামিতির অনেক সমস্যার সমাধান তিনি করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেই মধ্যপ্রাচ্যে ইবনে সিনার মতো প্রতিভাবান জন্মেছেন, যেখানে বসে ওমর খৈয়াম সমাধান করেছেন জ্যামিতির জটিল সব বিষয়, সে মধ্যপ্রাচ্য বিজ্ঞানে এতো পিছিয়ে গেল কীভাবে? এর প্রশ্নের উত্তর একটাই। সেখানে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নেই, উত্তর খোঁজার কোন অধিকার নেই। ধর্মের সাথে সংঘর্ষ লাগতে পারে, এমন কিছু ওরা চিন্তাও করতো না, চিন্তা করতে দেয়াও হতো না। তাই আজ মধ্যপ্যাচ্য একটা অচলায়তন ছাড়া কিছুই নয়।
আজকের বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবলেই ঐ মধ্যপ্রাচ্যের কথাই মনে পড়ে। এখানে আমলারা চোখ বন্ধ করে ঘুষ খেয়ে পেটে চর্বি জমায়, সেনাবাহিনী কাউকে ধর্ষণ করে হত্যা করে, রাজনীতিবিদ মুখের বলীরেখা সামান্যও না কাঁপিয়ে মিথ্যে বলে অঢেল, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সব ধরণের অপকর্ম করে শাসক দল- অথচ এদের কাউকেই কোপ খেতে হয়না। কোপ খেতে হয় তাদের, যারা মানুষের অধিকারের কথা বলে। যারা এই অচলায়তন ভাঙার চিন্তা করে, যারা বিশ্বাস করে একটি বৈষম্যহীন সমাজের যেখানে নারী পুরুষ থেকে শুরু করে সমকামী, উভকামী, হিজড়া সবার মর্যাদা সমান- যারা প্রমাণসহ দেখিয়ে দেয় অন্ধবিশ্বাসের অসাড়তা, যারা আলো হাতে আঁধারের যাত্রীকে নিয়ে আসতে চায় আধুনিকতায়, তাদের কোপ খেতে হয়, গুলি খেতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ক্লোন ছাড়া আর বলা যায় কি, একে?
আর যারা চুপ করে আছে, তাদের মৌন সম্মতিকে ঘৃণা করার ভাষা খুঁজে পাইনা। তাদের কানে গিয়ে চিল্লিয়ে বলে আসতে ইচ্ছে করে, ‘আপনারা সারা জীবন পাতার পর পাতা লিখেও একজন মানুষের একটা ঘণ্টাও পরিবর্তন করতে পারবেন না। কিন্তু যাদের মেরে ফেলা হচ্ছে, তারা সম্পূর্ণ জীবন একজনের পাল্টে দিতে পারে, পাল্টে দিতে পারে চিন্তাচেতনা।”
ওমর খৈয়াম এমন এক মৃত অসভ্যতায় নিজেকে আবিষ্কার করে তাই লিখেছিলেন-
খৈয়াম- যে জ্ঞানের তাঁবু করলো সেলাই আজীবন
অগ্নিকুণ্ডে পড়ে সে আজ সইছে দহন অসহন।
তার জীবনের সূত্রগুলি মৃত্যুকাঁচি কাটলো হায়,
ঘৃণার সাথে বিকায় তারে তাই নিয়তির দালালগণ।

রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম এর অনুবাদের ভূমিকা- কাজী নজরুল ইসলাম
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ রাত ১১:৪৯
২২টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×