এক বন্ধু, একদিন, সমরেশ বসু'র 'বিবর' সম্পর্কে বলেছিল, “বাংলা সাহিত্যের সতীচ্ছেদ করেছে 'বিবর'!”
উক্তিটির নতুনত্বে আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন, হেসেছিলামও হয়তো। এমন একটা তুলনা দেয়ায়, যেমন আর শুনিনি কোনদিন- যদিও আগে কেউ এমন তুলনা করেনি, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না, তাকে, আমার বন্ধুকে, অভিনন্দনও জানিয়েছিলাম।
কিন্তু একটু সচেতনভাবে নিলে, উক্তিটি শতভাগ নারীবিদ্বেষী। বাংলা সাহিত্যকে নারীর সাথে তুলনা করাটাও বাড়াবাড়ি, অন্যদিক থেকে অশ্লীলও বটে। যদিও 'হিউমরাস'।
কিন্তু আজ, 'বিবর' পাঠান্তে- যদিও পড়া উচিৎ ছিল অনেক আগে, যেহেতু নিজেকে মনে করি সাহিত্যানুরাগী ও নিবিষ্ট পাঠক, মনে হচ্ছে, কথাটা আংশিক সত্যি। বাংলা সাহিত্য যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে, আমার দৃষ্টিকোণ থেকে, 'বিবর'- আরেকটু বাড়িয়ে বললে, 'বিবর' ও 'প্রজাপতি'র পর; 'রাত ভরে বৃষ্টি' ও 'খেলারাম খেলে যা' কেও ধরা যায় এক কাতারে। অবশ্য, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কার লেখায় বাংলসাহিত্য “বার্ধক্যপ্রাপ্ত” হলো, কিংবা যৌবনপ্রাপ্তির পর তার বয়স বেড়েছে কিনা(?)- তার উত্তর দিতে পারব না।
সমরেশ বসু, যার হাত থেকে এসেছে, 'যুগ যুগ জীয়ে' আর কালকূট ছদ্মনামে 'শাম্ব' আর 'গঙ্গা' এর মত উপন্যাস- কিছু বাজারি উপন্যাসও তিনি লিখেছিলেন অবশ্য পেটের দায়ে, যেহেতু লেখাটাই ছিল তার একমাত্র জীবিকা কিংবা পেশা, 'বিবর' লিখেছিলেন অনেকটা বীতশ্রদ্ধ ও বীতস্পৃহ হয়ে।
' সব প্রচলিত প্রথা ভেঙে দিতেই এবার আমি লিখতে চাই…. অবিশ্যি কেবল প্রচলিত প্রথাকে ভাঙার কথাই তো চিন্তা করিনি৷ চিন্তার জগতেও একটা ওলটপালট চলছিল৷’
তিনি ক্ষেপে গিয়েছিলেন নিজের ও সমসাময়িক অনেকের লেখার উপর। তার মনে হচ্ছিল, একজনের লেখায় পড়েছি, লেখকেরা ঠিক মানুষের কথা বলছে না- অসৎ, কুটিল, নোংরা লোকেরাও হয়ে উঠছে, কলমের টানে, স্বর্গীয় দেবতুল্য শিশু। রেগে গিয়ে, মুখোশ খুলে দিতে আমাদের ও সকলের, নারী ও পুরুষের, তিনি লিখেছিলেন বিবর, যেটা পরবর্তীতে হয়ে উঠেছে প্রবাদপ্রতিম, এবং জনপ্রিয়। সমরেশ বসুর রচনা মানুষ পড়ে না খুব একটা, এটা মাথায় রেখেই,'জনপ্রিয়'; অন্তত তার অন্যান্য অধিকাংশ গল্পোপন্যাসের তুলনায়।
বইটার প্রচ্ছদ, কে করেছে সেটা জানতে পারিনি এখনও, দেখলেই, বোঝা যায়, বইটা অন্য ধাতুর; এক্কেবারে কড়া মাল। প্রচ্ছদে- বড় বড় সাদা চোখ ও রক্তাক্ত জলন্ত মুখে সিগারেট। সামনে শুয়ে নগ্ন নারী, যার একটা হাত মাথা পেঁচিয়ে অন্য দিকে, স্তন ও যৌনাজ্ঞ দৃশ্যমান।
পাঠককে একবার হোচোট খেতেই হবে প্রচ্ছদে। আর তারপর উৎসর্গ পৃষ্ঠায়; যেখানে তিনি লিখেছেন, কাউকে আক্ষরিক অর্থে উৎসর্গ না করে, “আচ্ছা, আমরা যদি সবাই, সত্যি কথা বলতে পারতাম…”। যেন এটা উৎসর্গ-পাতা নয়, উপন্যাসটার শুরুই যেন সেখান থেকে। তিনি যদি চাইতেন, চান'নি যদিও, তবে সেটাই হতে পারত উপন্যাসটার প্রথম লাইন এবং হলেও, মোটেই বিদঘুটে ঠেকত না, মানিয়ে যেত বেশ।
উপন্যাসের নায়ক- যাকে কিনা দুশ্চরিত্র বলেই মনে হবে সবসময়; যে, হয়তো শুধু সমরেশ বসুর মত সাহসী লেখকের হাতেই নায়কের মর্যাদা পেতে পারে ও পেয়েছে, সে “আমিই”। উপন্যাসটা যেন এক আত্মকথন; স্কেপিস্ট কিংবা বাঁকা বাংলায় সুশীল না হলে, অন্তত সবার উপন্যাসটাকে মনে হবে তাই। যেন 'আমি'ই বলছি, বিড়বিড় করে কথাগুলো, কিংবা চিন্তা করছি, আর পটাপট লেখক, অনেকটা গুগোল এসিস্টেন্ট বা SRI এর মত, লিখে চলেছেন।
নায়ক, যে কিনা “আমি”, নীতার সাথে, যাকে এই উপন্যাসের নায়িকা বলা যেতেই পারে, সেক্স করার পর, সোজাসুজিই বললাম, মেরে ফেলে। হঠাৎ। মেরে ফেলার কোন কারণ ছিল না, ইচ্ছেও ছিল না, রাত্রিশুরুর মিলনের পর, নায়কের ঘৃণা হচ্ছিল, আবার পাচ্ছিল ভালবাসাও, থুথু ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর মুখে- এমন দোলাচলে, মেরেই দিল। কনুই দিয়ে, গলা চেপে।
উপন্যাসের শুরু এভাবেই, একটা খুন দিয়ে, আর তারপর, খুনীর কিংবা নায়কের আত্মকথন। নায়ককে, অনেকসময়, সাইকোপ্যাথও মনে হতে পারে, যেহেতু সে, হত্যা করে একবারের জন্যও অনুশোচনা করে না আর আমরা জানি, সাইকোপ্যাথদের বৈশিষ্ট্যও তাই। তবুও উপন্যাস শেষে, নায়ককে, আমাদের মানুষই মনে হবে- সুস্থ ও সমাজসচেতন।
প্রজাপতির মত, সমরেশ বসুর এই উপন্যাস, 'বিবর' নিয়েও, সেকাল থেকে, সেই ১৯৬৫ সাল থেকে, এখনও চলছে বিতর্ক, আলোচনা ও সমালোচনা। যেমনটা হয়, এ বাংলায় “খেলারাম”কে নিয়ে। এই তো সেদিনই, এক মোটামুটি লেভেলের আধাসেলিব্রেটি- যে লোকের নজর কেড়েছে সত্যিকার অর্থেই শুধুমাত্র মেয়ে বলে, ফেবুতে ঘোষণা দিল, খেলারামকে, “পিয়র চটি” বলে। এমনটা বরাবরই হয়ে আসছে 'বিবর' আর 'প্রজাপতি'কে ঘিরে। কিছু লোক- আরো ভাল করে, নির্দিষ্ট করে বলতে হলে, সমালোচক, যারা হয়ত নপুংসক এবং যারা হয়ত জৈবিক চাহিদার ফলশ্রুতিতে জন্ম না নিয়ে, ডিরেক্ট আকাশ হতেই নাজিল হয়েছেন পৃথিবীতে, তারা 'বিবর'কে অশ্লীল বলে চালিয়ে দিতে চায়, এবং চালিয়ে দিচ্ছে। জীবদ্দশায় ,এসব সমালোচকদের থোড়াই কেয়ার করতেন সমরেশ বসু, যদিও অনেক সময়ই তাকে যেতে হয়েছে বিতর্কে, মহৎ সাহিত্য ও গল্প না লিখে লিখতে হয়েছে জবাবদিহিতামূলক প্রবন্ধও। একবার তো 'প্রজাপতি'র জন্য যেতে হলো কোর্টে পর্যন্ত আর তার হয়ে সাক্ষ্য দিলেন স্বয়ং 'বুদ্ধদেব বসু' আর সাক্ষ্য দিতে চেয়েও হাজিরা দিলেন না 'তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়'।
এতসবের পর, শ্লীল বৃদ্ধ সমালোচকদের খাড়ার খোঁচা খেয়েও আজও পঠিত হচ্ছে 'বিবর', নীলক্ষেতে তো বিক্রি করছে দোকানদারেরা ফটোকপি করে, যেহেতু কলকাতার বই আসে না খুব একটা এদেশে, আর এলেও যার মূল্য আকাশছোঁয়া।
আমার ভাল লেগেছে বিবর। কয়েকবার মনে হয়েছে, এর চেয়ে ভাল আর পড়িনি, এবং যেহেতু লেখক মৃত্যুবরণ করেছেন দুইদশক আগে, আর পাবোও না এমন লেখা। তার মৃত্যুর আগেই, বাংলা সাহিত্য হয়ে গিয়েছিল শিশুতোষ, যার পাত্রপাত্রীরা প্রেম করে, আর প্রেমই করে, শরীর সেখানে নেই, “কামগন্ধ নাহি তায়”, সিরিয়ালের মত বাংলা সাহিত্য হয়েছিল দীর্ঘ ও ঈদসংখ্যা, আর এখন বইমেলা কেন্দ্রিক। এমন শিশুতোষ সাহিত্য থেকে মুক্তি পাক বাংলাদেশ।
৩০/০১/১৯
গুডরিডসে বিবর
সমরেশ বসুকেই মনে হত যুবরাজ- সুনীলের স্মৃতিচারণ
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:৪৭