somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জনৈক শেলী সেনগুপ্তা কিংবা রণজিৎ বিশ্বাস

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৪:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি নীলক্ষেত থেকে প্রায়ই বই কিনি। খুব কাছে বলে সপ্তাহে দুতিনদিন যাওয়া হয়’ই। তাই বলে আমি বইপোকা নই; এমন নয় যে ঘুমানোর আগে শুয়ে বই না পড়লে আমার ঘুম আসে না; কিংবা অবসরে অথবা ঝিম ধরা চিল ওড়া থৈথৈ দুপুরে বুঁদ হয়ে থাকি বইয়ে মুখ গুঁজে। হার্ডকোর পাঠক আমি ছিলাম না কোন দিন। আসলে পুরাতন বইয়ের গন্ধ আমার ভাল লাগে। পুরাতন বই খুললেই ন্যাপথলিনের গন্ধ ছাপিয়ে অদ্ভুত এক গন্ধ ভেসে এসে ঢোকে নাকে, সাথে নিয়ে আসে পুরান দিনের হাওয়া- যাপিত সময়ের ইতিহাস। পুরাতন বই খোলাটা অনেকটা বহুদিন বন্ধ পড়ে থাকা তালাবদ্ধ ঘর খোলার মতো। সে ঘর খুললে যেমন বুনো এক অতীতগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, পুরান বইয়ের গন্ধটা ঠিক তেমনই। বিকট অথচ রোমাঞ্চকর। এই গন্ধের লোভেই আমার নীলক্ষেত যাওয়া। কোনকোন দিন টাকা থাকে না পকেটে। সেদিন প্রিয় লেখকের কোন বই খুঁজে, তার গন্ধ নিয়ে নেড়েচেড়ে ফিরে আসি হলে।
সেদিন বিকেলে নীলক্ষেতে গিয়েছি গোধূলিকে নিয়ে। গোধূলির দুদিন হলো বই পড়ার নেশা জন্মেছে। তাই এসেছে সাথে। অবশ্য বইয়ের নেশা ওর কতদিন থাকবে, সেটা ভাববার বিষয়। কিছুদিন আগে গিটারের ভূত চেপেছিল মাথায়। দুদিনের মাথায় সাইন্সল্যাব থেকে কিনে ফেলল একটা একোস্টিক। কয়েকটা কর্ড শিখতে না শিখতেই, বলল, “আঙ্গুলে যা লাগে! এত কষ্ট জানলে গিটার কিনতামই না!”
গিটারটার এখন কী অবস্থা কে জানে। হয়ত ওর ঘরের এককোণে ধুলোমলিন পড়ে আছে।
কিছু মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের মতো গোধূলির নেশা টেকে না। অভিনয়ের নেশা, গানের নেশা, আবৃত্তির নেশা, খেলাধুলার নেশা, সাইকেল চালানোর নেশা, ট্যুর দেয়ার নেশা- সবগুলোই তার ছিল; ঘুম কেটে যাওয়ার মতো করে সেগুলোও কেটে গেছে। একবার ওকে সিগারেট ধরিয়ে দেখতে হবে!
কিছুদিন আগে ওকে শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীন’ পড়তে দিয়েছিলাম। টানা কয়েকদিন ওর খোঁজ নেই। ক্লাসেও আসে না। তারপর হঠাত টিএসসিতে ডেকে নিয়ে বলল, “আমার ধ্রুব’র মতো বয়ফ্রেন্ড চাই।”
কয়েকদিন পর দেখা-সম্বোধনের বালাই নেই, ভাল আছি কিনা ইত্যাদি জানতে চাওয়া নেই, ওর কেমন বফ লাগবে, সেটাই প্রথমে বলা চাই! বললাম, “ধ্রুব মন্ত্রীর ছেলে। মন্ত্রীর ছেলের সাথে শুধু তুই না, সবাই প্রেম করতে চাইবে।”
“মন্ত্রীর ছেলে দরকার নেই। ছেলেটা হবে ধ্রুবর মতো রাফ এন্ড টাফ। মারপিট করবে, মদ খাবে। মেয়েদের পাত্তা দেবে না। আর দেখতেও ভাল।”, আমার রসিকতাকে পাত্তা না দিয়ে গোধূলি সিরিয়াসভাবে বলল কথাটা!
আমি নিজে খুব ম্যানম্যানা টাইপের ছেলে। মারামারি মোটেই পছন্দ করি না। ঝগড়াটগড়া লেগে কোন ব্যাপার মারামারির পর্যায়ে গেলে নিজেই আগে সরিটরি বলে মিটমাট করে ফেলি। গোধূলির হঠাৎ মারকাট্টা ছেলে পছন্দ হবে জানলে, ছোট বেলা থেকেই অন্যরকম হয়ে বেড়ে উঠতাম!
বললাম, “ছাত্রলীগ করে এমন একটা ভাল চেহারার ছেলের সাথে প্রেম করলেই পারিস। ওরা মদ খায়, মারপিট করে! রাফ। সমস্যা হলো, মেয়েদের টাইমই দেয় না- এমন ছাত্রলীগার পাওয়া। শালারা তো মেয়ে দেখলেই চোখ দিয়ে চাটে। ওমন ছেলে পাওয়া গেলে, হয়ত দেখা যাবে, সে ব্যাটা গে!’’
গোধূলি নাক ছোট করে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “ছাত্রলীগ? ওদের কারো সাথে প্রেম করার চাইতে হোমো’র সাথে প্রেম করাই ভাল!”
গোধূলি তার নামের মতোই পরিবর্তনশীল- রঙ্গিন, উদাসী ও খোলামেলা। গ্রীষ্মের গোধূলি যেমন রঙ বদলায় ক্ষণেক্ষণে, ও তেমনই। ওর সাথে থাকলে যেকোন সময় যেকোন কিছু হতে পারে! মেয়ের নেশা নেই, মেয়েদের পাত্তা দেয় না, এমন স্ট্রেইট(!) ছেলে পাওয়া গেলে, সেও কয়েকদিনের মধ্যেই ওর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে!
অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগেই গোধূলি হঠাত উঠে দাঁড়াল। আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, “চল, নীলক্ষেত যাব। আমাকে শীর্ষেন্দুর আরো বই খুঁজে দে। শীর্ষেন্দু এত ভালো লেখে!”
অগত্যা নীলক্ষেত। অবশ্য ও না এলেও হলে ফেরার আগে একবার ঢু মেরে যেতাম।
নীলক্ষেতে এখন পুরাতন বইয়ের চেয়ে নতুন বই’ই বিক্রি হয় বেশি। গাইডবই, ভর্তি পরীক্ষার বই, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বই, মেডিকেল, বুয়েট, ডিপ্লোমার বই- এসবের ভিড়ে সাহিত্য চাপা পড়ে গেছে। এখন হয়ত এখানে বইয়ের চেয়ে তেহারির দোকান সংখ্যায় বেশি! হঠাৎ কেউ এলে, নীলক্ষেতকে ফার্মগেট থেকে আলাদা করতে পারবে না। সাহিত্য বিক্রি হয় একদম চিপায়- অনেক গলিঘুপচি ঘুরে তবেই পাওয়া যায় তার দেখা। মোটে চারপাঁচটা দোকান। সেগুলোও ক্রেতার অভাবে খাঁখাঁ করছে। চোখের সামনেই কয়েকটা সাহিত্যের দোকানকে আমূল বদলে গাইড বইয়ের দোকানে পরিণত হতে দেখেছি। অথচ পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ- দেড় কিলো ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত আঁকা গেলে তার ভেতরে অন্তত দশটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়বে। লাখখানেক ছাত্র আছে অথচ তারা চারপাঁচটা বইয়ের দোকান টিকিয়ে রাখতে পারছে না!
নীলক্ষেতের গলিতে পা দেয়ার সাথে সাথেই লোডশেডিং! ঢাকায় এখন লোডশেডিং হয় না বললেই চলে। হয়ত তারটার ছিড়েছে কোথাও কিংবা লাইনের কাজ চলছে। দোকানগুলো একটার সাথে আরেকটা জোড়া বটের মত লেগে আছে, আলো আসার কোন উপায় নেই। বিকেলেই অমাবস্যা নেমে এলো যেন। গোধূলি আমার পেছন পেছন আসছিল, অন্ধকার হতেই আমার হাতটা টেনে ধরে বলল, “একটু পরে গেলে হয় না? অন্ধকার। আমার ভয় করছে!”
ততোক্ষণে কয়েকটা দোকানে চার্জার লাইট জ্বলে উঠেছে। চার্জারের মৃদ্যু আলোতে দেখলাম, ছোট হয়ে গেছে গোধূলির মুখ। বাচ্চা বেড়ালগুলো ভয় পেলে যখন লুকায় দরজার পিছনে, তাদের মুখে ফুটে ওঠে যে আকুলতা, তেমন আকুলতা ওর চোখেমুখে! বললাম, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেউ তোর সাথে কিছু করবে না!”
নীলক্ষেতকে আমি হাতের তালুর মত চিনি। এর যে কোন গলি থেকে এই অন্ধকারেও বেরিয়ে আসতে পারব দুমিনিটে। তাছাড়া এখানে সবাই বই কিনতে আসে- গাইড হোক বা ডিপার্টমেন্টের বই, যারা বই কেনে তারা অন্ধকারে কোন মেয়ের সাথে অসভ্যতা করবে, এ আমি বিশ্বাস করি না।
গোধূলির হাত ধরে এগিয়ে চললাম আমি ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে। গলি পেরিয়ে আরো গলি, তারপরের গলি। গোধূলি অধৈর্য হয়ে বলল, “আর কত ভিতরে?”
বললাম, “এইতো সামনে! কাঁটাবনের রাস্তাটা দিয়ে ঢুকলে তাড়াতাড়ি হত।”
গোধূলি আমার হাতটা আরও শক্তভাবে ধরল। লোডশেডিংকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হলো আমার। হঠাৎ এমন করে আলো নিভে গেলে গোধূলি এভাবে আমার হাত ধরত!
অলিগলি পেরিয়ে চলে এলাম বুড়ার দোকানে। দোকানটার একটা নামও আছে, কোনদিন খেয়াল করিনি। অথচ গত দুই বছর এখান থেকেই সরবরাহ হচ্ছে মানসিক খাদ্য!
বাংলাদেশের যে কোন দোকানেই হুমায়ুন আমমেদ, সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, জাফর ইকবাল পাওয়া যায়। এদের খুঁজে বের করতে হয় না কষ্ট করে। গাঁদি করাই থাকে। সমস্যা হলো, ভাল বই খুঁজে বের করা।
গোধূলি ‘বাঁশিওয়ালা’ নামের একটা বই দেখিয়ে বলল, “এটা কিনি? পড়েছিস?”
‘বাশিওয়ালা’ সুখপাঠ্য। কার কাছ থেকে যেন নিয়ে পড়েছিলাম। প্রেম নিয়ে লেখা; পড়তে শুরু করলে সময় ভালই কেটে যায়, কিন্তু আদতে মনে দাগ কাটে না কোন। বললাম, “পড়েছি। চরিত্রগুলা সব ন্যাকামার্কা। ধ্রুবর মতো রাফটাফ কেউ না। খুঁজতে থাক!”
গোধূলি বলল, “ধ্রুবর মতো নায়ক কি সব উপন্যাসেই থাকবে নাকি? তুই আমাকে ভাল বই খুঁজে দে!”
শেষমেশ ও ‘পার্থিব’ কিনল। কেনার পর বইটা হাতে নিতেই কার্তিকের তরুণসূর্যে পরিপক্ক ধান ক্ষেতের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠল গোধূলির মুখ। পার্থিব বিখ্যাত বই; এটাকে খারাপ বলার সাহস আমার নেই। সত্যি বলতে, আমার দূরবীনও ভাল লাগেনি খুব একটা। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, বাংলা সিরিয়াল দেখছি।
দোকানদার বুড়াটা আমাকে বললেন, “কমলকুমার মজুমদারের একটা বই এসেছে। দেখবেন?”
বললাম, “দেখান। ওর বই তো আমি পড়তেই পারি না। কিনব কী?”
কমলকুমার মজুমদারের লেখায় আমি কোনদিন দাঁত ফুটাতে পারিনি। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ পড়ার চেষ্টা করেছিলাম বছর দুয়েক আগে- দুপাতা পড়ার আগেই মনে হয়েছে, অনেক বিদ্যা জাহির করেছি, আর না! তিনি তার লেখার জন্য তৈরি করেছেন পুরোপুরি আলাদা এক ভাষা। বাংলা প্রচলিত গদ্যরীতির সাথে তার বিন্দুমাত্র মিল নেই। এমনকি বাংলা গদ্যের গঠন পর্যন্ত মানেননি।
বুড়া বইটা হাতে দিলেন। ছোট্ট বই- জায়গায় জায়গায় ছেড়া। নাম ‘গোলাপ সুন্দরী’। বললেন, “নিয়ে নেন। বিখ্যাত বই। অনেকে এসে খোঁজে, আমি দিতে পারি না। মাত্র ৩০ টাকা। পরে আর পাবেন না চাইলেও!”
এমন করে বিজ্ঞাপন দিলে, না কিনে পারা যায় না। টাকা ছিল না আজও। গোধূলির কাছে ধার করেই কিনলাম।
গলি থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানে বসেছি আমরা। প্রচণ্ড ভিড়; দোকানদার বসে অপেক্ষা করতে বলল, চা হলে দিয়ে দেবে। গোধূলি নিবিষ্ট মনে সদ্য কেনা বইদুটা দেখছে, মুখ নিচু করে। খোলা চুল ঢেকে রেখেছে মুখের একাংশ। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁটের ডানদিকের তিলটা। উলটে পাল্টে দেখছে বইয়ের পাতা।
হঠাৎ আমার দিকে হেলান দিয়ে বলল, “এই দেখ! পড়ে দেখ কী লেখা আছে!”
গোধূলি আঙুল দিয়ে ‘গোলাপ সুন্দরী’ বইয়ের শুরুর দিকে একটা পৃষ্ঠা দেখাচ্ছে। উৎসর্গ পাতার সামনে একটা খালি পাতা আছে, সেখানেই কিছু একটা লেখা।
ওর হাত থেকে বইটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম। সেখানে লেখা-
“শেলী সেনগুপ্তা,
সম্পর্কে পারস্পারিক নির্ভরতার অতিরিক্ত কিছু, যা, আজ বোধহয়, প্রায়ই হারাতে বসেছি, অচিরাৎ তা যেন ফিরে পাই- এই হোক জন্মদিনের কামনা।
রনজিৎ বিশ্বাস
৩/সি বাটালি পাহাড় বহুতলা ভবন,
লালখান বাজার, চট্টোগ্রাম।
৫ মে, ১৯৮৪।”


খুব নতুন কিছু দেখলে, বিস্ময়াভিভূত হলে, লোকে যেমন বড় বড় চোখে তাকায়, তেমন চোখে গোধূলি আমার দিকে তাকিয়ে। বলল, “কিছু বুঝলি?”
আমি আবার পড়তে লাগলাম লেখাটা। গোধূলি তার স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা বজার রেখে বলল, “একটা ছেলে কত আবেগ নিয়ে কথাগুলা লিখে বইটা গিফট করেছে! অথচ মেয়েটা তার দামই দেয়নি! বিক্রি করে দিয়েছে বইটা!”
বললাম, “ছেলেটা মেয়েটা বলছিস কেন? সালটা দেখেছিস? ১৯৮৪! যে লিখেছে, তার লেখার ধরণ দেখেই বোঝা যায়, সে উচ্চশিক্ষিত। না হলে কেউ কমলকুমার উপহার দিত না। ’৮৪ সালেই লোকটার বয়স ২৫/২৬ ছিল অন্তত। তাহলে এখন ওদের বয়স কত হিসেব কর! আমাদের বাবামায়ের চেয়েও বেশি!”
ও আমার কথা গুরুত্ব দিল না; যেন কানে’ই যায়নি। বলল, “এখন বয়স যাই হোক, তখন তো ওরা কমবয়সী ছিল। ভাব, কত আবেগ দিয়ে লিখেছে লোকটা। আর শেলী সেনগুপ্তা বইটা শালা বেঁচে দিল- তাও দাম ত্রিশ টাকা!”
এটা আমার কাছে নতুন কিছুই নয়। পুরান বই কিনি বলে, এমন মাঝেমাঝেই চোখে পড়ে। কত ছেলে আবেগভরা চিঠি সামনের ফাঁকা পাতায় লিখে বই উপহার দিয়েছে! আর সেগুলো ঘুরেঘুরে এসেছে, পুরান বইয়ের দোকান হয়ে আমার হাতে; বইগুলো সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তাও তারা বোধ করেনি। সেগুলো বেশিরভাগই ৮০ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে লেখা। এসময়টায় বাংলা বই চলত বেশি, চিঠি ব্যতীত যোগাযোগের উপায়ও ছিল না। ২০০১ এর পরের যেসব বই পেয়েছি, সেগুলোয় এমন লেখাটেখার বালাই নেই। ততোদিনে মোবাইল চলে এসেছে হাতেহাতে, চিঠি ফিঠির সময় গেছে পেরিয়ে।
চা পেয়ে গিয়েছি এরমধ্যে। চা’তে মুখ দিতেই মনে হলো, কেউ আমার মুখে চিনির একটা বৈয়াম ঠুসে দিয়েছে। এত মিষ্টি! চায়ের দোকানদারেরা কেন মনে করে, বেশিবেশি চিনি আর দুধ দিলেই চা ভাল হবে? মুজতবা আলী বলেছিলেন, রান্না খারাপ হলে বেশি করে মরিচ মেখে দিতে, যাতে কেউ ঝালের ঠ্যালায় স্বাদের দিকে নজর দেয়। চাওয়ালারা মরিচের বদলে ঠেসে দেয় চিনি।
চা রেখে সিগারেট ধরিয়ে বললাম, “এমন করে বলছিস কেন? লোকটার ভাষাজ্ঞান দেখেছিস? রণজিৎ বিশ্বাস নির্ঘাত বাংলার অধ্যাপক। আর যাকে দিয়েছে, সেও নিশ্চয়ই ফেলনা নয়। কমলকুমারের গল্প বোঝার সক্ষমতা ওর আছে। তেমন কোন মেয়ে মাত্র ৩০ টাকার জন্য এমন বই বেচে দেবে?”
গোধূলি তেড়ে এলো যেন। বলল, “তুই এত বুঝিস কেন? বিক্রি না করলে দোকানে আসত?”
কিছু মানুষ আছে, যাদের কোনদিন যুক্তিতে হারানো যায় না। তারা যুক্তির ধার ধারে না। গোধূলি তেমনই- তাই তর্কে লাভ নেই। ও যা বোঝে, তাই সত্য, তার বাইরে কিছু হতেই পারে না।
শান্ত স্বরে তাই বললাম, “আরে বাবা, এমনও তো হতে পারে যে, শেলী সেনগুপ্তার কাছ থেকে বইটা কেউ নিয়েছিল পড়তে। সে আর ফেরত দেয়নি। কমলকুমার কঠিন- পড়তে না পেরে বিক্রি করে দিয়েছে। বা শেলীর হয়ত বিয়ে হয়ে গেছে কোথাও। বাপের বাড়িতে বইগুলা পড়ে ছিল। তারা বিক্রি করে দিয়েছে। অথবা...”
গোধূলি অধৈর্য হয়ে বলল, “থাক আর বলতে হবে না। অনেক কিছুই হতে পারে। এত জেনে লাভ নেই!”
গোধূলি মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে সে পাতাটা আর বইটার কভারের ছবি তুলে নিয়ে চলে গেল!
আমিও ‘গোলাপ সুন্দরী’ নিয়ে আমি ফিরে এলাম হলে।

হলে ফিরে ‘গোলাপ সুন্দরী’ পড়ার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। পারলাম না, এর চেয়ে সাবটাইটেল দেখে ইতালিয়ান আল্ট্রামর্ডান ড্রামা বোঝা সহজ। যেন বাংলায় নয়, সংস্কৃতে লিখেছেন তিনি। কমলকুমারের অগ্রজ বিভূতিভূষণ, মানিক- এরা লিখেছেন চলিত ভাষায়, অথচ অনেক পরে লেখালেখি শুরু করেও তিনি লিখেছেন সাধুতে!
বইটা বন্ধ করতে গিয়ে আবার নজরে পড়ল চিঠিটা। আরেকবার পড়তেই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেলাম। সেই শেলী সেনগুপ্তা এখন কোথায়, যাকে এত আবেগভরে লিখেছেন রণজিৎ বিশ্বাস? তারা কি আছেন এখনো চট্টগ্রামে? আমি চট্টগ্রাম যাইনি কোনদিন। শুনেছি সেখানে অনেক টিলা আছে। সেই তারুণ্যের দিনগুলোতে তারা কি হাত ধরে হাঁটত টিলার উঁচুনিচুতে? রণজিৎ কি আবার ফিরে পেয়েছিলেন “পারস্পারিক নির্ভরতার অতিরিক্ত কিছু”? শেলী সেনগুপ্তা হয়ত এতদিনে বুড়ি হয়ে গেছেন। তার কি মনে পড়ে রণজিৎ এর কথা? ৩৬ বছর আগের সেই টগবগে যুবককে?
এসব প্রশ্নের জবাব নেই কোন। জানাও হবে না কোনদিন। বইটা বন্ধ করে রেখে দিলাম টেবিলে; ‘অচিরাৎ’ আবার পড়ব, এমন সম্ভাবনা নেই।
কিছুপরেই গোধূলি ফোন দিল। রিসিভ করতেই বলল, “আচ্ছা, রণজিৎ বিশ্বাসের খোঁজ করা যায় না?”
হতচকিয়ে গেলাম। আবার কোন নেশা হয়ত চড়ে বসেছে ওর মাথায়! আগেও এমন কিছু চিঠি আমি পেয়েছি। তাদের পাত্রপাত্রীকে খোঁজার চিন্তা আমার একবারও আসেনি। বললাম, “মাথা খারাপ নাকি? এত দিন আগের কথা। কীভাবে খোঁজ করব ওদের?”
গোধূলি অবুঝের মত বলল, “কেন? ঠিকানা তো দেয়াই আছে। সেই ঠিকানায় চিঠি দিলে হয় না?”
বললাম, “চিঠি? সেই ঠিকানায় এখনও ঐ লোক আছে বলে তোর মনে হয়? ৩৬ বছর আগের কথা, বস! গোটা দুনিয়া এর মধ্যে পাল্টে গেছে! হয়ত দেখা যাবে বাটালি পাহাড় বহুতল ভবনও এখন নেই!”
গোধূলি ফোনের ওপার থেকে বলল, “তুই এত পেসিমিস্ট কেন? পেয়েও তো যেতে পারি! তোর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বন্ধু নেই?”
“চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু দিয়ে কী হবে?”, জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
বলল, “কেউ থাকলে তাকে দিয়ে খোঁজ নেয়া যেত- ঐ ঠিকানায় রণজিৎ নামের কেউ এখনো আছে কিনা!”
বললাম, “আর খুঁজে পেলে কী বলবে আমার ফ্রেন্ড? বলবে, ‘আপনার একটা বই পেয়েছি আমি। ৩৬ বছর আগের। শেলী সেন নামের কোন প্রেমিকা ছিল আপনার?’ ভাব, লোকটার কী উত্তর হতে পারে। তার নাতি নাতনিরাও হয়ত এখন স্কুলে পড়ছে। ও কি এখন আমার বন্ধুর সাথে তিন দশক আগের প্রেম নিয়ে রোমন্থন করবে, ব্যালকনিতে বসিয়ে?”
“তোকে আসলে ফোন করাটাই ভুল হয়ে গেছে!”, বলেই ফোনটা কেটে দিল গোধূলি।
তাও ভাল, বধুকে দিয়ে খোঁজ করানোর কথা এসেছে ওর মাথায়। ও যদি কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে বলত, “যা চিটাগং থেকে একটু খোঁজটা নিয়ে আয়”, অবাক হতাম না। ওর কাছ থেকে এমন আবদার পেয়ে আমি অব্যস্ত।
ঘুমানোর সময়, মনে পড়ল, কাউকে খুঁজতে এখন আর সশরীরে তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতে হয় না। অনলাইনে সার্চ করলেই হয়। ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে তাই ‘রণজিৎ বিশ্বাস’ লিখে সার্চ করলাম। কিছু প্রোফাইল বেরিয়ে এলো। কিন্তু প্রপিক দেখে মনে হচ্ছে, এদের কারো বয়স ৪০ এর উপরে নয়। আর আমার যাকে প্রয়োজন, তার বয়স অন্তত ৫৫।
৫৫ বছরের কেউ কি ফেসবুকে থাকবেন? আমার ফ্রেন্ডলিস্টেই তার চেয়ে বয়স্ক অনেকে আছেন। তাও না থাকার সম্ভাবনা কম নয়। শেষমেশ পেলাম না কাউকেই।
শেলী সেনগুপ্তা লিখেও সার্চ দিলাম। এই নামে অনেকেই আছেন। সবাই কমবয়সী- ৮৪ সালে এদের মা বাবার বিয়ে পর্যন্ত হয়েছে কিনা সন্দেহ। কয়েকজনের প্রপিকে হালের জনপ্রিয় মডেল আর নায়িকাদের ছবি।
স্ক্রল করতে করতে একটা ছবিতে আটকে গেল চোখ। ছবিতে সদ্য যৌবন পেরনো একজন নারী- কপালে লাল টিপ, উজ্জ্বল হলুদ শাড়ি পরনে। বয়সের দাগ মুখে যতটা পড়ার কথা, পড়েনি ততোটা। এককালে প্রচণ্ড সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়। হোমটাউন চট্টগ্রাম!
ইনিই সেই শেলী সেনগুপ্তা তাতে আমার সন্দেহ নেই। সেই শুভেচ্ছাবাণীটা পড়ে যে কিশোরীটিকে কল্পনা করছিলাম, এ যেন তার তিন দশক পরের প্রতিচ্ছবি!
শেলীকে খুঁজে পাওয়ার কথাটা কী গোধূলিকে জানাব? ও হয়ত নতুন কোন কাণ্ড করে বসবে। পরে জানালেও চলবে!
এখন আমি চাইলেই তাকে ম্যাসেজ দিতে পারি। জিজ্ঞেস করতে পারি, রণজিৎ বিশ্বাসের কথা; ৩৬ বছর আগে তাদের প্রেমের কথা। বইটার কথা বলতে পারি, যেটা আচমকা পেয়ে গেছি আমরা। এতক্ষণ যে জানতে ইচ্ছে করছিল, তারা টিলার আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথে হেঁটেছেন কিনা হাত ধরে, সেটাও জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারি। অবশ্য এসবের উত্তর তিনি করতে বাধ্য, এমন নয়। হয়ত ম্যাসেজটা তিনি দেখবেনই না, দেখলেও হয়ত উত্তর দেবেন না। তবু আমি তো তাকে পেয়েছি খুঁজে, উত্তর না দিক, আমি তো প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করতে পারি!
তবু, দিলাম না ম্যাসেজ। হয়ত মনে নেই শেলী সেনগুপ্তার রঞ্জিৎ বিশ্বাসের কথা। ৩৬ বছর অনেক লম্বা সময়; ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। তিনি সুন্দরী ছিলেন- সব প্রেমিকের নাম কি মনে রেখেছেন তিনি? রাখা সম্ভব? কিংবা মনে রেখেছেন তিনি রণজিৎ বিস্বাসকে- বয়ঃসন্ধির প্রেমের মত লুকিয়ে রেখেছেন সে নাম, গোপন ব্যথার মত। খুঁচিয়ে আবার জাগিয়ে তুলব তিন দশক আগের স্মৃতি?
থাকুক কিছু প্রশ্ন মনেই। সব প্রশ্নের উত্তরের প্রয়োজন নেই।
২৮/১১/২০১৯
প্রথম ছবিটি Pinterest থেকে সংগ্রহ করা
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৪:৩২
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×