
কবি নজরুল বাকরুদ্ধ ও জীবন্মৃত হয়ে যাওয়ার প্রায় ৬ বছর পর, তার বন্ধু কবি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দিন তার হাতে কলম তুলে দেন একদিন। কবির পক্ষে কিছু লেখা তখন অসম্ভব। তবু তিনি লিখতে পেরেছিলেন চার লাইন অস্পষ্ট অক্ষরে। তিনি লিখেছিলেনঃ
“কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবে চির
বুলবুলকে গান গান শেখাব- গান শেখাব
গান করার কবিতা গান করব-
কবি কাজী নজরুল ইসলাম চিরদিন”
চার লাইনের বেশি তিনি লিখতে পারেননি।
এই লেখা থেকে অন্তত বোঝা যায়, তিনি তার পুত্র বুলবুলকে গান শেখানোর কথা বলছেন। গানপাগল কবির ইচ্ছে ছিল প্রিয়পুত্রকে গান শেখানোর। কিন্তু গান শেখানোর বয়স হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করল বুলবুল মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে।
মৃতপ্রায় রুগ্ন শিশুর শিয়রে বসেই নজরুল হাত দিয়েছিলেন হাফিজের 'রুবাঈয়াৎ-ই-হাফিজ’ অনুবাদে। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত সে বই এর ভূমিকায় তিনি লিখলেনঃ
"বাবা বুলবুল,
তোমার মৃত্যুশিয়রে ব’সে “বুলবুল-ই-শিরাজ” হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন অনুবাদ শেষ ক’রে উঠলাম, সেদিন তুমি- আমার কাননের বুলবুলি- উড়ে গেছ! যে দেশে গেছ তুমি, সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও সুন্দর?”
বুলবুলের শোক কবি ভুলতে পারেননি মস্তিষ্কবিকৃতির পরও, বুলবুলের মৃত্যুর প্রায় ১৮ বছর পর তার লেখা সেই চারলাইনের 'প্রলাপ' তাই বলে অন্তত। প্রথম মৃত্যুর পর প্রায় ৩৪ বছর তিনি জীবিত ছিলেন। তার কোন আনন্দ ছিল না, অনুভূতি ছিল না- তিনি কবিতা লেখননি, ঝাকড়া চুল দুলিয়ে দরাজ গলায় গাননি, অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তোলেননি পরিপার্শ্ব। কোনকিছু স্পর্শ করত না তাকে। এই ৩৪ বছর হয়তো তিনি শুধু মৃত পুত্রের কথাই ভেবেছিলেন। আমরা জানি না এসব, জানতে পারবও না কোনদিন।
কবির চার পুত্রের মধ্যে তিন জন মৃত্যুবরণ করেছিলেন তার মৃত্যুর আগেই। যখন কবি ঢাকায় তিরোধান করলেন, তখন তার একমাত্র জীবিত পুত্র কাজী সব্যসাচী ছিল কলকাতায়। তিনি তার পিতাকে শেষবার দেখতেও পারেননি। তার অজান্তেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়েছে কবিকে তড়িঘড়ি করে!
এই বিদ্রোহীর পুরো জীবনটাই ট্রাজিক। হিন্দু মুসলিম নয়- বাঙালি পরিচয়েই যে কবি পরিচিত হতে চেয়েছিলেন, লড়েছিলেন ধর্মীয় কুসংস্কার আর গোড়ামির বিরুদ্ধে, তার জীবদ্দশাতেই হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। ধর্ম, সমাজ আর বাস্তবতাকে চমকে দিয়ে, সব কিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে যাকে বিয়ে করেছিলেন, সেই প্রমীলা দেবীও পঙ্গু হয়ে যান ১৯৩৯ সালে। তার আগে মারা যায় দুই পুত্রঃ কাজী কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও কাজী অরিন্দম খালেদ (বুলবুল)।
প্রমীলা দেবী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থাতেও কবির সেবা করেছেন। কবিপত্নী শায়িত আছেন চুরুলিয়ায়। আর কবিকে কবর দেয়া হলো অন্য দেশে, যে দেশটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। প্রথমবার মৃত্যুর আগে, তিনি কি জানতেন, ধর্মের জন্য ভাগ হয়ে যাবে তার দেশ? তার দেশের মানুষেরাই ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি করে মানচিত্রটাই ভাগ করে ফেলবে?
কবি অভাবে পড়ে গান লেখা শুরু করেছিলেন, যদিও তার গানগুলোই তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সে'সময়ে তার দরকার ছিল টাকার- কবিতা, গল্প লিখে চলছিল না সংসার। লেখা শুরু করেন গান- যা চলে বাজারে- ধর্মীয়, প্রেম, দেশাত্মবোধক- বাদ রাখলেন না কোনটাই। বাংলা গজল প্রথম তার হাত ধরেই আসে। লিখেছিলেন কীর্তন ও শ্যামাসংগীতও। মেগাফোন আর এইচ.এম.ভি'র রেকর্ডের জন্য লিখলেন দু’হাতে, সুর করলেন অবিরত। বেশি লিখলেন রাগপ্রধান প্রেমের গান। সাথে গজল, শ্যামাসংগীত ,কীর্তন।
ফরমাশের গানও তিনি কম লেখননি। একবার হুগলিতে আসছেন মহাত্মা গান্ধী, বিশাল জনসভার আয়োজন। কিন্তু উদ্বোধনসংগীত হয়নি রচিত! ঘণ্টাখানেকের মধ্যে লিখে সুর করে ফেললেন তিনি। সে আনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন তিনি নিজে সেই গান গেয়ে।
“আজ না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে,
ঐ কংস-কারার দ্বার ঠেলে।
আজ শব-শ্মশানে শিব নাচে ঐ ফুল-ফোটানো পা ফেলে।।“
নজরুল মহাত্মার চরকা কেটে স্বাধীনতা আনায়নে কিংবা অহিংসনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন যুদ্ধে, রক্তে। সশস্ত্র সংগ্রাম করে যারা স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিল, সেই তেজোদ্দীপ্ত তরুণদের দলেই ছিলেন তিনি। সরাসরি বিপ্লব করে স্বাধীনতা আনার কথা বলাতেই, বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশ সরকার তার পত্রিকা ‘ধুমকেতু’কে। কিন্তু কী অবলীলায় লিখে ফেললেন গান্ধীর জনসভার উদ্বোধনসংগীত, গান্ধীরই বন্দনা করে। এমনকি লিখলেন ‘চরকার গান’ও।
"ঘোর রে ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর
ঐ স্বরাজ-রথের আগমনী শুনি চাকার শব্দে তোর!”
এমনই একটি গান ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’। সেসময়ে ধর্মীয় গানগুলো চলছিল তার খুব- গজল কী শ্যামাসংগীত, হামদ- নাত কি কীর্তন। লিখেছিলেন এই গানটিও। আর সেই প্রায়-ফরমায়েশি গানের কথা মেনেই কবর দেয়া হলো তাকে ঢাকায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে।
তার পুত্রের মতামত না নিয়ে নিজগ্রামে কবর না দিয়ে ঢাবির মসজিদের পাশে, তার স্ত্রী পুত্র থেকে দূরে কবিকে কবর দেয়ার কাজটা ছিল রীতিমতো অমানবিক।
কবি মৃত্যুবরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধ নিহত হওয়ার মাত্র এক বছর পর। সেদিনকার অবৈধ শাসকেরা তাকে তড়িঘড়ি করে মসজিদের পাশে সমাহিত করে হাসিল করেছিল নিজেদের স্বার্থ। যে লোকটাকে সুস্থ অবস্থায় কোনদিন ওরা পারত না বাগে আনতে, তাকেই তারা ব্যবহার করল নিজেদের মত করে তার মৃত্যুতে। '৭৫ এর পরেই শুরু হয়েছিল ধর্মের রাষ্ট্রীয়করণ। নজরুলকে মসজিদের পাশে কবর দেয়াটাও হয়তো ছিল সবকিছুকে ধর্মীয়করণ করার প্রথম প্রচেষ্টাগুলোর একটা। আজকাল যে ‘কম্যুনিস্ট নজরুল’, পুত্রের নাম ‘কৃষ্ণ মোহাম্মদ’ ও ‘লেনিন’(১) রাখা নজরুল, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন’ বলা নজরুল আর চিরবিদ্রোহী প্রেমিক নজরুলকে পাশে ঠেলে, গজল রচয়িতা নজরুলকেই প্রাধান্য দেয়ার একটা প্রবণতা চালু হয়েছে, তা হয়তো নজরুলকে মসজিদের পাশে কবর দেয়ার মাধ্যমেই চালু হয়েছিল।
বর্ধমানের এক অজপাড়াগাঁ থেকে ঝটিকার মত উদয় হয়ে নবদিগন্তের সূচনা করেছিলেন নজরুল একা। একা তিনি মৃত্যুর পরও। পাশে নেই জীবনসঙ্গিনী প্রমীলা। যে সন্তানকে ভুলতে পারেননি মস্তিষ্কবিকৃতির পরও, সেও নেই পাশে। পাশে নেই অরিন্দম- সব্যসাচী।
ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্যবাদী, চির-বিদ্রোহী এই কবিকে এখন হাস্যকরভাবে মৌলবাদীরা নিজেদের সম্পদ মনে করে। তাকে বিন্দুমাত্র না পড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে তাকে আশ্রয় করে, নামে বিষোদগারে। আজন্ম অসাম্প্রদায়িক এক অগ্নিবীণা আজ রাষ্ট্রধর্মওয়ালা একটা দেশের জাতীয় কবি!
শাহবাগ দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার সময়, তার কবরের দিকে চোখ গেলেই মনে হয়, এখানে শুয়ে আছে হেরে যাওয়া সহস্র স্বপ্ন, যে স্বপ্নে গান আর কবিতা ছিল, প্রেম আর মানুষ ছিল, ধর্মীয় সামাজিক বিভেদ ছিল না, ছিল না কোন কাঁটাতার কিংবা বিজিবি বিএসএস, সে স্বপ্ন আজ মূর্খদের দুর্গন্ধ উপস্থিতিতে পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে।
ছবিতেঃ মস্তিষ্ক বিকৃতির পর লেখা নজরুলের সেই চার লাইন।
ছবিসূত্রঃ নজরুল ইসলাম কিশোর জীবনী/ হায়াৎ মামুদ
(১)- কাজী অনিরুদ্ধের আরেক নাম ছিল লেনিন, কবি ডাকতেন নিনি বলে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


