একদিন বিকেলে ক্লাস শেষের নির্ধারিত সিগারেটের সময় শ্যাডোর দেয়ালে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ছবি সহ একটা পোস্টারে দেখেছিলাম। তিনি ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করবেন। মুক্তিযুদ্ধ ও তার পূর্বের সময়টা এখন বেশি আলোচিত, আর এমন সব সুবিধাভোগী কথিত বুদ্ধিজীবীরা সেসব আলোচনা করেন- ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহ জন্মানোর কথাই না। কিন্তু সেদিন আগ্রহ জন্মেছিল। ঠিক করেছিলাম, সময়মতো উপস্থিত থাকব অডিটোরিয়ামে।
নির্দিষ্ট দিনে অডিটোরিয়ামে পৌঁছেছি যখন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। মৃদু স্বরে- স্পিকার না থাকলে শোনাই যেত না, পাঠ করছিলেন হাতে লেখা কাগজ থেকে। শিক্ষকসুলভ দৃঢ়তা ছিল না তার কণ্ঠে। ৬৯ কে আলোচনা করছিলেন দর্শকের জায়গা থেকে- বামেরা জনমানুষের কথা বললেও, কেন সেই জনজোয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে, প্রবন্ধের মুখ্য বিষয় ছিল তাই।
অডিটোরিয়াম সেদিন ফাঁকা ছিলো একদম। উপস্থাপিকা ও কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া আর বিশেষ কেউ ছিলো না। ছয় সাতজন ছাত্র ছিল মাত্র। মধ্যরাত্রীর সুনসান সড়কের নীরবতায় আঘাত করছিল তার মৃদু মনোটনিক স্বর। শ্রোতাদের দিকে তিনি তাকাননি বিশেষ, একটানা পাঠ করেছিলেন প্রবন্ধটা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্য প্রায় নিরলঙ্কার, সাদামাটা; ভাষার সৌন্দর্য তার লেখায় অনুপস্থিত। কিন্তু তার লেখা ‘পিতৃতান্ত্রিকতার বিপক্ষে’ পাল্টে দিয়েছিল অজপাড়াগাঁর এক কিশোরের মনন, বিকোশিত করেছিল চিন্তার পরিধি, বদলে দিয়েছিল সমাজটাকে দেখার চোখ। তার প্রবন্ধপাঠের আসরের ওমন উপস্থিতিতে তাই বিমর্ষ হয়েছিলাম খুব। মনে হয়েছিল, “আলবাল সব অনুষ্ঠনে এত লোক যায়, আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ কেউ শুনতে আসে না!”
কিন্তু তাকে, আমার প্রিয় প্রাবন্ধিককে, বিচলিত মনে হয়নি একবারও। প্রবন্ধপাঠ শেষে, আমন্ত্রিতদের সাথে কথা বলছিলেন তিনি হাসিমুখে। আমার দিকে একবার শুধু চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন তিনি।
অডিটোরিয়াম থেকে বেড়িয়েই মনে হয়েছিল, তিনি এই উপস্থিতি, লোকপ্রিয়তা, অটোগ্রাফ ইত্যাদির অনেক ঊর্ধ্বে। শুদ্ধতম চিন্তকেরা যেমন হয়- অজনপ্রিয়, অখ্যাত এবং প্রায় বিস্মৃত, তিনি তেমনই। তার গ্রন্থগুলো থাকে অবিক্রিত, এমনকি বইমেলাতেও। লোকপ্রিয়তার দিকে নজর দিলে তিনি লিখতে পারতেন না চিন্তাজাগানিয়া প্রবন্ধগুলো, আঘাত করতে পারতেন না আমাদের মননে প্রোথিত দৃঢ় অন্ধ বিশ্বাসে। লোকপ্রিয় হতে তাকে সাধারণ বিশ্বাস ও চিন্তার সমান্তরালে কলম ধরতে হতো, লিখতে হতো তাদের চাহিদা মাফিক কিংবা সৃষ্টি করতে হতো অহেতুক অকারণ বিতর্ক। জনপ্রিয়তার আশা করেননি তিনি, তিনি জানতেন জনপ্রিয়তা তাকে নিচে নামিয়ে ফেলবে, তিনি নেমে আসবেন মেরুদণ্ডহীন গোবরমস্তিষ্কদের সমভূমিতে।
আমাদের শিক্ষিত সমাজ তাকে এখনো প্রাপ্য মর্যাদা না দিলেও, প্রতিক্রিয়াশীলেরা তাকে চিনেছিল ঠিকই, ৫০ বছর আগেই, যখন তিনি তরুণ অধ্যাপক। একাত্তরে আলবদরের বুদ্ধিজীবীদের লিস্টে ছিল তার নাম, দৈবক্রমে বেঁচে যান তিনি। ১৪ ডিসেম্বর যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, তারা যদি বেঁচে যেতেন কোনভাবে, তারাও হয়তো এমন নিভৃতেই কাজ করতেন, খ্যাতি অখ্যাতির হিসেব না করে।
অনেকের “নির্মোহ থাকো” টাইপ উপদেশঠাসা লেখা পড়ে মনেমনে বলেছি, “এমন উপদেশ প্ল্যাটফর্ম পাইলে আমিও ছাড়তে পারি!”
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দেখে সেদিন বুঝেছিলাম, কিছু মানুষ এখনো ঋষির মতো জীবন যাপন করে। সামরিক শাসকের সামনে মাথা নত করবেন না বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ। লিখিত প্রবন্ধগুলোর মতো, জীবনটাও তার নিজেকে বিকিয়ে না দেয়ার শিক্ষা দেয়।
১০/০৮/২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৩