somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুদ্ধতম প্রাবন্ধিকঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

১০ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একদিন বিকেলে ক্লাস শেষের নির্ধারিত সিগারেটের সময় শ্যাডোর দেয়ালে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ছবি সহ একটা পোস্টারে দেখেছিলাম। তিনি ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করবেন। মুক্তিযুদ্ধ ও তার পূর্বের সময়টা এখন বেশি আলোচিত, আর এমন সব সুবিধাভোগী কথিত বুদ্ধিজীবীরা সেসব আলোচনা করেন- ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহ জন্মানোর কথাই না। কিন্তু সেদিন আগ্রহ জন্মেছিল। ঠিক করেছিলাম, সময়মতো উপস্থিত থাকব অডিটোরিয়ামে।
নির্দিষ্ট দিনে অডিটোরিয়ামে পৌঁছেছি যখন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। মৃদু স্বরে- স্পিকার না থাকলে শোনাই যেত না, পাঠ করছিলেন হাতে লেখা কাগজ থেকে। শিক্ষকসুলভ দৃঢ়তা ছিল না তার কণ্ঠে। ৬৯ কে আলোচনা করছিলেন দর্শকের জায়গা থেকে- বামেরা জনমানুষের কথা বললেও, কেন সেই জনজোয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে, প্রবন্ধের মুখ্য বিষয় ছিল তাই।
অডিটোরিয়াম সেদিন ফাঁকা ছিলো একদম। উপস্থাপিকা ও কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া আর বিশেষ কেউ ছিলো না। ছয় সাতজন ছাত্র ছিল মাত্র। মধ্যরাত্রীর সুনসান সড়কের নীরবতায় আঘাত করছিল তার মৃদু মনোটনিক স্বর। শ্রোতাদের দিকে তিনি তাকাননি বিশেষ, একটানা পাঠ করেছিলেন প্রবন্ধটা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্য প্রায় নিরলঙ্কার, সাদামাটা; ভাষার সৌন্দর্য তার লেখায় অনুপস্থিত। কিন্তু তার লেখা ‘পিতৃতান্ত্রিকতার বিপক্ষে’ পাল্টে দিয়েছিল অজপাড়াগাঁর এক কিশোরের মনন, বিকোশিত করেছিল চিন্তার পরিধি, বদলে দিয়েছিল সমাজটাকে দেখার চোখ। তার প্রবন্ধপাঠের আসরের ওমন উপস্থিতিতে তাই বিমর্ষ হয়েছিলাম খুব। মনে হয়েছিল, “আলবাল সব অনুষ্ঠনে এত লোক যায়, আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ কেউ শুনতে আসে না!”
কিন্তু তাকে, আমার প্রিয় প্রাবন্ধিককে, বিচলিত মনে হয়নি একবারও। প্রবন্ধপাঠ শেষে, আমন্ত্রিতদের সাথে কথা বলছিলেন তিনি হাসিমুখে। আমার দিকে একবার শুধু চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন তিনি।
অডিটোরিয়াম থেকে বেড়িয়েই মনে হয়েছিল, তিনি এই উপস্থিতি, লোকপ্রিয়তা, অটোগ্রাফ ইত্যাদির অনেক ঊর্ধ্বে। শুদ্ধতম চিন্তকেরা যেমন হয়- অজনপ্রিয়, অখ্যাত এবং প্রায় বিস্মৃত, তিনি তেমনই। তার গ্রন্থগুলো থাকে অবিক্রিত, এমনকি বইমেলাতেও। লোকপ্রিয়তার দিকে নজর দিলে তিনি লিখতে পারতেন না চিন্তাজাগানিয়া প্রবন্ধগুলো, আঘাত করতে পারতেন না আমাদের মননে প্রোথিত দৃঢ় অন্ধ বিশ্বাসে। লোকপ্রিয় হতে তাকে সাধারণ বিশ্বাস ও চিন্তার সমান্তরালে কলম ধরতে হতো, লিখতে হতো তাদের চাহিদা মাফিক কিংবা সৃষ্টি করতে হতো অহেতুক অকারণ বিতর্ক। জনপ্রিয়তার আশা করেননি তিনি, তিনি জানতেন জনপ্রিয়তা তাকে নিচে নামিয়ে ফেলবে, তিনি নেমে আসবেন মেরুদণ্ডহীন গোবরমস্তিষ্কদের সমভূমিতে।
আমাদের শিক্ষিত সমাজ তাকে এখনো প্রাপ্য মর্যাদা না দিলেও, প্রতিক্রিয়াশীলেরা তাকে চিনেছিল ঠিকই, ৫০ বছর আগেই, যখন তিনি তরুণ অধ্যাপক। একাত্তরে আলবদরের বুদ্ধিজীবীদের লিস্টে ছিল তার নাম, দৈবক্রমে বেঁচে যান তিনি। ১৪ ডিসেম্বর যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, তারা যদি বেঁচে যেতেন কোনভাবে, তারাও হয়তো এমন নিভৃতেই কাজ করতেন, খ্যাতি অখ্যাতির হিসেব না করে।
অনেকের “নির্মোহ থাকো” টাইপ উপদেশঠাসা লেখা পড়ে মনেমনে বলেছি, “এমন উপদেশ প্ল্যাটফর্ম পাইলে আমিও ছাড়তে পারি!”
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দেখে সেদিন বুঝেছিলাম, কিছু মানুষ এখনো ঋষির মতো জীবন যাপন করে। সামরিক শাসকের সামনে মাথা নত করবেন না বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ। লিখিত প্রবন্ধগুলোর মতো, জীবনটাও তার নিজেকে বিকিয়ে না দেয়ার শিক্ষা দেয়।
১০/০৮/২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৩
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×