somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাহমান নাসির স্যার, আমাদের জীবন বদলে দেয়া একজন শিক্ষক

০৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রশ্ন হাতে পেয়ে মাথা নষ্ট! এ কেমন প্রশ্ন রে বাবা!
কেবল থিওরিস্টের নাম আর নিজের ভাবনা দিয়ে বিশ্লেষণের নির্দেশ সেখানে! পরীক্ষা হলে স্টুডেন্টরা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে, আমি নিজেও কলম দাঁতে চেপে বসে আছি ১০ মিনিট! শেষ মেষ মনে হলো, লিখি, আমি যা বুঝি, তাই লিখি। পরীক্ষাশেষে মহা উত্তেজিত স্টুডেন্টদের মুখে একটাই নাম শুনছিলাম, নাসির স্যার করেছেন এই প্রশ্ন! বেশিরভাগই ক্ষ্যাপা, কেননা , ১০ বছর ধরে চলে আসা বড়ভাইদের মহামূল্যবান ফটোকপি নোট, প্রাইভেট পড়া (নৃবিজ্ঞানের তাও!) আর টিচারদের অতি সংক্ষিপ্ত সাজেশনের কোনটাই যে কাজে লাগেনি!
আমি মোটামুটি স্বস্তিতে আছি! কারণ,
থিওরি বরাবরেরই ভালো লাগার বিষয় আমার। এখানে ভাবার অবকাশ পাওয়া যায়। যদিও পরীক্ষার খাতায় ঠিক ততটুকুই লিখতে হয়, যতটুকু শিক্ষক ক্লাসে বলবেন, এই বেশি লেখা আর আত্মহত্যা করা একই কথা। আজ মনে হচ্ছিলো, প্রথমবারের মত নিজের ভাবনাগুলো লিখছি, নিজে যা বুঝেছি তা লিখছি, গোপাল তস্য ধর্মপাল, তস্য... লিখে আসি নি!
স্টুডেন্টদের রাগের খানিকটা যুক্তিও ছিলো, কেননা, আমাদের তো নৃবিজ্ঞানকে ভালোবাসতে বলে নি কেউ! বলেছে, এই ছয়টা প্রশ্ন পড়বে, এটা বলছি, লিখো, এই বাইরে লিখবে না, ফলে, কজনই বা খুঁজে পেতে রোলা বার্থের “লেখকের মৃত্যু” বা স্ত্রসের “মিথ এন্ড মিনিং” পড়তে যাবে। থিওরি তো তাদের কাছে দুই পাতার একটা নোটের নাম। লেভি স্ত্রসের মতন দারুণ রহস্যময় একটা মানুষের ভাবনাকে আমাদের ভাবনায় ঢোকাবার চেষ্টা কেউ করেনি তো!
থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন, আমাদের এক শিক্ষক থিওরির কোর্স কমপ্লিট না করেই দেশের বাইরে চলে গেলেন!আমাদের সেশনজট থেকে বাঁচাবার দায়িত্ব নিলেন নাসির স্যার! প্রথম দিন পড়ালেন প্রতীকবাদ, ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ, ভিক্টর টার্নার আর মেরি ডগলাস... থিওরি জিনিসটাকে কম বেশী সবাই খুব অপছন্দ করতো এর আগে! অথচ কি অদ্ভুত, ঐ দিন আমরা সবাই হাসছি, অবাক হচ্ছি, কৌতুহল হচ্ছে, শিখছি! কি অদ্ভুতভাবে যে স্যার পড়ালেন! এতো প্রাঞ্জল, এতো জীবন্ত হয়ে মনে হচ্ছিলো যেন এই তাত্ত্বিকেরাই বই থেকে উঠে এসে তাদের তত্ত্ব আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন! সেদিন ক্লাস শেষে ক্লাসেরশেষ বেঞ্চির ছেলেটাও সেমিনার ওয়ার্ক করেছিল, আমি জানি!
ফোর্থ ইয়ারের রিসার্চ মনোগ্রাফের জন্যে গ্রুপ ভাগ হয়ে গেছে। দীপক পড়েছে নাসির স্যার এর গ্রুপে। স্যার ওদের নিয়ে বসেন, নতুন অনেক কিছুই শেখান, ঝুপড়িতে আড্ডা দেন। আমরা অসহায়ের মত দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি। ওরা বিকেলবেলা আড্ডা দিতে এসে শেয়ার করে কি পরিমাণ শিখছে, জানছে ওরা। শুধু তাই না, এক একজনের গবেষণার টাইটেলটাও যে কি পরিমাণ কাব্যিক আর অর্থবহ! আমার খুব হিংসে হতো! মনে হতো, ইশ আমিও যদি ওদের গ্রুপের একজন হতে পারতাম! এদিকে আমার অবস্থা মোটেই সুবিধার না, পুরো রিসার্চের মাথামুন্ডু কিছুই করতে পারছি না, যথেষ্ট সহযোগিতাও পাচ্ছিনা। কান্নাকাটি করার মত অবস্থা। শেষ মেষ দীপ বলল, তুমি স্যার এর কাছে যাও। উনি হয়তো তোয়াকে কিছুটা গাইডেন্স দিলেও দিতে পারেন। অনেক ভয়ে ভয়ে প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে স্যার এর রুমের দরজার পাশে দাঁড়ালাম। মনে হয় সেদিন আমি ঘন্টা তিনেক কেবল ঘুরাঘুরিই করেছি। ঢুকতে পারি নি। পরদিন আবার গেলাম। আসলে ভয় পাচ্ছিলাম, কারণ, এক শিক্ষকের রিসার্চ স্টুডেন্টকে অন্য শিক্ষক কখনোই সহযোগিতা করেন না। স্যার এর সামনে গিয়ে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বললাম, আমি রিসার্চের কিছুই করতে পারছি না। উনি বললেন কি নিয়ে গবেষণা করতে চাও? আমি বললাম, বিজ্ঞাপনে নারী পুরুষের উপস্থাপন নিয়ে। উনি আমার রিসার্চের টপিকটাকে আরেকটা ভিন্ন মাত্রায় এনে (কনজিউমারিজম) কাজ শুরু করতে বললেন। কিছু তাত্ত্বিক দিকনির্দেশনা দিলেন। বললেন, পারবে না? আমার হাতে তখন আকাশের চাঁদ! এতোদিন কিছু বুঝতে না পারা এই আমি সেদিন রাতে বসে সাড়ে চারশো বিজ্ঞাপন দেখে অনেকখানি এনালাইসিস করে ফেলেছিলাম! এত্তো সহজ আর ইন্টারেস্টিং হয়ে গিয়েছিলো বিষয়টা! আমি আমার কাজটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম ঠিক সেদিন থেকেই! আমার পুরো রিসার্চ মনোগ্রাফের কৃতিত্বটা নাসির স্যার এরই! স্যার তার রিসার্চ স্টুডেন্টদের মনোগ্রাফের প্রতিটা বিষয় নিয়ে এত্তো নিখুঁত ছিলেন, পেজ সেট আপ, ফন্ট, ফন্টের সাইজ, লাইনের মধ্যে কতটুকু স্পেস থাকবে, কোথায় কোন কাগজে বাঁধাই হবে সেটাও ঠিক করে দিতেন, ফলে ১০০ টা পেপারের মাঝেও স্যার এর করানো রিসার্চ মনোগ্রাফ কোনটা সেটা হাতে নিলেই বোঝা যেত! বলা বাহুল্য দীপকের মতই আমারটাও একই রকম করে করেছিলাম। স্যার বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু কিছু বলেন নি। রিসার্চে এ প্লাস পেয়েছিলাম! সবটুকু ধন্যবাদ আপনাকেই স্যার!
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেরা অর্জন স্যার এর কিছু ক্লাস, কিছু কথা এবং তার আশীর্বাদ। স্যার দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে। স্যার এর রুমের দরজাটায় তালাবন্ধ। স্যার নেই জেনেও আমরা কেউ কেউ অনেক মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। শুধু মনে হত, এক্ষুণি বোধ হয় স্যার ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরুবেন আর বলবেন, “এই গাধাগুলো এখানে কি করছে! ক্লাস নেই!” আর আমরাও গাধার পালের মতই সরে দাঁড়াবো হুড়োহুড়ি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনটি কেটে গেলো স্যার এর আশীর্বাদ ছাড়াই। কিন্তু সেদিনও স্যার আমাদের সাথেই ছিলেন। স্যার এর শেখানো গান আমরা গেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত!
অফিসে ওপেন হতে না চাওয়া এক্সেল ফাইলের বিরতির মুহূর্তে মাঝে মাঝেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই সিব দিনগুলোয়, যেদিন হুট করেই স্যার আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে পড়েছিলেন সিলেটগামী স্টাডি ট্যুরের ট্রেনে, আর আমরা চিৎকার করে উঠেছিলাম এতো জোরে যে, পুরো ট্রেনের যাত্রীরা ভেবেছিল, নির্ঘাত কোন সেলিব্রিটি যাচ্ছেন এই ট্রেনে। স্যার এর সাথে বাসে যাবার সময় আমরা কেউই সিটে বসতে চাইতাম না, বসতামও না। কারণ প্রতিটা মুহূর্তই যে শেখার। স্যার বলছেন, স্যার বকছেন, স্যার গাইছেন...স্যার এর বানানো ডকুমেন্টারী, স্যার এর কবিতা... জীবনে এখনো কোন অর্জনে সবার আগে মনে হয় স্যার কে জানাই। স্যার সব সময় তার বাম হাত মাথার উপরে রেখে দোয়া করতেন। এখনো কোন অর্জনে সবার আগে স্যার কেই জানাতে ইচ্ছে করে। কারণ গাধাগুলো যেদিন মানুষের মতন মানুষ হবে সেদিন আমাদের স্যার এর চাইতে বেশী খুশি এই পৃথিবীতে কেউ হবে না।
আমার এখনো ইচ্ছে করে, এখনো ঠেলেঠুলে থার্ড ইয়ারের ক্লাসে জায়গা করে নেই। স্যার এর বানানো ডকুমেন্টারী দেখি, লেকচার শুনি, বকা খাই। আর কিছু না হোক, স্যার এর মুখে “গাধা” ডাকটা একবার হলেও শুনি।
শ্রদ্ধেয় নাসির স্যার, আজকের এই দিনে পৃথিবীতে আপনাকে পাঠাবার জন্যে সৃষ্টিকর্তাকে অনেক ধন্যবাদ! আপনি আমাদের গাধা বলতেন, কিন্তু সত্যিকার মানুষ হবার প্রেরনা আমরা আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি। এখনো আপনার কথা ভেবে আমরা কখনো খাবার নষ্ট করি না (আপনি আমাদের পিকনিকে বকা দিয়েছিলেন), চেষ্টা করি রাস্তায় কলার খোসা পড়ে থাকলে তা সরিয়ে দিতে, অসৎ কাজগুলো থেকে দূরে থাকার শিক্ষা যে আপনিই আপনার নিজের জীবন থেকে শিখিয়েছেন! শুভ জন্মদিন স্যার!
পুনশ্চঃ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ যদি কখনো যান, তবে নৃবিজ্ঞান বিভাগের যে কম্পিউটার ল্যাবে যাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বেশি গতির ইন্টারনেট সেখানেই আমরা ব্যবহার করেছি, বিবর্ত পাঠচক্র নামে একট মুক্তবুদ্ধি চর্চার যে জায়গা, সেখানে কিছুক্ষণ বসবার অনুরোধ রইলো, সময় থাকলে কলা ঝুপড়িতেই পাবেন অঙ্গণ নামের সাংস্কৃতিক সংগঠনটিকে, আর একটুখানি সময় হাতে নিয়ে যদি পারেন তবে এতো কিছু যিনি করেছেন, তাঁর একটা ক্লাস করে আসবেন, আমি নিশ্চিত এই শেষ ৪৫ মিনিট আপনাকে নৃবিজ্ঞানকে ভালোবাসতে বাধ্য করবে! আজকের এই লেখাটা সেই অসাধারণ শিক্ষককে নিয়েই। তিনি রাহমান নাসির উদ্দীন স্যার। ফ্যাকাল্টি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:৩৩
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×