আইটি এর লোকেরা খুব বোরিং টাইপের হয়। এধরনের কথা আইটি'র লোকদের প্রায়ই শুনতে হয়। আমি আমার জীবনে এটা ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। কেউ একথা বললেই আমার রোলমডেল.."মুহাম্মদ জাফর ইকবাল" স্যারের উদাহরণ দেই। বন্ধুরা কেউ আমাকে উদ্দেশ্য করে বললে চুপ করে থাকি। আজ আর চুপ না থেকে কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করল। নিজের কথাই লিখলাম।
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল আইটি তে পড়ার। কিন্তু, যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজ জীবনে পা রাখলাম আশেপাশের আরও অনেক কিছু্ই অনেক বেশি রঙিন মনে হতে লাগল। গল্পের বই পড়ার অভ্যাস নেশায় পরিনত হল। যোগ দিলাম বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে।
সমমনা অনেক বন্ধুও পেয়ে গেলাম..দিনরাত আড্ডা-আর ঘোরাঘুরির পর সময় পেলে মাঝে মাঝে কলেজের পড়া পড়তাম। সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড, ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ানো; এগুলোর চেয়ে মহান পৃথিবীতে আর কিছুই নেই এমনটি মনে হতে লাগল। আব্দুল্লাহ্ আবু সাইদ স্যারের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে.. সেই কলেজ জীবনেই কখনও বাড়ীতে বলে না বলে, বেরিয়ে পড়তাম ভ্রমনে। বাংলাদেশের সবকয়টি বিভাগীয় শহর সহ প্রায় ৩০-৩৫ টি জেলা ঘুরে ফেললাম ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষার আগেই। জীবনটা খুব বেশি উপভোগ্য মনে হতে লাগল। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের চেয়ে তখন নিজেদেরকে খুব আলাদা মনে হত।
শুরু হল ইউনিভার্সিটি জীবন। শখের কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হলাম । ক্লাসের অন্যান্যদের তুলনায় আমি ছিলাম পুরোই অন্য জগতের বাসিন্দা। ক্লাসে কোন ভাল বন্ধু তৈরী হল না। তাদের কেউই উপন্যাস পড়ে না, আত্বীয়-স্বজনের বাড়ী ছাড়া জীবনে কোথাও যায়ও নি, হলিউড-বলিউডের মারদাঙ্গা ছবি ছাড়া কোন ছবির খোঁজও তাদের জানা থাকত না। একারণে, কোন মতে ক্লাস শেষ করেই দৌড় দিতাম চারুকলায়। ছাদের উপর আমার আত্মার সংঙ্গী সব বন্ধুদের সাথে শুরু করতাম আড্ডা। সাথে থাকত চা আর সিগারেট। অন্যান্য বন্ধুদের তুলনাই আমি সিগারেট একটু দেরিতে শুরু করেছিলাম। কারণ, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ২০ বছর হওয়ার আগে সিগারেট ছোঁবো না।
একসময় চারুকলায় সন্ধ্যার পর বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আড্ডা শুরু করলাম টি.এস.সি, মধুর ক্যন্টিন, আজিজ মার্কেট এসব জায়গাগুলিতে। ঐ সময়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলি মনে হত বইমেলা, চলচিত্র উৎসব, কবিতা উৎসবের দিনগুলোকে। প্রতিটি উসবের সময়েই কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে পড়তাম। যদি কোনও টাকাপয়সা উপার্জন হত তবে তা খরচ করে ফেলতাম উৎসব শেষে কোন জায়গা ঘুরতে গিয়ে।
অন্য বন্ধুদেরকে আমি হিংসে করতাম (এখনও করি) তারা চারুকলা/বাংলা/ইংরেজী/ এসব বিভাগের ছাত্র ছিল বলে। কি মজাই না তাদের লেখাপড়াগুলো..! আমিও শখের বশে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলাম। আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে ইমপ্প্রেস করার জন্য..! নিজেরও অবশ্য খুব ভাল লাগত। সাথে কিছু পকেট খরচাও এসে যেত..খারাপ কি..! এদিকে আমি ইউনিভার্সিটিতে মোটামুটি ডাব্বা মারা শুরু করলাম। মা-বাবার মনে হল ছেলেকে পথে ফেরাবার আর কোন উপায় নেই। ফলে নির্বাসিত হলাম পরবাসে।
পরবাসে এসে মানুষের দেখা তেমন একটা পেলাম নাহ্ বেশির ভাগই রোবট। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা কাজ আর লেখাপড়ার পাশাপাশি আর কিছুই করার সুযোগ পায় না। আর যারা চাকুরী করেন তারাও টাকা উপার্জন/জমানো আর দেশে পাঠানোর বাইরে কিছু ভাববার সময় পান না। বাংলাদেশি কমিউনিটি তে গিয়ে দেখলাম সেখানে বাংলাদেশের ঐতিহ্য বলতে গ্রুপিং আর পরচর্চা টুকুই অবশিষ্ট আছে। দু-তিন বছর আগে যেসব বাঙালী ছেলেমেয়েরা এসেছে তাদের ইদানিং বাংলায় কথা বলতে কষ্ট হয়..!
বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটির দুবছরের পড়ালেখা এই দেশে কোন কাজে আসল না। আমি প্রথম কদিন মানুষের মতন আচরণ করতে গিয়ে খেলাম হোচঁট। চলে আসলাম সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটা শহরে। সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের গয়ে একটা বাড়িতে উঠলাম। এতদিনে মনে হল মনের মত একটা জায়গাতে এলাম। তবে অনেক কিছু হারালামও বটে ! কোন বন্ধু-বান্ধব ছাড়া চলতে গিয়ে প্রথম কদিন খুব খারাপ লাগত। এই শহরে বাঙালী তেমন একটা নেই । খোঁজ করার চেষ্টাও করিনি। জীবনটাকে আবার নতুন করে গড়া শুরু করলাম। বাবা-মা সঙ্গে নেই সঙ্গে আছে তাদের আশা আর স্বপ্ন। সেটাই সফল করার জন্য দিনরাত এক করে মগ্ন আছি জীবন গড়ার এই কঠিন কর্মে। ক্লাস করা.. পার্ট টাইম জব ..মুভি দেখা, ফেইসবুক আর ব্লগই আমার এখনকার জীবন। ছাত্র-জীবন থেকে বেশকিছু মূল্যবান সময় হারালাম।বিনিময়ে পেলাম বেশ কিছু অভিজ্ঞতা। লাভ-লোকসানের হিসেবটা করা হয় নি এখনও।
আব্দুল্লাহ আবু সাইদ স্যারের একটা কথা এখনও মনে পড়ে.." তোমরা এখানে বই পড় এর মানে এই না যে তোমাদের সবার লেখক বা সাহিত্যিক হতে হবে। আমাদের দেশের জন্য চাই আলোকিত মানুষ। তোমরা যখন বড় হয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন পেশাতে যাবে, তখন সাথে তোমরা আরেকটু ভালো, আরেকটু উন্নত মানুষ হবে। একটা পুলিশ হলে..আরেকটু ভালো পুলিশ হবে, একটা ডাক্তার হলে আরেকটু ভাল ডাক্তার হবে, একটা ইণ্জিনিয়ার হলে আরেকটু ভাল ইন্জিনিয়ার হবে। মোটকথা..তোমাদের যা হওয়ার তোমরা তাই হবে..সাথে আরেকটু আলোকিত..অনুভূতিশীল মানুষ হবে। আর সেকারনেই তোমাদেরকে এখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু বই পড়ানো হচ্ছে, শ্রেষ্ঠ কিছু চলচিত্র দেখানো হচ্ছে। " জানিনা স্যারের এ চেষ্টা কতটুকু সফল হবে।